গল্প
পরদেশী
হঠাৎ মোচড় দিয়ে তলপেটের ব্যথাটা বাড়ছে কুলসুমের। দুদিন ধরেই চিনচিনে ব্যথাটা থেকে থেকে বাড়ছে। দম নিয়ে খানিক কমলেও পরক্ষণে বেড়ে চলেছে। বাঁকা হয়ে কোনোরকম বাড়ন্ত ব্যথাতুর পেটটি দুহাঁটুর ভাঁজে চাপ দিয়ে রেখেছে কুলসুম। ঠেস দেওয়া পিঠ, কোমর টিপে দিচ্ছে কুলসুমের শাশুড়ি মজমা বেগম। হাতে জোর নেই। থাকবেওবা কোথা থেকে। পেটে ঠিক মতো দানাপানি কখন পড়েছে তা ভুলেই গেছে।
ডিঙি নৌকাটি তিন দিন ধরে খোলা আকাশের নিচে দরিয়ার অথৈ জলে ভাসছে। শিশু-কিশোর মিলিয়ে জনাপঞ্চাশেক নারী-পুরুষ। ঠাসাঠাসি করে শুয়ে-বসে আছে। শীতের দিন-রাত। বেলা গড়িয়ে গেলেও দরিয়ার আকাশে কুয়াশার চাদর কেটে যায় না। সূর্যটা কখনো উঁকি দেয় আর অনেকটা সময় মেঘের আড়ালেই থাকে।
মানুষ আর পোঁটলা-পুঁটলির ভারে ডুবুডুবু ডিঙির এক কোনায় দুমড়ানো-মোচড়ানো হয়ে পড়ে আছে কুলসুম। যার যা খাবার ছিল তার প্রায় সবই শিশুদের কান্না থামাতেই শেষ হলো। শীতল বাতাসের কামড়ে অনেকেরই শরীরের কুঁচকানো চামড়া ফেটে চৌচির। জলের ওপর ভাসলেও তৃষ্ণা নিবারণের জল ফুরিয়ে আসছে। অনেকেরই জলের কৌটার তলায় কিছুটা রয়েছে তাও নিজেরা পান করতে পারছে না। কান্নায় শিশুদের চোখের জল শুকিয়ে গেলেও বুকের তেষ্টা শুকোয়নি। নিজেদের বসতভিটা, জমি-জিরাত, ঘরে পোষা পশু-পাখি ছেড়ে একেবারেই অজানার উদ্দেশ্যে ডিঙি নৌকায় চড়ে বসেছে কয়েকটি পরিবার। রক্তমাংসের দেহের ভেতর যে প্রাণ মানুষের মনে চিরন্তন বাঁচার আকুতি জানায় সে প্রাণের জন্যই তারা অকূল দরিয়ায় ভাসছে। প্রতিটি মুহূর্ত অনিশ্চয়তা আর দুঃস্বপ্ন। এই বুঝি মৃত্যুটি অ্যালব্যাট্রাস পাখি হয়ে উড়ে এসে ছো মেরে নিয়ে গেল। ডিঙি নৌকার যে পাশটিতে পোয়াতি কুলসুম ব্যথায় কোঁকাচ্ছে তার উল্টো পাশেই পাড়ার আশি বছরের বৃদ্ধ ফজর আলী হাঁপানির যন্ত্রণায় জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে আর খুকখুক করে কাশছে। মাঝবয়সী একজন ফজর আলীকে জড়িয়ে ধরে বুকে হাত চেপে রেখেছে। বেচারা এমন অস্থির হয়ে কাশছে যেন বুকের ভেতর থেকে এক্ষুনি হৃৎপিণ্ড, ফুসফুসসহ সব বেরিয়ে পড়বে।
