উপন্যাস লেখার সময়সীমা
- আমি এ উপন্যাসটা ১০ বছর ধরে ভাবছি আর সাত বছর ধরে লেখা শুরু করেছি।
- ধুর মিয়া, অত টাইম আমার নাই, আমি তো একমাসে লিখছি আমার এই বইমেলা উপন্যাস।
- এক মাসে তো একটা উপন্যাসের প্লট কিংবা চরিত্র নির্মাণই শেষ হয় না।
- ১০ বছর তো একটা ডাইনোসর প্রসব করতেও লাগে না।
ওপরের কথাগুলো দুজন ঔপন্যাসিকের কাল্পনিক সংলাপ।
ভিক্টর হুগো লা মিজারেবল লিখেছিলেন ১২ বছর ধরে। জেআরআর, টলকিন তার ‘লর্ড অব দ্য রিঙস’ ট্রিলোজি শেষ করেছেন ১৬ বছরে। ট্রিলোজি মানে তিনটা উপন্যাস। জেকে রাউলিং তার বিশ্বখ্যাত ‘হ্যারি পটার এ- দ্য ফিলোসফারস স্টোন’ লিখতে সময় নিয়েছের ছয় বছর। মার্গারেট মিচেল তার ঢাউস উপন্যাস ‘গন উইথ দ্য উইন্ড’ লিখেছেন ১০ বছরে। অন্যদিকে উইলিয়াম গোল্ডিং ‘লর্ড অব দ্য ফ্লাইস’ লিখেছেন পাঁচ বছরে। এটুকু পড়ে আপনারা ধরেই নিতে পারেন, ভালো একটা উপন্যাস লিখতে কয়েক বছর লেগে যায়। কিন্তু এমন ধরে নেওয়াটা বোকামি হবে। রবার্ট লুই স্টিভেনসনের ‘দ্য ড জেকিল এ- মি হাইড’ লেখা হয়েছে ছয়দিনে। আপনি ঠিক পড়েছেন, বিশ্বখ্যাত এই ধ্রুপদী উপন্যাস তিনি বছর বা মাস নয়, ছয়দিনে লিখেছেন। এরচেয়েও কম সময়ে উপন্যাস লেখার রেকর্ড আছে।
জন বয়েনের আধুনিক ধ্রুপদী উপন্যাস ‘দ্য বয় ইন দ্য স্ট্রাইপড পাজামাস’ লেখা হয়েছে আড়াই দিনে। বয়েন এতটাই উদ্দীপ্ত আর নিবিষ্ট ছিলেন যে টানা লিখে গেছেন। খাওয়া, ঘুম বাদ দিয়েই টানা লিখে গেছেন তিনি। নিউইয়র্ক টাইমসের বেস্ট সেলার তালিকার এই উপন্যাস চলচ্চিত্র হিসেবে সাড়া জাগিয়েছিল। মাইকেল স্পিলেনের সাড়া জাগানো উপন্যাস ‘দ্য জুরি’। এটিও চলচ্চিত্র হয়েছে। এখন পর্যন্ত এ উপন্যাসের ৭০ লাখ কপি বিক্রি হয়েছে। স্পিলেন এই উপন্যাসটি লিখেছেন সাতদিনে।
এন্থনি বার্জেসের ‘আ ক্লওয়ার্ক অরেঞ্জ’ উপন্যাসটি এখন নীলক্ষেতের ফুটপাথে পাওয়া যায়। এই উপন্যাস না-পড়লেও এর কাহিনী নিয়ে একই শিরোনামে স্ট্যানলি কুব্রিকের বানানো চলচ্চিত্রটি নিশ্চয়ই অনেকেই দেখেছেন। ‘আ ক্লওয়ার্ক অরেঞ্জ’ লেখা হয়েছে দেড় মাসে। শার্লক হোমস খ্যাত স্যার আর্থার কোনান ডয়েল তার বিখ্যাত উপন্যাস ‘আ স্টাডি ইন স্কারলেট’ও লিখেছেন দেড় মাসে। উল্লেখ করা দরকার, এই উপন্যাসেই শার্লস হোমস চরিত্রের যাত্রা শুরু হয়। চার্লস ডিকেন্স অবশ্য এর দ্বিগুণ সময় নিয়েছেন ‘আ ক্রিসমাস ক্যারল’ উপন্যাস লিখতে। উইলিয়াম ফকনারও একদম তিন মাস সময় নিয়েছেন তার ‘এজ আ লাই ডায়িং’ উপন্যাস