সলিমুল্লাহ খানের বই পড়া ও প্রীতি
Reading is the gateway skill that makes all other learning possible.
- Barack Obama
আজকের দুনিয়ায় বই পড়া কিংবা বইপ্রীতি নিয়ে তেমন মুখরোচক গল্প আর তেমন শোনা যায় না। ইলেকট্রনিক মিডিয়ার প্রতাপ প্রায় সবারই মাথা তালগোল পাকিয়ে দিয়েছে, এ কথা জোর দিয়েই বলা যায়। শুধু গরিব বিশ্বে নয়, ইউরোপ-আমেরিকাতেও খানদানি বইয়ের দোকানগুলো একের পর এক বন্ধ হওয়ার নোটিশ দিয়ে চলেছে। ব্যাপারটা বইপাগলদের আতঙ্কিত করেছে সন্দেহ নেই। কিন্তু এসব উপেক্ষা করেও যাঁরা গভীর মনযোগ দিয়ে বই পড়ে চলেছেন, আজও তাঁদের মধ্যে আমাদের বাংলাদেশের প্রিয়জন শিক্ষাবিদ জনাব সলিমুল্লাহ খান অন্যতম।
সলিমুল্লাহ খানের সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটে নিউইয়র্ক শহরের এক কবিতার আসরে, ১৯৯৩-৯৪ সালে। বাংলা কবিতা সবে তার যাত্রা শুরু করেছে উত্তর আমেরিকায়। সেই সময় আমি সমকালীন আমেরিকার বেশ কিছু কবিতা অনুবাদ করি (২০০৯ সালে ‘সাম্প্রতিক আমেরিকান কবিতা’ শিরোনামে তা বই আকারে প্রকাশিত হয়) এবং সলিমুল্লাহ খানও তখন বিভিন্ন ভাষার অনেক কবির কবিতা অনুবাদ করে চলেছেন। আস্তে আস্তে আমরা একে অপরের কবিতার প্রথম শ্রোতা/ পাঠক হয়ে উঠি। এবং তাঁর অনেকটাই আমাদের করতে হতো টেলিফোনে। কবিতাকে ঘিরেই আমাদের পরিচয় ঘন হতে থাকে। আজ এত দিন পরে, মনে হয়, সে সময় ব্যাপারটা আমরা উপভোগ করেছি বেশ, এটা বললে বাড়িয়ে বলা হবে না বলেই মনে করি।
একদিন সলিমুল্লাহ খান বললেন, লাইব্রেরিতে তাঁর বেশ কিছু বই ফেরত দেওয়া খুব জরুরি হয়ে উঠেছে, তাই আমার বাহন অর্থাৎ গাড়িটি তাঁর প্রয়োজন হবে। আমি দ্বিমত করিনি। দিনক্ষণ ঠিক করে তাঁর বাড়িতে হাজির হলাম। তিনি তখন ব্রনক্স-এ এক বহুতল দালানে থাকেন, চারতলায়। এই প্রথম তাঁর বাসায় যাওয়া। ঘরে ঢুকে দেখি কোথাও পা ফেলার জায়গা নেই। দেয়ালের চারিদিক তারকাটা মেরে বুকশেলফ বানানো হয়েছে। এবং তা দখল করে আছে বই। টেবিলে বই, বিছানার ওপরে বই, তলেও বই, ফ্লোরে বই, ঘরের কোনায় বই, কোথাও একটু খালি জায়গা নেই। যা হোক, চা খেয়ে আমরা কাজে লেগে গেলাম। কিছু ব্যাগভর্তি বই আগে থেকেই রেডি করা ছিল। ওগুলো দেখিয়ে বললেন, ‘দুইটা ব্যাগ হাতে নেন স্যার, চলেন একটা ট্রিপ দিয়ে আসি।’ উনিও দুই ব্যাগ হাতে নিলেন। মোট চার ব্যাগ বই হাতে আমরা নিচে নেমে এলাম (এক ব্যাগে বই রাখা যায় ১২-১৫টা )। গাড়ির ট্রাঙ্কে বইগুলো সাজিয়ে রাখা হলো। আরো কয়েক দফায় বই আনা হলো এবং শেষমেশ বইয়ের সংখ্যা দাঁড়াল প্রায় শ’ পাঁচেক। এত বই আপনাকে লাইব্রেরি থেকে দিল কী করে আমি জানতে চাইলাম। উত্তরে তিনি কী বলেছিলেন, এখন আমার তা মনে নেই। বলা দরকার, তিনি তাঁর পিএইচডি থিসিস লেখার জন্য বইগুলো লাইব্রেরি থেকে নিয়েছিলেন।