তিন দিন পেরিয়ে চতুর্থ দিনের সকাল হলো। কুয়াশার চাদরে আটকানো সূর্যের দেখা মেলেনি। ভাসমান নারী-পুরুষের চেহারাগুলো পলেস্তার ওঠা দেয়ালের মতো তাকিয়ে আছে আকাশ ও জলের দিকে। বিস্তীর্ণ এই দুটি অসীমের দিকে তাকিয়ে কেউ জপছে ‘ও আল্লাহ! আল্লাহরে’ আর কেউ কোটরিতে ঢুকে যাওয়া খোলা চোখে হয়তো কিছুই দেখছে না। পেছনে রেখে আসা নারকীয় ঘটনাগুলো, স্বজন হারানোর বেদনা যে বারবার মনে তোলপাড় করছে না, তা কিন্তু নয়। বুকে জমে থাকা বিশাল পাথর সরানোর কোনো সুযোগ নেই। তারপরও শুধু নিজের প্রাণটা বাঁচানোর প্রয়াসে ভুলে থাকার প্রচেষ্টা।
হঠাৎ পাঁচ-ছয় মাস বয়সী একটি শিশু তার মায়ের কোলে চিৎকার দিয়ে কান্না করে উঠল। কুলসুমের শাশুড়ি মজমা বেগম গলা উঁচু করে বাচ্চাটির দিকে তাকাল। মা বাচ্চাটির মুখে বুকের দুধ গুঁজে দিয়ে কান্না থামানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু বাচ্চাটির কান্না থামছে না।
দিন পেরিয়ে রাত এলো। দূরে হাতেগোনা কয়েকটি জেলে নৌকায় বাতি দেখা যাচ্ছে। ডিঙি নৌকাটিতে কোনো আলো নেই। গাঢ় কুয়াশায় চাঁদের আলো নৌকা অবধি পৌঁছতে পারছে না। পেটের ক্ষিধেয় অনেকেই মুখের ভাষা হারিয়েছে। নির্বাক আলো-আঁধারিতে চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে আছে। গত তিন দিন মানুষ বোঝাই নৌকাটি বেশ কয়েকবার বাংলাদেশ সীমান্তে ভিড়তে চেয়েছে। কিন্তু মিয়ানমার বাহিনীর তাক করা বন্দুকের সামনে দিয়ে যেতে হচ্ছে বলেই ভিড়তে পারেনি। ইঞ্জিনের তেল ফুরিয়ে গেছে। হাল ছেড়ে দিয়েছে মাঝি। ভাসতে ভাসতে মিয়ানমারের কোলে ভিড়লেই সবাইকে একসঙ্গে মরতে হবে।
ভয়-শঙ্কা, ক্ষুধা আর জীবনের মায়ার দোলাচলে দরিয়ার অথৈ জলে ভাসছে রোহিঙ্গা জাতির জনাপঞ্চাশেকের এই দলটি। হঠাৎ পেছন দিকে ঝপাস করে একটি শব্দ হলো। সবাই নড়েচড়ে উঠল। কিন্তু উঠে গিয়ে পেছনটায় কী ঘটল, তা দেখতে পেল না। সবাইকে তার নিজ নিজ জায়গায় ঘাপটি মেরে বসে থাকতে হচ্ছে। বেশি নড়াচড়া করলেই নৌকা কাত হয়ে সবাই ডুবে মরার যথেষ্ট সম্ভাবনা এবং শঙ্কা দুইই রয়েছে।
পেছন দিকে মহিলাদের কান্নার রোল শোনা যাচ্ছে। কেউ একজন নিশ্চয় দরিয়ার জলে পড়ে গেছে। ঘটনা ঠিক তাই। মুখে মুখে কথাটা নৌকার এ মাথায়ও চলে এলো। মানুষটি নিশ্চয় কিনারায় বসেছিল। ঝিমুতে ঝিমুতেই হয়তো পড়ে গেল। নৌকাটি এমনভাবে চারপাশ এক করে ভাসছে কেউ পড়ে গেলে ওঠানোর জো নেই। যেদিকে উঠাবে ওদিকেই নৌকা কাত হয়ে যাবে। তা ছাড়া মানুষটি পড়েই ভাসতে ভাসতে ঢেউয়ের গতিতে অনেক দূরে চলে গেছে। মহিলাদের কান্নার রোল ক্ষীণ হয়ে আসছে। কান্নারত শিশুটি ক্ষিধের তাড়নায় কাঁদতে কাঁদতেই ঘুমিয়ে পড়েছে।
