সোমেন চন্দ : ঢাকাকেন্দ্রিক গল্পসাহিত্যের প্রথম পুরুষ
আয়ুষ্কাল বাইশ বছরেরও কম। লেখালেখির বয়স পাঁচ বছর। এ সময়ের মধ্যেই সোমেন চন্দ লিখে ফেললেন এমন কয়েকটি গল্প, যেগুলো হয়ে উঠল বাংলা সাহিত্যের স্থায়ী সম্পদ। সোমেন চন্দর ‘ইঁদুর’ ও ‘বনস্পতি’ গল্পের কথা বারংবার উল্লেখ করেন হাসান আজিজুল হক, শওকত আলী, আহমদ ছফা। আর হুমায়ূন আহমেদ তো বাংলা ভাষায় লেখা কোনো ছোটগল্পের নাম বলতে বললেই বলতেন ‘ইঁদুর’ গল্পটির কথা। রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবর্ষ উদযাপন উপলেক্ষে গত শতকের ষাটের দশকে কলকাতা থেকে সাগরময় ঘোষের সম্পাদনায় ‘শত বর্ষের শত গল্প’ নামের যে অসাধারণ সংকলনটি প্রকাশিত হয়, সেখানে জায়গা পেয়েছে ‘ইঁদুর’।
আশুলিয়াতে জন্ম সোমেন চন্দর; ১৯২০ সালের ২৪ মে। তবে বাবা তাঁদের নিয়ে উঠে এসেছিলেন দক্ষিণ মৈশুণ্ডির ৪৭ নম্বর লালমোহন সাহা স্ট্রিটের পাঁচ কামরার ভাড়া বাসাতে। এখানেই বড় হয়েছেন সোমেন। মৃত্যু পর্যন্ত বসবাস করেছেন এই বাড়িতেই। মৃত্যু অবশ্য বাড়িতে নয়, রাজপথে। কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন সোমেন। নিহত হয়েছিলেন আরএসপি নামে আরেকটি উগ্র দলের গুণ্ডাদের আক্রমণে। তারিখটি ছিল ১৯৪২ সালের ৮ মার্চ।
কাফকা, কীটসের মতোই স্বল্পায়ু আমাদের সোমেন ও সুকান্তের। প্রথমোক্তদের চিন্তাধারা এবং রচনারীতির সঙ্গে শেষোক্তদের পার্থক্য বিপুল। ভূগোলের ব্যবধান, সময়ের ব্যবধান, যাপিত জীবনের ব্যবধান এসব পার্থক্যের কারণ। তবে ঐক্যের জায়গাটি হচ্ছে স্ব-স্ব ভাষার মানুষদের দীর্ঘশ্বাস, আহা তারা দীর্ঘায়ু হলে হয়তো আরো অনেক কিছু জমা করতে পারতেন বিশ্বসাহিত্যের ভাণ্ডারে। অন্যদের সঙ্গে সোমেন চন্দর পার্থক্য আরেকটি জায়গায় খুব প্রকট। অন্যেরা মৃত্যুবরণ করেছেন রোগাক্রান্ত হয়ে। আর সোমেন চন্দ নিহত হয়েছেন স্বদেশেরই রাজনৈতিক গুণ্ডাদলের হাতে।
সোমেন চন্দর কথা উঠলে রাজনীতির কথা উঠে আসে জোরেশোরে। কিন্তু আসলে রাজনীতি নয়, সাহিত্যই ছিল সোমেনের পাখির চোখ। কমিউনিস্ট পার্টি করেছেন, রেলশ্রমিক ইউনিয়ন করেছেন সত্য, কিন্তু আসল কাজ ছিল লেখালেখি। পঠনপাঠন, যোগাযোগ, সময় ও মনোযোগব্যয় প্রধানত লেখালেখিতেই। তা না হলে এত অল্প সময়ের মধ্যে এতগুলো চমৎকার রচনা উপহার দিতে পারতেন না তিনি।
