ফিরতি পথে
নিম্মি ও সজীবের জীবনপথ একটা জায়গায় এসে থেমে গেছে। একেবারে হেমন্তবাবুর গানের মতো দশা আজ দুজনার দুটি পথ, ওগো দুটি দিকে গেছে বেঁকে... ওরা যেন একটা পথে চলতে চলতে এখন দুই দিকে বাঁক নেওয়ার জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত। অথচ এমনটা হওয়ার কথা ছিল না। ওদের দুজনের উন্মাতাল প্রেম দেখে কারই বা হিংসে হতো না! সেই কলেজ জীবনে যার শুরু। তারপর এই শহরে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনায় প্রেমাবেশে ওদের বেড়ে ওঠা। যে দেখত সেই বলত এক্কেবারে পারফেক্ট জুটি। কিন্তু হঠাৎ বিয়ের দুই বছরের মাথায় ওদের সম্পর্কের ভেতরে এতটা তিক্ততা চলে আসবে, এটা সবার কাছেই অবিশ্বাস্য ছিল। যে-ই শোনে সে-ই অবাক হয়। না কথাটা সত্যি, নিম্মি ও সজীবের ডিভোর্সটা খুব দ্রুতই হতে যাচ্ছে! তাদের পরিবার-পরিজন, আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব অনেকেই এখন বিষয়টা জানে। বলা যেতে পারে কে না জানে? ইন্টারনেট আর সোশ্যাল মিডিয়ায় তারা এতটাই সচল যে ইনবক্সে কথা চালাচালি থেকে নানাভাবেই এই খবর এখন ছড়িয়ে গেছে। অবশ্য অনেকেরই এতে আবার খুব একটা কিছু আসে-যায় না। এই তো সেদিন পত্রিকায় খবর বেরোলো, ঢাকা শহরে প্রতি দেড় ঘণ্টায় নাকি একটি সংসার ভাঙে! তাই ওদের জন্যও এটা এখন শুধুই একটা সময়ের ব্যাপার মাত্র। সেটা না বলে আসলে এভাবে বললে আরো ভালো হয়, দুজনের দুটো সইয়ের ব্যাপার মাত্র। কিন্তু এমনটা হলো কীভাবে?
সজীব নিম্মির চেয়ে মাত্র দুই বছরের বড়। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ শেষ করতেই একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি পেয়ে গেল। এর পেছনে অবশ্য নিম্মির চাপাচাপিও বিশেষ ভূমিকা রেখেছিল। নিম্মিও বেশ ক্যারিয়ারিস্ট। বিবিএ শেষ করতেই একটা প্রাইভেট ব্যাংকে চাকরি হয়ে গেল। রেজাল্টও ভালো ছিল। তার ওপর দেখতেও একেবারে যেন ডানাকাটা পরী। প্রাইভেট কোম্পানিতে ছেলেমেয়ে উভয়ের সৌন্দর্যই চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে একটা প্লাস পয়েন্ট। কেউ বলুক আর না বলুক, এটা যাদের থাকে তারা চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে একটু এগিয়ে থাকে। দুজনই চাকরিতে ঢুকল ছয় মাসের ব্যবধানে। তারপর দুই পরিবারের সম্মতিতে একেবারে ঢাকঢোল পিটিয়ে বিয়ে হলো। তারপর ধানমণ্ডিতে আলাদা ফ্ল্যাটে শুরু হলো তাদের নতুন জীবন। শুরুটা বেশ ভালোই ছিল। কিন্তু গত এক বছরে তাদের সম্পর্কটা একেবারে করলার মতো তেতো হয়ে উঠেছে। কেউ কাউকে সহ্য করতে পারছে না।
এই তো সেদিন সজীব বাসায় ফিরল রাত একটার দিকে। নিম্মি দরজা খুলতেই ক্লান্ত-শ্রান্ত দেহে সোফায় নিজের শরীরটা এলিয়ে দিল সজীব। নিম্মির প্রথম বাক্য—কয়েক ঘণ্টা পর তো ভোরই হবে। বাসায় না আসলেই পারতে।
সজীব জবাবে বলল, তোমার কি মনে হয়, আমি এমনি এমনি বাইরে হাওয়া খেয়েছি?