রাত বাড়ছে। নৌকার এ মাথায় কুলসুম ও ফজর আলীর অবস্থা অবনতির দিকে। কুলসুমের তলপেটে ব্যথা তীব্রতর হচ্ছে। যখন-তখন অবস্থা। পাশের পুরুষরা সরে গিয়ে ধীরে ধীরে দু-তিনজন মহিলাকে কুলসুমের কাছে আসার সুযোগ করে দিয়েছে। মজমা বেগম কুলসুমকে জড়িয়ে ধরে আছে। মেয়েটি হাউমাউ করে কাঁদছে। ব্যথার যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে পড়ছে। এই প্রথম মা হতে চলেছে রশিদ মিয়ার স্ত্রী কুলসুম। বছর খানেক আগেই বিয়ে হয়েছিল। এখন আর রশিদ মিয়া নেই। মিয়ানমার বাহিনী স্ত্রী ও মায়ের সামনেই ঘরের উঠোনে গুলি করে মেরেছে রশিদ মিয়াকে। আগুন দিয়ে ঘর পুড়িয়ে দিয়েছে। গাছের আড়ালে মাটির বাংকারে লুকিয়ে ছিল বলেই বেঁচে গেল কুলসুম ও মজমা বেগম। খাবারের খোঁজে গিয়েই মিয়ানমার বাহিনীর বন্দুকের খাবারে পরিণত হয়েছিল রশিদ মিয়া। তারপর সুযোগ বুঝে পোয়াতি কুলসুমকে নিয়ে নৌকায় এসে উঠল মজমা বেগম।
ওদিকে ফজর আলীর শ্বাসটান বেড়ে গেছে। বুকটা বেশ ওঠানামা করছে। বেচারার কপাল আর হাতের শিরা-উপশিরা ইয়া মোটা হয়ে ফেঁপে উঠেছে। ফজর আলীর ছেলে করম আলী বাবার মাথা কোলে নিয়ে বসে আছে। শ্বাসটান কমানোর ব্যর্থ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
কুলসুমের প্রসব বেদনার তীব্র চিৎকার শীতের গভীর রাতকে বিদীর্ণ করে নিস্তব্ধতায় একাকার মিশে যাচ্ছে। ঢেউয়ের তালে নৌকা ভেসে কোনো একটা তীরের দিকেই এগোচ্ছে বলে মনে হলো মজমা বেগমের। কাছাকাছি বসতবাড়ির চিহ্ন দেখা যাচ্ছে। সেটি মিয়ানমার নাকি বাংলাদেশ, তা বোঝার সাধ্যি কারো নেই। সবাই জীবনকে ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দিয়েছিল যেদিন মিয়ানমারের মাটি ছেড়ে নৌকায় ভেসেছিল।
কুলসুমের শরীরে খিঁচুনি হচ্ছে। একি সঙ্গে চিৎকার। আর এদিকে ফজর আলীকে তিন-চারজন জড়িয়ে ধরে একটু ওম দেওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ ওয়া... ওয়া নবজাতকের চিৎকারে বুভুক্ষু মানুষগুলোর ফ্যাকাসে মুখে ভালোলাগা বয়ে গেল। ভাসমান মানুষেরা কান্নার শক্তি হারিয়েছে অনেক আগেই। একই [Text Box: সাথে] হাসির আবেগও হারিয়েছে। কুলসুমের কোলে এসেছে এক ছেলে শিশু। নিস্তেজ পড়ে আছে কুলসুম। নবজাতকের কান ফাটানো চিৎকার।