পত্রিকার পাতায় প্রথম প্রকাশিত গল্পের নাম ‘শিশু তপন’। ছাপা হয়েছিল কলকাতার সাপ্তাহিক ‘দেশ’ পত্রিকায় ১৯৩৭ সালে। একই বছরে সাপ্তাহিক ‘অগ্রগতি’ পত্রিকায় ‘অন্ধ শ্রীবিলাসের অনেক দিনের একদিন’ এবং ‘মরুভূমিতে মুক্তি’ ছাপা হলো। নির্মলকুমার ঘোষ সম্পাদিত পাক্ষিক ‘সবুজ বাংলার কথা’ পত্রিকায় লেখেন ‘রাণু’ ও ‘স্যার বিজয়শঙ্কর’ গল্প। পরবর্তী সময়ে নির্মলকুমার ঘোষ ‘বালীগঞ্জ’ পত্রিকা প্রকাশ করলে প্রথম সংখ্যা থেকেই ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতে থাকে সোমেন চন্দর উপন্যাস ‘বন্যা’। একাদশ সংখ্যা পর্যন্ত, এগারো কিস্তিতে শেষ হয় ‘বন্যা’ উপন্যাসটি। ঢাকার রূপলাল হাউস থেকে প্রকাশিত মাসিক ‘শান্তি’ পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল সোমেনের একটি গল্প এবং দুটি একাঙ্কিকা।
ঢাকা প্রগতি লেখক সংঘের প্রথম সাহিত্য সংকলন ‘ক্রান্তি’ প্রকাশিত হয় ১৯৪০ সালে। এই সংকলনের জন্য সোমেন লিখেছিলেন তাঁর অসাধারণ বড়গল্প ‘বনস্পতি’। ইতিহাসের বিশাল এক পটভূমিকায় লেখা হয়েছিল এই গল্পটি। ইংরেজ শাসনের পূর্বকাল থেকে ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত সময়কালকে ধারণ করার চেষ্টা লক্ষ করা গেছে এই গল্পে। আখ্যানের কেন্দ্রবিন্দু একটি প্রাচীন বটবৃক্ষ। এই বটগাছটিই পীরপুর গ্রামের সুদীর্ঘ ইতিহাসের বহু ঘটনার সাক্ষী। যেসব ঘটনা এই গল্পের আখ্যান নির্মাণে ব্যবহৃত হয়েছে, সেগুলো কোনো বিশেষ একটা সময়ে ঘটেনি। গল্পে লেখক সময়গণ্ডি ভেঙে ফেলেছেন।
বাংলা ভাষায় ‘দাঙ্গা’ নিয়ে প্রথম গল্পটির লেখকও সোমেন চন্দ। পরে হাসান হাফিজুর রহমান, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, নবেন্দু ঘোষ, সমরেশ বসু সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা নিয়ে অবিস্মরণীয় গল্প লিখেছেন। কিন্তু সোমেনই পথিকৃৎ। অন্য কয়েকটি সফল গল্পের মতো ‘দাঙ্গা’ গল্পটিতেও সোমেন চন্দ সাহিত্য এবং রাজনীতিকে শিল্পকুশলতার সঙ্গে মিলিয়ে দিতে পেরেছিলেন।
২
অল্প বয়সে লেখালেখিতে এ রকম উৎকর্ষের পরিচয় পেলে আমাদের দেশের বেশিরভাগ মানুষ একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে এটি ঈশ্বর কিংবা প্রকৃতির দান। তা হয়তো কিছুটা থাকে। কিন্তু সঙ্গে যে ব্যাপক পঠন-পাঠন এবং অধ্যবসায় অপরিহার্য, তা সোমেন চন্দর বেলাতেও প্রযোজ্য। ওই বয়সেই বিস্ময়কর পাঠ-অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গিয়েছিলেন সোমেন চন্দ। তাঁর চিঠিপত্র থেকে কিছুটা পরিচয় পাওয়া যায় পরিশ্রমী লেখাপড়ার। প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা ম্যাট্রিকুলেশন। তার পরে মিটফোর্ড মেডিকেল স্কুলে ভর্তি হলেও আর্থিক অনটন এবং অসুস্থতার জন্য এক বছরের বেশি চালিয়ে যেতে পারেননি পড়াশোনা। কিন্তু ডাক্তারি পড়ায় ছেদ ঘটলেও সাহিত্য এবং রাজনৈতিক সাহিত্যপাঠে বিরতি ঘটেনি একদিনের জন্যও। তাঁর সেই সময়ের বন্ধু এবং ঢাকা প্রগতি পাঠাগারের অন্যতম সংগঠক কিরণশঙ্কর সেনগুপ্ত জানিয়েছেন, ‘১৯৩৮ সালেই তিনি (সোমেন চন্দ) পাঠাগারটির সম্পাদক হয়ে