—খেতেও পারো। অস্বাভাবিক তো নয়। যখন প্রেম করতে তখন তো হাওয়া খেয়েই ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিতে। এখন হয়তো অফিসের অন্য কোনো নারী কলিগের সঙ্গে খাচ্ছ।
—দেখো নিম্মি, বাজে কথা বলবে না। তুমি জানো মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে কাজের কত চাপ। আমি সিনিয়র এক্সিকিউটিভ। চাইলেই অফিস থেকে বেরিয়ে আসতে পারি না। সব কাজ বুঝিয়ে দিয়ে তারপর অফিস থেকে বেরোতে হয়। তার ওপর ঢাকার রাস্তার জ্যাম। দিনরাত বলে কোনো কথা নেই। দিনেও যা রাতেও তা..
—তা এখন কি কিছু খাবে, না খাবারও খেয়ে এসেছ ?
—তুমি জানো, আমি খিদে সহ্য করতে পারি না। অনেকে আগেই অফিসের পাশের রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার আনিয়ে নিয়ে খেয়েছি।
—সবই যদি বাইরে করবে তাহলে বাসায় এসেছ কী করতে? আমি তো ঠিকই এখনো না খেয়ে বসে আছি।
—তোমাকে কতবার বলেছি আমার এসব আদিখ্যেতা ভালো লাগে না। এটা ২০১৯ সাল। কাম-অন গ্রো আপ! কতবার বলেছি আমার দেরি হলে খেয়ে নেবে।
—অথচ এই তুমি ইউনিভার্সিটিতে আমার সঙ্গে একসঙ্গে খাবে বলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে। আমিও কম ক্যারিয়ারিস্ট নই। অফিসে অনেক কাজ আমাকেও সামাল দিতে হয়। জুনিয়র এক্সিকিউটিভ হিসেবে ওপরের চাপ সহ্য করতে হয়। ক্যারিয়ার প্ল্যান নিয়ে ভাবতে হয়। তারপর তো আমি বাসায় এসে নিজে রান্না করি। তোমার সঙ্গে খাব বলে অপেক্ষা করি।
—তুমি শুধু-শুধু ঝগড়া করছ। আমার আর এসব ভালো লাগে না।
সজীব ফেসবুকে কী একটা স্ট্যাটাস দিয়ে সোফার ওপরেই চোখ বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়ল। আর নিম্মি ততক্ষণে চোখের পানিতে গড়াড়াড়ি খাচ্ছে। একটু পর সজীবের নাক ডাকার শব্দ শুনতে পেল। রাগে-দুঃখে নিম্মি হাতের কাছে থাকা কুসনটা সজোরে সজীবের দিকে ছুড়ে মারল। সজীব টেরও পেল না; আধমরার মতো সে ঘুমাচ্ছে।
২.
সজীবের অফিসে কাজের চাপ যেদিন কম থাকে সেদিন নিম্মির ব্যস্ততা তুঙ্গে। এটা এখন বেশ নিয়মিত একটা ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে এরকম দিনে সজীব বাসায় ফিরে যতবারই রোমাঞ্চিত রাতের স্বপ্ন সাজিয়েছে, ততদিনই তা ভেস্তে গেছে। যদিও এমন ভাব এখন ওর খুব কমই আসে। আজও সে নিম্মির সঙ্গে একটা রোমাঞ্চকর রাতের স্বপ্নে বিভোর। কিন্তু কর্মক্লান্ত নিম্মি বাসায় এসে চারটা খেয়েই শুয়ে পড়ল বিছানায়।
সজীব বেশ রোমান্টিক গলায় বলে, এই ঘুমিয়ে পড়েছ?