প্রকৃতির লীলা বোঝা বড় দায়। কুলসুমের ঔরস থেকে যখন নবজাতকটি পৃথিবীর বুকে ভাসমান নৌকায় আসছিল, তখন ধীরে ধীরে ফজর আলীর শ্বাসের টানও কমে আসছিল। ছেলে করম আলীর কোলেই শেষবারের মতো শ্বাস নিয়েছিল ফজর আলী। বাবার নিথর দেহটি কোলে নিয়ে বোবা কান্নায় স্তব্ধ করম আলী। চোখে জল নেই। মুখে কথা নেই। দেহে জোর নেই।
নবজাতক জন্মের সংবাদটির পরপরই ফজর আলীর মৃত্যুসংবাদ নৌকায় মুখে মুখে সবার কাছে চলে গেল। কিন্তু কারো কোনো বোধ নেই। ভাববিনিময় নেই। বেশি নড়াচড়া করলে নৌকা কাত হয়ে সবার ফজর আলীর পরিণতি হবে। তাই এ পৃথিবীতে কোথাও কিছু ঘটছে না, অন্তত এই নৌকায় কিছুই ঘটেনি এমন ইন্দ্রিয়হীন দেহ নিয়ে সবাই বসে আছে। যেন কেউ কারো চেনা নয়। কখনো দেখাও হয়নি। এককজন হয়তো ভিনগ্রহের বাসিন্দা।
মৃত বাবা ফজর আলীর চেহারার দিকে তাকিয়ে এবার চোখে জল এলো করম আলীর। গাল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। মিয়ানমার বাহিনী করম আলীকে মেরেই ফেলত। সাক্ষাৎ মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়েছিল বাবা ফজর আলী। কিন্তু বাবা তার চোখের সামনেই চলে গেল। ধরে রাখতে পারল না। বাবার লাশ কোলে নিয়ে খোলা আকাশের নিচে অকূল দরিয়ার অথৈ জলে ডিঙি নৌকায় ভাসছে করম আলী। এ ভাসার শেষ কোথায় নৌকার কেউ জানে না।
মজমা বেগম আবারও লক্ষ করল, নৌকাটি কোনো একটা তীরের কাছাকাছি এসে পড়েছে। কুলসুমের শিশুটির কান্না থামছে না। মজমা বেগম শিশুর মুখটি কুলসুমের বুকে কয়েকবার লাগিয়ে দেখেছে। কাজ হয় না। দুধ আসছে না। শেষমেশ যে মহিলাটির শিশু দুধের জন্যই কান্না করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছিল, সে মহিলাকেই বলল মজমা বেগম। যেন শিশুর মুখটি তার বুকে লাগিয়ে দেখে। মহিলাটি কথা শুনল। শিশুর মুখটি ওর বুকে লাগাতেই কান্না থামল। মজমা বেগমের মুখে এক চিলতে হাসি দেখা গেল। কিন্তু সে হাসির রেস বেশিক্ষণ থাকল না। শিশুটি কান্না শুরু করল। মজমা বেগম মহিলাকে তার অপর দুধে নবজাতকের মুখ লাগাতে বলল। মহিলা মজমা বেগমের কথা রাখতে পারল না। দুচোখে জল গড়িয়ে পড়ল। কথা বুঝতে পারে নাই ভেবে মজমা বেগম নিজেই নবজাতকের মুখটি ধরে মহিলার অপর বুকে লাগাতে গিয়েই থমকে গেল। মহিলা ও মজমা বেগম দুজন চোখাচোখি তাকিয়ে আছে। মুখে কোনো শব্দ নেই। কথা নেই। ভাষা নেই। চোখের দৃষ্টিতে সব শব্দরা যেন জোট বেঁধে ভাববিনিময় করছে।
মজমা বেগম তাদের আঞ্চলিক ভাষায় জানতে চাইল—কী করে হলো?