সুপরিচালনার ব্যবস্থা করেন। পাঠাগারে দেশ-বিদেশের নানা প্রগতিশীল বই নিয়ে কিছু কিছু আলোচনা ছাড়াও তরুণ লেখক বন্ধুরা গল্প-কবিতা পড়ত এবং সেসব নিয়ে কর্মীদের মধ্যে আলোচনাও হতো। নবম-দশম শ্রেণির ছাত্রজীবনের সময় থেকে সোমেন তৎকালীন বাংলাসাহিত্যের অনেকখানিই পাঠ করেছিলেন, রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে শরৎচন্দ্র পর্যন্ত প্রসারিত গল্প-উপন্যাস এবং পরবর্তী কল্লোলযুগের লেখকদের রচনা তাঁর মন ও দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রসারিত করেছিল। অল্প বয়সেই সোমেন উপলব্ধি করেছিলেন শুধু বাংলাসাহিত্য নয়, পৃথিবীর নানা দেশের সাহিত্যের সঙ্গে পরিচিত না-হতে পারলে উৎকৃষ্ট সাহিত্য রচনা সম্ভব নয়।’
পারিবারিক আবহাওয়ায় সাম্যবাদ এবং বিপ্লবের বীজ বিদ্যমান ছিল বরাবরই। তবে সোমেন চন্দকে কমিউনিস্ট পার্টিতে নিয়ে আসেন আন্দামানফেরত কিংবদন্তি বিপ্লবী সতীশ পাকরাশি। ‘অগ্নিযুগের কথা’ বইতে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘১৯৩৯ সালের মাঝামাঝি সোমেন তার দক্ষিণ মৈশুণ্ডিপাড়ায় আমাদের কমিউনিস্ট পাঠচক্রে যোগ দেয়। গোপনে ক্লাস হতো। সে সমস্ত মনপ্রাণ দিয়ে শুনত—বেশি প্রশ্ন করত না।’
তবে লেখালেখিই ছিল তাঁর সাধনক্ষেত্র। ঢাকা ছিল তখন নিতান্তই মফস্বল একটি জনপদ। বাংলা সাহিত্যের এবং চিন্তাচর্চার একচ্ছত্র প্রাণকেন্দ্র তখন কলকাতা। কলকাতার দিকে সতৃষ্ণ নয়ন মেলে রাখতেন সারা বাংলার মানুষ। অন্যদিকে সোমেন চন্দ বরাবরই অবস্থান করেছেন ঢাকায়। বই-পুস্তক পাওয়াটা ছিল কিছুটা দুঃসাধ্যই। কিন্তু সোমেন অদম্য। কিরণশঙ্কর সেনগুপ্ত জানাচ্ছেন, একটি সিনেমা হল, বাংলাবাজারে ছোট ছোট বইয়ের দোকান এবং সদরঘাট রোডে ‘স্কুল সাপ্লাই’ নামে একটি বড় বইয়ের দোকান ছিল তরুণদের আকর্ষণের জায়গা। সদরঘাটে একটি স্টলে কলকাতা থেকে প্রেরিত ও ঢাকায় প্রকাশিত নানা পত্রপত্রিকা পাওয়া যেত। সোমেন ও তাঁর বন্ধুরা এখানে এসে বই ও পত্রিকা দেখতেন। তখন পর্যন্ত ঢাকার তরুণ লেখকদের লেখালেখির মধ্যে প্রচলিত ধ্যানধারণারই প্রবণতা দেখা যায়। অথচ এ সময়ের মধ্যেই সোমেন চন্দ প্রগতি সাহিত্য সম্পর্কে পর্যাপ্ত তথ্য সংগ্রহ করে নিজের লিপিকুশলতাকে সমৃদ্ধ করতে পেরেছিলেন।’
ঢাকায় তখন রণেশ দাশগুপ্ত ছিলেন প্রগতিশীল লেখক-কর্মীদের ‘ফ্রেন্ড ফিলোসফার এবং গাইড’। সেই সময় ‘প্রগতি সাহিত্যের মর্মকথা’ নামে একটি ছোট পুস্তিকাও লিখেছিলেন রণেশ দাশগুপ্ত। সোমেন সেটি আত্মস্থ করেছিলেন। হাতে পেলেন জন লেমান সম্পাদিত ‘পেঙ্গুইন নিউ রাইটিং ইন ইউরোপ’ বইটি। বিভিন্ন সূত্র থেকে সংগ্রহ করলেন ই এম ফরস্টার, স্টিফেন স্পেন্ডার, জন কর্নফোর্ড, সি ডে লুই, ইগনাৎ দিয়ো সিলোনে, আঁদ্রে মালরোর কিছু বই। আপটন সিনক্লেয়ারের উপন্যাস পাঠ করেছিলেন। পড়েছিলেন যোসেফ মাৎসিনির লেখা ‘ডিউটিজ অফ ম্যান’ বইটাও। পড়েছেন বার্নার্ড শ, তলস্তয় এবং অবশ্যই ম্যাক্সিম গোর্কি।