নিম্মি উত্তর দেয়, ঘুম না এলেও ঘুমিয়ে পড়ব। সারাদিন অফিসে অনেক ধকল গেছে।
সজীব নিম্মির গালে আদর দিয়ে বলে, এসো, কাছে এসো।
নিম্মি বেশ বিরক্তি নিয়ে তার শরীরে থাকা সজীবের হাতটা সরিয়ে দিয়ে বলে, একটুও কাছে আসবে না তুমি আমার। আমার এখন কিছুই ভালো লাগছে না। শুধু ঘুমাতে ইচ্ছে করছে। কাল সকালে আবার ছুটতে হবে অফিসের দিকে। তার ওপর আবার ক্লোজিংয়ের কত কাজ। সরো তো, দেখি একটু ফেসবুকটা ঘুরে আসি। আজ সারা দিনে একবারও ঢুঁ মারতে পারিনি।
সজীব বুঝতে পারল তার আজকের চেষ্টাও ভেস্তে গেছে। সে মোবাইল ফোনের ফাঁকে হেডফোনটা গুঁজে দিয়ে আজেবাজে সব সাইটে ঘুরতে লাগল।
শুক্র ও শনিবার নিম্মি সজীব দুজনেরই বন্ধের দিন। আগে এই দিনগুলোতে ওরা ঢাকার অদূরে নানা জায়গায় ঘুরতে যেত। তখন প্রতিটি শুক্র ও শনিবারই ছিল তাদের জন্য মধুচন্দ্রিমা। এমনও তো হতো যে জমানো টাকা ভাঙিয়ে দুজনে দুদিনের জন্য ছুটে যেত কক্সবাজারে। সেখানে সৈকতের পাশে একটা হোটেলে রুম ভাড়া নিয়ে কত আনন্দের দিন কেটেছে তাদের। রাতে সমুদ্রের গর্জন আর তারাভরা আকাশ দেখতে দেখতে মধুর স্বপ্ন বুনেছে। রঙিন সেসব দিনগুলো এখন তাদের কাছে সুখস্মৃতি ছাড়া আর কিছু নয়।
আদতে দুজনের মধ্যে রোমান্টিকতার ঘাটতি থাকলেও নিম্মির উঁচুগলার বড় অভিযোগ, সজীব একেবারে আনরোমান্টিক একটা ছেলে। প্রয়োজন ছাড়া এখন তার সঙ্গে কথাও বলে না, সময়ও কাটায় না। কথা বলতে গেলে প্রতি দুই বাক্য পরপরই নিয়ে আসে হয় ক্যারিয়ার নয়তো অফিসের গল্প। কাজ আর কাজে ও এতটাই ডুবে গেছে যে গত বিবাহবার্ষিকীর দিনেও সে বাসায় ফিরেছে রাত এগারোটায়।
আর সজীবের অভিযোগ, নিম্মি ইদানীং খুব বাজে ব্যবহার করে। মাঝেমধ্যে গালিগালাজ পর্যন্ত দেয়। সেদিনও নাকি ওকে শুয়োরের বাচ্চা বলে গালি দিয়েছে! কথায় মিষ্টি নেই। আর কথা বলতে গেলেই শুধু চাল, ডাল, পেঁয়াজ, লবণ, আটাময়দা এসব নিয়ে আসে। ফোন করে শুধু বাসায়—এটা নেই, এটা নিয়ে এসো, ওটা নেই, ওটা নিয়ে এসো ইত্যাদি।
তবে বিষয়টা ডিভোর্স পর্যন্ত গড়াত না যদি সজীব সেদিন নিম্মির গায়ে হাত না তুলত। কথাকাটাকাটির একপর্যায়ে সজীব উত্তেজিত হয়ে নিম্মির গালে একটা চড় বসিয়ে দেয়। তারপর থেকে নিম্মি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয় সজীবের সঙ্গে আর সংসার করবে না। করবে না তো করবে না। এদিকে সজীব গায়ে হাত তোলার ব্যাপারে কিছুটা অনুতপ্ত হলেও সামগ্রিকভাবে নিম্মিকে নিয়ে সে নিজেও বিরক্ত। সে-ও আর সংসার করতে আগ্রহী নয়।
৩.