মহিলার ডান বুকের স্তনটি নেই। বাম স্তনটি পুনরায় কান্নারত নবজাতকের মুখে গুঁজে দিল। মজমা বেগমের একটি হাত শক্ত করে ধরল। তারপর বলছে—স্বামীসহ আমরা পালিয়ে আসছিলাম। পুরো একদিন হাঁটার পর হঠাৎ করেই সন্ধ্যায় আমরা ধরা পড়ে গেলাম। ওরা আমার স্বামীকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে গেল। আমার ছয় মাসের বাচ্চাটার কপালে একটা চুমু খেতে চেয়েছিল। সেই ইচ্ছেটুকুও পূরণ করতে দেয়নি ওই হারামির জাত। নিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই একটি গুলির শব্দ শুনেছিলাম।
তারপর! দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল মজমা বেগম।
আমাকে একটি ঘরে নিয়ে গেল। বাচ্চাটি মেঝেতে এক কোনায় রেখে আমাকে...। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে মহিলা। মজমা বেগম মহিলার কান্না থামানোর চেষ্টা করছে। কান্নার তোড়ে মহিলা কথাই বলতে পারছে না। জড়ানো কণ্ঠে বলছে ওরা চার-পাঁচজন ছিল। একজন হঠাৎ করে ছোরা দিয়ে আমার...। আর বলতে পারে না। কান্নার রোল ছড়িয়ে পড়ে। দ্বিতীয়টি কেটে নিতে চেয়েছিল। বাচ্চার কান্না দেখে কাটেনি। আমাকে ফেলে রেখেই চলে যায়। হাঁটার শক্তি ছিল না। কোনোরকম গাছের লতাপাতা কচলে চেপে ধরে রক্ত বন্ধ করেছিলাম। বলতে বলতেই মহিলা পুনরায় কান্নায় ভেঙে পড়ে। নবজাতক ঘুমিয়ে পড়েছে।
ভোর হয়ে আসছে। নৌকাটি একটি তীরের একেবারে কাছে চলে এসেছে। বসতবাড়ি, দু-একজন মানুষের অস্তিত্বও চোখে পড়ছে। ডিঙি নৌকাটি কাছে আসছে দেখে মানুষের আনাগোনা বাড়ছে।
অবশেষে তীরে ভিড়ল নৌকা। কিছু মানুষ ছুটে এলো। দেশত্যাগী মানুষদের তীরে উঠতে হাত বাড়িয়ে দিল। প্রথমদিকে মনে হলো জীবন বাঁচানোর জন্য ছুটে আসা মানুষদের তারা সাহায্য করছে। পরক্ষণে বোঝা গেল তাদের অনেকেই সুযোগ বুঝে মালপত্র-দরকারি জিনিস হাতিয়ে নিচ্ছে।
রক্তে ভেজা কুলসুমের নামতে কষ্ট হচ্ছে। নবজাতকটি মজমা বেগমের বুকে সাঁটানো। অন্য দুজন মহিলা কুলসুমকে নামতে সহযোগিতা করছে। এক স্তন হারানো মহিলাটিও তার বাচ্চা নিয়ে নেমে এলো। তীরে নামা রোহিঙ্গারা জানে না ওরা কোথায় যাবে? কী খাবে?