সোমেন চন্দ হ্রস্ব জীবনে কলকাতায় যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন মাত্র একবারই। ১৯৩৮ সালের ডিসেম্বরে। উঠেছিলেন ‘সবুজ বাংলার কথা’ পত্রিকার সম্পাদক নির্মলকুমার ঘোষের বাসাতেই। ছিলেন কয়েক সপ্তাহ। সেই সময় তিনি চেষ্টা করেছিলেন কলকাতার লেখক ও সংগঠকদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের। মতবিনিময়ই ছিল প্রধান উদ্দেশ্য। আর ছিল সাধ্যমতো বই এবং পত্র-পত্রিকা সংগ্রহ করা। পরিচিত হয়েছিলেন বিনয় ঘোষ ও সুরেন্দ্রনাথ গোস্বামীর সঙ্গে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করার জন্য গিয়েছিলেন তাঁর দিগম্বরীতলার বাসায়। কিন্তু দেখা পাননি। মানিক সেদিন বাসায় ছিলেন না। দেখা হয়েছিল হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। কলকাতায় থাকতেন তখন বন্ধু গৌরপ্রিয় দাশবন্ধু। তাঁর সঙ্গে স্টুডিওতে গিয়ে একটা ফটো তুলেছিলেন। এটাই সোমেন চন্দর একমাত্র ফটো, যা সর্বত্র ছাপা হয়ে থাকে।
৩
১৯৪২ সালের ৮ মার্চ সোমেন চন্দ গুণ্ডাদের হাতে নৃশংসভাবে নিহত হওয়ার পরে ‘পরিচয়’ পত্রিকার জ্যৈষ্ঠ ১৩৯৪ সংখ্যার সম্পাদকীয়তে লেখা হয়, “লক্ষ লক্ষ লোকের মৃত্যুর পটভূমিকায় একটি মাত্র লোকের মৃত্যু তুচ্ছ ব্যাপার মনে হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু বিশেষ পরিবেশে একজনের মৃত্যু বহু মৃত্যুর চাইতে বেশি অর্থবহ হতে পারে। সোমেন চন্দের মৃত্যু এই জাতীয়। সোমেনের বয়স বেশি হয়নি, কিন্তু এই অল্প বয়সেই মূল্যবান কাজ করে সে তার তরুণ জীবনকে বিরল সম্পদে ঐশ্বর্যবান করেছিল। এই সংখ্যার গত সংখ্যায় ‘ইঁদুর’ নামে যে গল্পটি প্রকাশিত হয়, তাতে তার জীবনের একটিমাত্র দিকের পরিচয় পাওয়া যায়। এই পরিচয় আমাদের আশ্চর্য করে দেয়, কিন্তু এই তার পুরো পরিচয় নয়। সাহিত্যের ক্ষেত্রে তার কৃতিত্ব জীবনের বিস্তৃততর ক্ষেত্রে তার অন্তরঙ্গ অভিজ্ঞতার প্রতিভাস মাত্র। তাকে প্রাণ দিতে হলো বর্বরতার যূপকাষ্ঠে।’
৪
‘অমর’ শব্দটি যথেচ্ছ ব্যবহারে তার ঔজ্জ্বল্য হারিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের উৎকৃষ্টতম এবং বাছাইকৃত ছোটগল্পের সংকলন করতে গেলে এখনো এবং ভবিষ্যতেও, প্রথম যে লেখকের গল্পকে জায়গা করে দিতে হবে, তাঁর নাম সোমেন চন্দ। কেউ যদি বাংলা ভাষায় গল্প লিখতে আসেন, তাহলে তাঁকে অবশ্যই যে যে লেখকের লেখা পাঠ করতে হবে, সেই লেখকদের অপরিহার্য একজন সোমেন চন্দ। তাহলে ‘অমর’ তো তাঁকে বলতেই হবে।