ঢাকার কথা ১৫
পুরান ঢাকার বিয়ে অনুষ্ঠান
ঐতিহ্যগত দিক থেকেই পুরান ঢাকার মানুষ অনন্দ প্রিয়। যেকোনো উপলক্ষে আনন্দ অনুষ্ঠানে মেতে উঠতে পছন্দ করত। পুরান ঢাকার এ ধরণের সরস চিত্রের খোঁজ পাওয়া যায় উনিশ ও বিশ শতকের নানা সূত্রে। ঢাকাবাসীর আনন্দ অনুষ্ঠানের একটি বড় জায়গাজুড়ে রয়েছে বিয়ে উৎসব। এই গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক অনুষ্ঠানটি অত্যন্ত জাঁকালোভাবে উদযাপন করতে পছন্দ করত ঢাকার মানুষ।
বিয়ের নানা আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়ে যেত অনেকদিন আগে থেকেই। বরপক্ষ কনের বাড়িতে এসে যেদিন আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ের প্রস্তাব দিত সেদিন থেকেই মূলত বিয়ের উৎসব শুরু হয়ে যেত। এটি ‘পান-চিনির’ অনুষ্ঠান নামে পরিচিত ছিল। সেকালে পারিবারিক পছন্দে ও আয়োজনেই বেশির ভাগ বিয়ে সম্পন্ন হতো। এ ক্ষেত্রে ঘটকের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। পাত্রপাত্রীর খোঁজ থেকে শুরু করে বিয়ে সম্পন্ন করা পর্যন্ত ঘটকের উপস্থিতি ও মধ্যস্থতা ছিল অপরিহার্য। ঢাকাইয়া ভাষায় ঘটককে বলা হয় ‘মোতাসা’। এঁরা ছিলেন পেশাজীবী ঘটক। পান-চিনি বা পাকা কথার অনুষ্ঠানে বর-কনে উভয় পক্ষের কিছু প্রস্তুতি থাকত। বরপক্ষের যারা কনের বাড়িতে যেতেন তাঁরা সাথে করে নিয়ে যেতেন নানা ধরনের মিষ্টি এবং পান-সুপারি। এর পরিমাণ সাধ্য অনুযায়ী হতো। তবে বেশি নেওয়ার সাথে একটি আভিজাত্যের প্রশ্ন ছিল। এরও কারণ আছে। পান-চিনি অনুষ্ঠান শেষে কনেপক্ষ তাদের আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে সেসব মিষ্টি ও পান-সুপারি পাঠিয়ে বিয়ের পাকা কথার সংবাদ জানাত। পান-চিনি অনুষ্ঠানে বর নিজে আসতে পরত না। কনে পক্ষ এদিন বর পক্ষের অতিথিদের নানা পদে বিশেষ আপ্যায়নের আয়োজন করত।
ঢাকার বিয়েতে সাধ্যাতিরিক্ত দান সামগ্রী বরের বাড়িতে পাঠানো আভিজাত্যের লক্ষণ ছিল। এখানে কিছুটা লোক দেখানোর বিষয়ও ছিল। দান সামগ্রী কুলির মাথায় সদর রাস্তা দিয়ে মিছিল করে পাঠানো হতো। তবে উচ্চবিত্ত সমাজেই এমন প্রচলন বেশি লক্ষ করা যেত।
বর্তমান নাগরিক সমাজে নানা বাস্তবতায় ‘নাইওর’ প্রথাটি এখন প্রায় হারিয়ে যাচ্ছে। এককালে ঢাকার বিয়েতে বিয়ে অনুষ্ঠানের অনেক আগে থেকে নিকটাত্মীয় নাইওরিরা এসে জমজমাট করে ফেলত বিয়েবাড়ি। মেয়েরা গোল হয়ে বসে বিয়ের গীত গাইত। সে যুগেও বিয়ের আগে গায়ে হলুদ একটি জমজমাট আনন্দ অনুষ্ঠান ছিল। ঢাকার বিয়েতে দুই-তিনদিন ধরে বর-কনের গায়ে হলুদ চলত। ঢাকাবাসী