কুলসুমকে একটি বাড়িতে নিয়ে গেল মজমা বেগম ও অন্য দুই মহিলা। বিষয়টা বুঝিয়ে বলল—কুলসুমের পরিষ্কার হওয়াটা খুব প্রয়োজন। কিন্তু ও বাড়ির কর্তা সম্মতি দিল না। মানবতা হঠাৎ থমকে দাঁড়ায়। মজমা বেগম ও সহযোগী মহিলারা কুলসুমকে নিয়ে কিছুদূরে অন্য এক বাড়িতে একি প্রার্থনা করল। এ বাড়ির বয়স্ক মহিলা সম্মতি দিল। তবে শর্ত জুড়ে দিল—পরিষ্কার হয়েই চলে যেতে হবে। মজমা বেগমরা ওতেই রাজি হয়ে গেল।
কুলসুম শাড়ি পাল্টাতে নলকূপ ঘরে গেল। মজমা বেগম ও সাথী দুমহিলার চেহারা দেখে বয়স্ক গৃহিণীর মায়া হলো। ঘরে থাকা কিছু চিড়া-মুড়ি এনে দিল। ওতেই মজমা বেগমরা বেজায় খুশি। সঙ্গে বাচ্চা কোলে নিয়ে এসে যোগ দিল এক স্তন হারানো সেই মহিলা। বাড়ির দরজার বাইরে মাটির ডায়ালে বসেই মজমা বেগমরা চিড়া-মুড়ি খাচ্ছিল। এই সময় বাড়ির উঠোনে এসে দাঁড়ায় পাড়ার সোমত্ত যুবক এছহাক মিয়া।
আঞ্চলিক ভাষাতেই ডাক দিয়ে বলল, রোহিঙ্গাদের জায়গা দিলেন নাকি খালাম্মা? এছহাক মিয়ার চোখ যায় বাচ্চা কোলে এক স্তন হারানো সেই মহিলার দিকে। ঠিক তখনই নলকূপ ঘরের কপাট খুলে ভেজা চুল এলিয়ে দিয়ে বেরিয়ে আসে কুলসুম। উঠোনে এছহাক মিয়াকে দেখে থমকে দাঁড়ায়। আর কুলসুমকে দেখেই এছহাক মিয়ার চোখে-মুখে ঝিলিক খেলে যায়। কুলসুম চোখ তুলে না তাকালেও মজমা বেগমের চোখ এড়িয়ে যায় না। সঙ্গের মহিলারাও ইতস্তত করতে থাকে।
‘খালা! সমস্যা নেই। ওদেরকে আমি ব্যবস্থা করে দিচ্ছি’— এছহাক মিয়া এ বাড়ির বয়স্ক মহিলাকে উদ্দেশ করেই বলল। মজমা বেগমদের লক্ষ করে বলল—আপনারা কিছু খেয়ে নিন। আমি ব্যবস্থা করে আসি। যাওয়ার বেলায় ফের কুলসুমের দিকে বার কয়েক তাকায়। মজমা বেগমের সঙ্গের মহিলারা সবাই বুঝতে পারে এছহাক মিয়া কেন গায়ে পড়ে উপকার করতে চাইছে। কুলসুমের দাঁড়ানোর শক্তি নেই। খুব ইচ্ছে হচ্ছে দীর্ঘ একটা ঘুম দেবে। কিন্তু কোথায় ঘুমোবে। এখানে কোনো কিছুই যে তার নিজের নয়। আকাশ-বাতাস, মাটি-পানি সবই যে পরদেশী। তবে ভাষার মিল থাকায় কিছুটা রক্ষে। অন্তত কথা বলে নিজেদের সমস্যার কথা বলতে পারছে।
দুপুর গড়াতেই এছহাক মিয়া এসে হাজির হয়। কুলসুমদের নিয়ে একটি তাঁবুতে পুরে। যেখানে অনেক নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোরের পাল। গাদাগাদি করে পোঁটলা-পুঁটলি নিয়ে থাকছে। তারপরও আশ্রয়গ্রহণকারীদের মনে এটুকু সান্ত্বনা—মৃত্যুভয় তো নেই। অন্তত ভিখ মেগে হলেও পেটে কিছু দানাপানি দেওয়া যাবে।