সজীব ও নিম্মির ডিভোর্সের কাগজপত্র অনেকটাই প্রস্তুত। এক ছাদের নিচে থেকেও তারা দুজন দুই ঘরে বাস করছে। এরই মধ্যে ওদের কাছে একটা অন্যরকম দাওয়াত এলো। রুম্মান ও মিফতা ওদের দুজনেরই খুব কাছের বন্ধু। তাদের বিবাহবার্ষিকীর তৃতীয় বছর পূর্তি উপলক্ষে এক বিশেষ আয়োজন করা হয়েছে। বিবাহবার্ষিকীর মূল আয়োজনটা হবে রাঙামাটিতে। যার শুরুটা হবে সেখানকার সাজেক ভ্যালিতে দুজনের আরেকবার মালাবদলের মধ্য দিয়ে। সজীব ও নিম্মির যাওয়া নিশ্চিত করতে ওদের বাসা পর্যন্ত ছুটে এসেছে রুম্মান ও মিফতা। ছুটি পাওয়া সাপেক্ষে ওদের দুজনকেই শেষ পর্যন্ত রাজি করাতে সক্ষম হলো যে তাদের বন্ধুদের মধ্যে পাঁচ জুটি একসঙ্গে রাঙামাটি যাচ্ছে। শুক্র ও শনি দুজনের ছুটির সঙ্গে আরো তিন দিনের ছুটি যুক্ত করে দিয়ে মোট পাঁচ দিনের ছুটিতে সজীব ও নিম্মি একসঙ্গে ছুটল বন্ধুদের সঙ্গে রাঙামাটিতে। বাসে উঠে মনে না চাইলেও অনেকটা লোকলজ্জার ভয়েই পাশাপাশি বসল নিম্মি আর সজীব। এসি বাস চলছে আর একটা গান বাজছে কিশোর কুমারের, ‘আমি যে কে তোমার তুমি তা বুঝে নাও।’ গান চলার একটা পর্যায়ে নিজেদের অজান্তেই নিম্মি ও সজীব একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে হেসে দিল। অনেকদিন পর এমনটা ঘটল। কিছু বুঝে ওঠার আগেই দুজন বলে উঠল—এখনো বাসে এই গান বাজে!
রাঙামাটির কাছাকাছি আসতেই সবুজ পাহাড় আর বনানীর শুভ্রতা দেখে সবাই ‘ওয়াও’ করে উঠল। বন্ধুদের সবাই দেখল নিম্মি সজীবের কাঁধে মাথা রেখে ঘুমোচ্ছে। সজীব কপালে আলতো একটা টোকা দিতেই নিম্মি বলে বসল—ছোঁবে না আমাকে।
সজীব উত্তর দেয়, বা রে, কে কাকে ছোঁয়? এতক্ষণ আমার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমালে, তার কী হবে? নিম্মি ‘সরি’ বলে অন্য দিকে তাকায়।
রাঙামাটি শহরেই একটি রিসোর্টে উঠল ওরা সবাই। রাতটা বিশ্রাম নিয়েই কাটাল। পরের দিন সকাল থেকেই শুরু হবে সাজেক ভ্যালিতে সব আনুষ্ঠানিকতা।
সকালে সাজেকের উদ্দেশে রওনা দিল একসঙ্গে। আগে থেকেই অনেক কিছু ঠিকঠাক করা আছে। রুম্মানের এক বন্ধুর মাধ্যমে তারা রাতের সাজেক উপভোগ করার সকল বন্দোবস্তও করে রেখেছে। সাজেকে এসে সবাই দেখল মেঘ, পাহাড় আর সবুজের মিতালি ছড়িয়ে আছে চারধারে। সকালের শুরুতেই বিবাহবার্ষিকী উদযাপনের কার্যক্রম শুরু হলো রুম্মান আর মিফতার মালাবদলের মধ্য দিয়ে। সাজেকে দিনের শুরুতেই একটু গরম, তারপর হঠাৎ বৃষ্টি দেখে সবাই মোহিত হলো। একটু পর চারদিক ঢেকে গেল মেঘের চাদরে। মনে হলো যেন একটা মেঘের উপত্যকা। হঠাৎ নিজের অজান্তেই সজীব চিৎকার দিয়ে বলল, নিম্মি, ওই যে দ্যাখো সেই মেঘগুলো। আমার কাছে এসো, হাত ধরো। দুজনে মিলে আমরা মেঘ ধরব সেদিনের মতো। সবাই সজীবের দিকে তাকিয়ে রইল। আর অনতিদূরে দাঁড়িয়ে থাকা নিম্মি একটু লজ্জা পেয়ে আরো দূরে গিয়ে দাঁড়াল।
সবাই সজীবকে জিজ্ঞেস করল, কী রে তোরা এর আগেও এখানে এসেছিস?
