দুলাল সরকারের পাঁচ কবিতা
আবেগের তটভূমি
তাহলে বলো, এই ভোরের গাঁয়ে তুমিই হাত রেখেছ
পরনের জামাটি বদলে দিয়েছ তুমিই ? নীলের উপরে
হালকা গেঁরুয়া ফতুয়া তার উপর পাহাড়ি
সহিষ্ণুতার আলতো সিঁদুরের কারুকাজ...
এ তোমারি অন্তস্থ সত্তার হলুদাভ আবরণের উপর
স্ফীত ফোয়ারার নিচে
উৎসারিত উজ্জয়নীর কোন বেদনার ইতিহাস?
বলো, এ তোমারি আরাধ্য নিঃসঙ্গতা... নাকি
হৃদয় গোপন করা ফল ভারে নত দ্রাক্ষারস
বিস্মৃত দহন পংক্তিমালা...
একে একে ফুটেছে আকাশ... কোথাও
মাখন মেঘে তুলির আঁচড়ে অর্ধোত্থিত কাপালিক
গ্রীবার নিচে ঝুলে থাকা বিমূর্ত অলকগুচ্ছ
মেঘবৃক্ষে নীল ছায়াঘর ভোরের স্বপ্নচূর্ণ
বকুলের ইচ্ছে হত... চুপি চুপি
উদয়ের কাহিনীতে সুচকর্মে যুক্ত কর
তোমার স্তব্ধতা... আবেগের তটভূমি ছুঁয়ে ।
আমাদের সব আড়াল
যেদিন তুমি আমাকে বললে এই শরতের সরোবরে
পারবে কি একটা নীল পদ্ম ফোটাতে?
আমি বললাম, পারব; তবে থাকবে সাথে
এক জোড়া রাজহাঁস ভেসে ।
আর কি চাই? জানতে চাইলে তুমি বললে
পাশের নন্দন কাননে থাকবে একজোড়া হরিণ যুগল,
পায়ে যারা নূপুর পরে চরবে ঘাসে
খুঁজবে তোমাকে, তোমার লুকিয়ে থাকার মুহূর্তে ।
ঘাটে বাঁধা নৌকো, সাঁকো ছাড়া এপাড় ওপাড় হতে
এইটুকু মাত্র পথ কিন্তু মনে হবে অনন্ত কালের এ যাত্রা
চলেছি ভেসে ভেসে ।
খশে পড়ছে আমাদের সব আড়াল...
সব চোখের অন্তরালে আমরা দু’জন হয়ে উঠছি আমাদের,
ফুল, পাখি, লতায়, পাতায় তৈরি বাগানের একপাশে
নির্মিত কুঁড়েঘরে আমাদের সর্বস্ব হারানোর আনন্দ
কখনো বা হয়ে উঠত বিষাদ মন্দির, দুপুরের ঘোর লাগা
নৈশব্দে তোমার তৈরি নূতন গল্পে
পুরান খেলার সাথিকে নূতন করে পাওয়ার
কি গভীর বিষাদ... তুমি আমি
তেপান্তরের সব দূরত্ব ভেঙে সন্ধ্যার উদীয়মান
চাঁদের পাশে আমার মৌন উপস্থিতি;
দক্ষিণা বাতাস... তুমি রচনা করতে প্রতিটি মুহূর্ত আর
হারাবার নিঃসীম বেদনায় আহত আমি,
কারণ তখনো আমাকে নিয়ে লেখা হয়নি একটিও বিশুদ্ধ কবিতা ।
অনন্ত বিরহ
যেদিন মেঘগুলো জানালো তারা কেউ কাউকে ছাড়া
ঘুমাতে পারে না... শুধু করে বিছানার এপাশ ওপাশ...
ঘুমের প্রসঙ্গ এলে তারা দু’জনেই খুব কাঁদে
দীর্ঘদিনের অভ্যাসবশে এরকমই স্বভাব হয়েছে যে
ঘুম আসে না, ঘুম আসে না সবার অজান্তে
কী সম্পর্ক ছিল একজন নীরার সাথে
অরণ্যের গহীন নির্জনতার মধ্যে টোকা দেবে প্রথম দরজায়; কে আগে ?