সাদা কাপড়ে পেঁচিয়ে একটি লাশ নিয়ে এগিয়ে আসছে কিছু মানুষ। কাছাকাছি হতেই করম আলীকে চিনতে পারে মজমা বেগম ও অন্যরা। সবাই বুঝে নেয় ফজর আলীর দেহ ধরেছে বাংলাদেশের মাটি। মুখ ফসকেই মজমা বেগম বলে ওঠে—‘হায়রে কপাল কোথায় সারাজীবন কাটাল আর কোথায় মাটি পেল। আল্লাহ তোমার কুদরত বোঝা বড় দায়।’
দিনের পর মাস পেরিয়ে যায়। কুলসুম তার বাচ্চা নিয়ে কিছুটা শক্ত হয়ে ওঠে। মজমা বেগম ত্রাণ জোগাড় করে আনে। ওতেই তাদের চলে যায়। দু-একদিন পরপর এছহাক মিয়া এসে দেখে যেত। কিন্তু আজ এসে যে প্রস্তাব কুলসুমকে দিল তাতে কুলসুমের সারা শরীর কাঁপতে থাকে। ইতোমধ্যে কুলসুম নিজেও অনেক খবর পেয়েছে। স্থানীয়রা রোহিঙ্গা যুবতী মেয়েদের ধরে নিয়ে যায়। কয়েক দিন পর ভগ্নদেহে ফিরে আসে। অনেককে সন্ধ্যায় নিয়ে যায় সকালে ফিরিয়ে দেয়।
আজ সন্ধ্যায় এছহাক মিয়া কুলসুমকে নিয়ে যাবে। তৈরি থাকতে বলে গেছে। মজমা বেগম ও কুলসুম চোখে বাঁচার কোনো পথ খুঁজে পায় না। এছহাক মিয়ার কথা শোনার পর গলা গিয়ে কোনো খাবার নামেনি। অনেকের সঙ্গেই বুঝে দেখে মজমা বেগম। কেউ কোনো পথ বাতলে দিতে পারে না।
কুলসুম একাই সিদ্ধান্ত নেয়। সে পালিয়ে যাবে। সন্ধ্যা হওয়ার আগেই এই তাঁবু ছেড়ে পালাবে। কথাটা মজমা বেগমকেই শুধু জানায়। শাশুড়ি মজমা বেগম অস্থির হয়ে পড়ে। একমাত্র ছেলেকে হারানো ছেলের বউ আর নাতিকে সে হারাতে চায় না। কী করবে বুঝে উঠতে পারে না মজমা বেগম। এখন কুলসুম ছাড়া তাকে দেখারও আর কেউ নেই।
মজমা বেগম দুচোখ বন্ধ করে তার সিদ্ধান্ত জানায় কুলসুমকে। তিনিও কুলসুমের সঙ্গে যাবেন। যা হবার হবে। জীবনের মায়ায় নিজ দেশের ভিটেমাটি ছেড়ে এসেছি। এখন তো আর পিছুটান নেই।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হওয়ার আগেই তাঁবুর কাউকে কিছু না বলে কুলসুম তার এক মাস পেরোনো বাচ্চা আর শাশুড়ি মজমাকে নিয়ে টেকনাফ থেকে চট্টগ্রামগামী বাসে চড়ে বসে। ইতোমধ্যে তারা জেনেছে অনেকেই কাজের সন্ধানে বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়ছে।
বাস চলছে। ঝিমুনি ধরেছে মজমা বেগমকে। বাস ব্রেক কষলেই মাথা ঝুঁকে পড়ছে সামনের দিকটায়। উদ্দেশ্যহীন যাত্রায় মজমা বেগম ভাবছে জীবন বাঁচাতে দেশ ছাড়ল। এখন সম্ভ্রম বাঁচাতে কোথায় যাবে? কোথায় হবে বাকি জীবনের ঠিকানা? তার কবরটিও কি ফজর আলীর মতো নিজ দেশের মাটিতে হবে না? মানুষই তো মানুষের শত্রু। মানুষ নিজের স্বার্থেই অন্য মানুষের ক্ষতি করে। মিয়ানমার থেকে যারা তাদের তাড়িয়েছে, তারাও মানুষ। আর যারা এখানে সম্ভ্রম ছিনিয়ে নিতে চায়, তারাও মানুষ। মজমা বেগমের মনে হাজারো ভাবনা চলমান বাসের জানালা দিয়ে উঁকি দেয় আর হাওয়ায় মিলিয়ে যায়।