বছর দুই পর। আমি তখন কুইন্সের কিউ গার্ডেনে থাকি। একদিন তিনি অতিথি হয়ে এলেন আমার বাসায়। আর ঘরে ঢুকেই দেখলাম আমার ড্রইংরুমে ছোট্ট বইয়ের শেলফের দিকে তার চোখ আটকে গেল; তারপর যা হওয়ার তাই হলো। একটা বই টেনে পড়া শুরু করলেন। একসময় ঘুমাতে গেলাম আমি। সকালে উঠে দেখি উনি বেডরুমে নেই। ড্রইংরুমের এক কোণে শোফায় বসে বই পড়ছেন। গুড মর্নিং বলে জানতে চাইলাম, চা চলবে কি না। ‘মন্দ হয় না’, শান্ত স্বরে জানান দিলেন। তার পড়ার ঢং দেখে বুঝলাম মনোযোগ দিয়ে পড়ছেন। আমিও তাঁকে সুযোগ করে দিলাম। ঘণ্টা দুই পরে তিনি বইটি শেষ করে উঠলেন। আমরা আবার গল্পে মেতে উঠি।
দেখতে দেখতে কয়েক বছর পার হয়ে গেছে। আমরা যে যার মতো আছি। যেভাবে আমরা হেঁয়ালি করে বলি, সময় বহিয়া যায়। জি হ্যাঁ, সময় বহিয়া যায়। এক বিকেলে ফোনে জানালেন তিনি, ‘সময় করে একদিন জেএফকে বিমানবন্দরের কারগো সেকশনে যাওয়ার দরকার স্যার, ওখানে বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের একটা শাখা অফিস আছে (এখন আর আছে কি না জানি না) এবং সেখানে তাঁর এক বন্ধু কাজ করেন, নাম মাহমুদ রেজা চৌধুরী। উদ্দেশ্য তাঁর সঙ্গে দেখা করা। দিনক্ষণ ঠিক করে একদিন দুজনে রওনা হলাম। যেতে যেতে বললেন, ‘কিছু বই দেশে পাঠাতে হবে, বিমানে খরচ অনেক পড়বে, তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি জাহাজে (সমুদ্রপথে) পাঠাব এবং খরচ যাই হোক সেটাই হবে সর্বনিম্ন। অবশেষে শিপিং করপোরেশনের অফিসে পৌঁছালাম আমরা।’
মাহমুদ রেজা চৌধুরী ও সলিমুল্লাহ দুজনেই পুরোনো দিনের গল্প করছিল, ওদের কথায় উঠে আসে কামাল চৌধুরীর কথা, মোহন রায়হানের কথা, রুদ্রর কথা, যাঁরা নামে এবং কাজে আমারও পরিচিত ছিল। কদিন আগে মাহমুদ রেজা চৌধুরীর সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে জানতে চেয়েছিলাম আনুমানিক কী পরিমাণ বই পাঠিয়েছিল সলিমুল্লাহ খান? একটু সময় নিয়ে জানালেন, তো হাজার দুই তো হবেই, বেশিও হতে পারে। এবং উল্লেখ্য যে এগুলোর বেশির ভাগই ছিল অত্যন্ত দুঃষ্প্রাপ্য বই।
বই তাঁকে কখনো ক্লান্ত করতে পারেনি। আর তাই তিনি হয়তো ভলতেয়ারের সে কথায় মজে থাকেন সারাক্ষণ :
“Let us read, and let us dance; these two amusements will never do any harm to the world.”