সারা রাত, গভীর নিশীথে রাতের পরে রাত
ঘুম নেই শেষে অবিরল ধারায় ঝরল দু’জনে
যেন এক নিরাময় অযোগ্য অদৃশ্য অসুখ,
কেউ কাউকে ছাড়া ঘুমাতে পারে না দেখে
মেঘে ঢাকা চাঁদ খুব হাসে, পাখিটাও বলছে ডেকে
তারও চোখে ঘুম নেই... তাই সেও দু’জনার
একত্রে থাকার গল্প মনে করে পুড়ে যায়, পুড়ে যায় ;
দেহের কোথাও খাণ্ডব দহনে অরণ্যে অরণ্যে
আগুনের লেলিহান... দেহ পুড়ে আর কি অবশিষ্ট থাকে
জীবিত দেহের মধ্যে মেঘ কিছু পেয়েছে আবেগ?
হতে পারে... হয়েছে বা কিছু সমস্ত দেহেই তো
একি বাঁশি বাজে দেহাতীত, দেহের যমুনা
একই বকুল, তার ডালে বসে দু’টি ঘুঘু অনন্ত বিরহে ডাকে...
তোমার দীর্ঘশ্বাসগুলো
শেষ পর্যন্ত তোমার দীর্ঘশ্বাসগুলো
খুঁজে পেয়েছি...
কত খুঁজেছি হন্যে হয়ে এখানে সেখানে,
অতঃপর আগন্তুক গোধূলির ঠোঁটের আগায় দেখি
ঝুলে আছে হেমন্তের শীর্ষ ডানায়;
মৃত জোছনার মতো ঝুলে ছিল মায়াবী ব্যথায়
রাত্রি শেষে পশ্চিম ডানায়
নিস্তরঙ্গ জলের গুহার পাশে
কুণ্ঠিত অভিমানে
সে ছিল মৃতের মতো শত অবহেলা সয়ে
কালের বিরহ বুকে গভীর গোপনে;
তোমার দীর্ঘশ্বাসগুলো কংকালসার
দেখি ম্লান পালকের মতো দেহছিন্ন ক্লিষ্ট ব্যথায়
কোটি কোটি বছরের জীবাশ্মের বল্মীর রেখায়
দেখি সব দীর্ঘশ্বাসগুলো পান্ডুর মুখে পাথরে পাথরে
পাহাড়ের অন্তর্মূলে
তোমার দীর্ঘশ্বাসগুলো অচৈতন্যে সংজ্ঞাহীন
শুধু হেমন্তের রাতে বেঁচে আছে নীল এক হাহাকার বুকে।
ভোরের ডানা মেলার শব্দ
ভোরের ডানা মেলার শব্দ যখন পাই
মনে হয় তোমাকে জানাই , যখন ভোরের লাল, নীল, সোনালু আভাগুলো ফোটে
মনে হয় তোমাকে শোনাই ;
দূরে পূর্ব দিগন্তে শস্যনীল মাঠের উপরে
কিংবা আমার দেখা শিলং এর পাহাড় ঘেঁষে
হালকা নীল শাড়ির ওপর মৃদু গেরুয়ার লীলাতরঙ্গে ভাসা
যে পলাশ পাপড়ির ফাঁকে ফাঁকে
স্তূপ স্তূপ শিউলির নীরবতায়
ভোরের যে বীণাটি বেজে উঠেছিল তা তোমাকে জানাই;
অথবা জানাই সদ্যপ্রসূত ভোরের অলৌকিক
শরীরের থোড় ভেজা শিশির সম্পর্কের
নীল আভার কারুকার্যখচিত জল প্রতিমার পাশে
ফুটে ওঠা দ্রাক্ষাকুঞ্জের ফাঁকে ফাঁকে
যে প্রসন্ন বৃক্ষ সকল কোন আদিকাল থেকে
অনাগত ভবিষ্যৎ পর্যন্ত বিস্তৃত
তা তোমাকে জানাই সেই মহা অতৃপ্তির ধারা বিবরণী।