সজীব উত্তর দেয়, ইয়ে মানে মানে হ্যাঁ।
—কবে, জানলাম না তো!
সজীব বলে, আমাদের বিয়ের তিন বছর আগে একটা স্ট্যাডি ট্যুরের কথা বলে আমরা দুজনেই এসেছিলাম। এই মেঘেদের দেখতে দেখতেই ৩০ সেকেন্ডের একটা চুমু দিয়েছিলাম নিম্মিকে।
দূরে দাঁড়িয়ে সব শুনছিল নিম্মি। এবার ও বলতে শুরু করল, হ্যাঁ বলো বলো আর কী কী করেছিলে সব বলো... একটা ঢোল এনে দিই, পেটাতে-পেটাতে সব বলো... অসভ্য কোথাকার...
সজীব এবার এক দৌড়ে নিম্মির কাছে গেল। নিম্মিকে জড়িয়ে ধরল। অবাক করে দিয়ে এবার নিম্মিও জড়িয়ে ধরল সজীবকে। আর তাদের চারপাশে ঘিরে রইল বন্ধু-যুগলরা। রুম্মান বলল, কী রে খাবি নাকি এবার আরেকটা চুমু? তবে আগের রেকর্ড ভাঙতে হবে কিন্তু। সজীব বলল, অবশ্যই। নিম্মিকে জড়িয়ে ধরে ওর ঠোঁটে চুমু খেল, এবার তারা আগের চেয়েও দীর্ঘ সময়ের চুমু উপভোগ করল। তারপর দুজন দুজনকে বলল, ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি।’
বাকি দিনগুলোতে ওরা সবাই মিলে পুরো রাঙামাটি ঘুরে বেড়াল। সজীব ও নিম্মি এর আগেও এসেছে বলে ওরা অনেক জায়গাই চেনে। পাহাড়ের আঁকাবাঁকা পথে তারা ঘুরে বেড়াল। খোলা আকাশ আর সবুজের মধ্যে সবাই নিজেদেরকে নতুন করে আবিষ্কার করল। শহরের কৃত্রিমতা আর ছুটন্ত জীবন ভুলে ওদের কাছে ধরা দিল অখণ্ড অবসর আর মন্থর দিন। সজীব আর নিম্মির জন্য এ যেন জীবনকে নতুন করে ফিরে পাওয়া। ওরা একসঙ্গে গাইছে, হাত ধরে হাঁটছে, পাহাড়ি নদীতে ভেসে বেড়াচ্ছে, এক টিলা থেকে অন্য টিলায় যাচ্ছে; কাছ থেকে দেখছে পাহাড়ি মানুষের জীবন। তার সঙ্গেও মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে।
সেখানকার পাহাড়িদের গ্রামগুলো ঘুরে ওরা সবাই তাদের নানা অনুষ্ঠানে অংশও নিল। গায়ে জড়াল পাহাড়ি পোশাক। তাদের বৈচিত্র্যময় নানা খাবার উপভোগ করতেও ভুল হলো না। প্রায় প্রতি রাতেই ফায়ার ক্যাম্পের আয়োজন ছিল। যেখানে সবাই মিলে নাচেগানে মেতে উঠত। চষে বেড়াল পুরো রাঙামাটি। কংলাক আর মিজোরাম সীমান্ত পর্যন্ত ঘুরে তারপরই ক্ষান্ত হলো সবাই।
৪.