লিখতে। শুধু তাই নয়, ফকনার দাবি করেছেন তিনি যা লিখেছেন তাই ছেপেছেন, এই উপন্যাসের একটি অক্ষরও তিনি বদলাননি। ইয়ান ফ্লেমিংয়ের বিখ্যাত চরিত্র জেমস বন্ড। তার বই না-পড়লেও জেমস বন্ড সিরিজের চলচ্চিত্রগুলো কম বেশি সবাই দেখেছি। সিরিজের প্রথম উপন্যাস ‘ক্যাসিনো রয়াল’ লেখা হয়েছে মাত্র দুই মাসে। সিরিজের বাকী উপন্যাসগুলো অবশ্য আরো কম সময়ে লেখা, দেড় মাসে।
আধুনিক উপন্যাসের অন্যতম কারিগর ফিওদর দস্তয়ভস্কি। তার ‘ক্রাইম অ্যান্ড পানিশম্যান্ট’কে বিশ্বের সেরা একটি উপন্যাস বলা হয়। যখন এই উপন্যাস লিখছিলেন তখন তিনি ধার-কর্জে ডুবে আছেন। দায়দেনা থেকে বাঁচতে তিনি এই সময় ‘গ্যাম্বলিং’ নামের আত্ম-চরিতমূলক উপন্যাস লেখেন। ‘গ্যাম্বলিং’ লিখতে তার লেগেছিল ২৬ দিন। উল্লেখ্য সে সময় দস্তয়ভস্কি নিজে জুয়া ও মদ্যপানের কারণে আর্থিক সংকটে ভুগছিলেন।
গ্রাহাম গ্রিনও টাকার জন্য মাত্র দেড় মাসে শেষ করেছিলেন তার ‘দ্য কনফিডেন্সিয়াল এজেন্ট’ উপন্যাসটি। ‘দ্য পাওয়ার এ- দ্য গ্লোরি’ উপন্যাস লেখার পাশাপাশি তিনি ‘দ্য কনফিডেন্সিয়াল এজেন্ট’ উপন্যাসটি লেখেন।
এখানে সেই সব উপন্যাসের কথাই বলা হলো, যেগুলো ইতিমধ্যেই বিশ্ববিখ্যাত এবং যেগুলোর সাহিত্যমান নিয়ে কোনো প্রশ্নই নেই। এমন অনেক ‘ওয়েস্টার্ন’, ‘রোমান্স’ ও ‘পাল্প ফিকশন’ ঘরানার উপন্যাস আছে যে সাত দিনের কম সময়ে লেখা হয়। সেগুলো বাণিজ্যিকভাবেই প্রতি সপ্তাহে সিরিজ আকারে প্রকাশ করা হয়। যদিও এই ঘরাণায় অনেক জনপ্রিয় উপন্যাস আছে। কিন্তু আমি সেগুলোকে আলোচনায় আনিনি।
নামে বা আকারে উপন্যাস হলেই তো উপন্যাস হয় না। উপন্যাসের গুণগত বৈশিষ্ট্য অক্ষুণ্ণ রেখেই উল্লেখিত উপন্যাসগুলো লেখা হয়েছে এবং সমালোচক-পাঠক মহলে আদৃত হয়েছে।
তবে শেষে একটি কথা বলতে চাই। একটি দালান এক মাসে তৈরি করা সম্ভব। আবার সেই দালানটি তৈরি করতে সাত বছরও লাগতে পারে। এটা বিবেচ্য নয় দালানটি কত সময়ে তৈরি হলো। বরং বিবেচ্য হবে দালানটি কতটা মজবুত এবং নান্দনিক হলো। উপন্যাসের ক্ষেত্রে এ কথা বলতে পারি— কম সময়, বেশি সময় বলে কিছু নেই। যে লেখক যতটুকু সময়ে লিখতে পারেন তিনি ততটুকু সময়েই লিখবেন। যেহেতু উপন্যাস প্রকাশের সময় বলে দেওয়া হয় না, কত দিন বা বছর ধরে এটি লেখা হয়েছে, সেহেতু সেই আলোচনাটি গুরুত্বপূর্ণ নয়। গুরুত্বপূর্ণ হলো, একটি উপন্যাস লেখা। আর এটিতে বোধহয় বোঝানো গেছে যে, উপন্যাস লিখতে আড়াই দিন থেকে ১২ বছরও লেগে যেতে পারে।