সাজেক থেকে কয়েকদিন আগেই বাসায় ফিরেছে নিম্মি আর সজীব। দুজনই আগের মতো অফিস করছে। তবে এবার কিছুটা পরিবর্তন লক্ষ করা গেল। দুজনই বাসায় তাড়াতাড়ি আসার চেষ্টা করে। একজন আরেকজনকে সময়ও দিচ্ছে, একসঙ্গে নাশতার টেবিলে বসছে, টিভি দেখছে।
একদিন নিম্মি একটু দেরি করে বাসায় ফিরল। তার বাসায় ফেরার কিছুক্ষণ আগেই সজীব ফিরেছে। নিম্মি ঘরে ফিরে মুখ-হাত ধুয়ে রাতের খাবার তৈরি করল। ডাইনিং টেবিলে খেতে খেতে নিম্মি হাসি মুখে বলল, তোমার জন্য দুটো খবর আছে। একটা ভালো, একটা মন্দ। কোনটা আগে শুনবে বলো।
সজীব বলল, আগে খারাপটা দিয়েই শুরু করো। সেটা আগে শুনে নেওয়াটাই ভালো।
—আমি চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছি।
—কী বলছ তুমি, নিম্মি? তোমার ক্যারিয়ার?
—চাকরি করেই ক্যারিয়ার গড়তে হবে এমন তো কথা নেই।
—তাহলে কী করতে চাও?
—আমার কিছু জমানো টাকা আছে। পাশাপাশি বাবাও কিছু টাকা দেবে বলেছে। আমি একটা বুটিক হাউস দিতে চাই। নিজের মতো করে কাজ করব।
—আর ভালো খবরটা কী?
—তুমি বাবা হতে চলেছ।
—কী বলছ তুমি, আমি বাবা হতে যাচ্ছি! ইয়ে... আমি এক্ষুণি সবাইকে জানাচ্ছি। ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিচ্ছি। সবাইকে জানাতে হবে...
—রাখো রাখো। সবটাই যদি মানুষকে সবার আগে জানিয়ে দিই তাহলে নিজেদের আর কী থাকে! তুমি এখন ফেসবুকে কিছুই লিখবে না।
—ওকে থামলাম, তুমি এত বড় একটা খুশির সংবাদ দিলে আমিও তোমাকে একটা খুশির সংবাদ দিতে চাই।
—কি তুমিও চাকরি ছেড়ে দিয়েছ নাকি?
—না, আসলে আমি ফেসবুক, ইন্টারনেট, সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেক সময় কাটাই। কিছু না লিখলে মনে হয় কী যেন আজ করলাম না। এই করে করে সময় যেত আর অফিসের কাজ শেষ করতেও দেরি হতো। তবে এটাও ঠিক কাজের চাপ আর জ্যামের সমস্যাও আছে। আমি অ্যানড্রয়েড মোবাইলের পাশাপাশি একটা সাধারণ মোবাইল ফোন কিনেছি শুধু কথা বলার জন্য। অ্যানড্রয়েডটা ব্যবহারের আজকেই শেষ দিন। মোবাইলটা দিয়ে শেষ একটা স্ট্যাটাস দিই না!
—না দেবে না। এই শেষ কখনোই শেষ হবে না। আজ তোমার ধৈর্যের পরীক্ষা হবে। ফেসবুক যখন ছিল না তখন কি আমরা একজন আরেকজনের খবর পাইনি? কল করে একজন আরেকজনের খবর নিইনি? তারও আগে ল্যান্ডফোন, চিঠির যুগেও কি কোনোটা বন্ধ ছিল?
—ছিল না। তবে গতি কম ছিল।
—হোক না একটু গতিহীন গতির জীবন। এই ধীর যৌথ জীবনই তো আমি চাইছি। তুমি কি তা চাও না?
সজীবের হৃদয়ে যেন অন্যরকম প্রশান্তির হাওয়া বয়ে যায়, নিম্মিকে বাহুবন্দি করে নরম স্বরে বলে, কেন নয়?