সাধারণত এই আয়োজনকে ‘তেলাই’ বলে থাকে। আধুনিক সময়ে তেলাই নামটি প্রায় অপরিচিত হয়ে উঠছে। গায়ে হলুদ অনুষ্ঠানের জন্য বর পক্ষ কনের বাড়িতে মিষ্টি, মাছ এবং কাপড়সহ হলুদের প্রয়োজনে ব্যবহৃত নানা দ্রব্য সামগ্রী নিয়ে যেত। যত কিছুই নেওয়া হোক না কেন, দই এবং বড় আকারের দুটো মাছ নেওয়া ছিল আবশ্যক। মাছের একটি হতো বর আর অন্যটি হতো কনের প্রতীক। মাছ দুটোকে সাজানো হতো সেভাবেই। এই মাছ যে কুটবে তার জন্য মজা করে উপহার দেওয়া হতো। মাছের মুখের ভেতর গুজে দেওয়া হতো টাকা। মাছ কুটতে গেলে সেই টাকা বেরিয়ে আসত। নাইওর আসা মেয়েরা উৎসাহের সাথে মাছ কাটা, হলুদ বাটায় অংশ নিত। শুধু বর-কনে নয়- হলুদ মাখামাখি ও রং ছিটানোতে আত্মীয়স্বজনরাও অংশ নিত।
সেকালে বিয়েবাড়ির সাজসজ্জায় কোনো প্রতিষ্ঠান বা ডেকোরেটরের প্রয়োজন ছিল না। আত্মীয়-পরিজন ও পাড়ার ছেলে যুবকরা উৎসাহের সাথে এ কাজে লেগে যেত। তারা রঙিন কাগজ কেটে ঝালর পতাকা ইত্যাদি বানিয়ে সদর রাস্তা থেকে বাড়ি পর্যন্ত ঝলমলে করে তুলত।
বিত্তশালীদের বিয়ের অনুষ্ঠানে বরযাত্রী টমটম গাড়িতে চড়ে কনের বাড়িতে যেত। কনের বাড়ি বুড়িগঙ্গার ওপারে হলে নৌকা সাজানো হতো। একই সাথে রাতের বিয়েতে অথবা বিয়ে উৎসবের রাতে পোড়ানো হতো হাউই বাজি। ফানুস ওড়ানোর রীতিও ছিল। বর্তমান সময়ে ‘প্রীতি উপহার’ বিতরণের রেওয়াজ প্রায় উঠেই গেছে। আগে এটি ছিল বিয়ের আসরের একটি আবশ্যিক অঙ্গ। রঙিন কাগজে ছাপা এক পক্ষ অন্য পক্ষের উদ্দেশ্যে রঙ্গ-ব্যাঙ্গ করে লেখা কথামামালা থাকত এই উপহারে।
পুরান ঢাকার বিয়ে অনুষ্ঠানের অনেক রীতি প্রথা এখনো বহাল রয়েছে। বিয়ে পড়ানোর কাজটি বেশির ভাগ সময় মসজিদেই সম্পন্ন করা হতো। বিয়ে পড়ানো হয়ে গেলে খোরমা বা পায়েস দিয়ে উপস্থিত সবাইকে করানো হতো মিষ্টিমুখ। সেকালে সধারণ পরিবারগুলো বিয়ের ভোজে খুব বেশি রকমারী আয়োজন করত না। সাধারণত ছোলার ডালে রাধা মাংসের সাথে গরম ভাত পরিবেশন করা হতো। ধনী পরিবারগুলো নানা রকম মোগলাই খাবারে আপ্যায়নের ব্যবস্থা করত।
বিয়ে উপলক্ষে গীত গাওয়া আর নানা রকম গানবাজনার ব্যবস্থা করা হতো। লাউড স্পিকার চালু হওয়ার আগে গানের জন্য ‘মেরাসিনদে’র আমন্ত্রণ জানানো হতো। এরা ছিল বিশেষ ধরনের গান ও নাচের শিল্পী। সাধারণত পুরুষ শিল্পীরা মেয়েদের মতো সেজে গানের পাশাপাশি নানা অঙ্গভঙ্গি করে সবার মনোরঞ্জন করত। এসব গান গাওয়া হতো হিন্দি ও উর্দু ভাষায়। লাউড স্পিকার আসার পর ধীরে ধীরে মেরাসিনদের কদর কমে আসে। রেকর্ড প্লেয়ারে গান বাজানো ছিল বিয়ের আনন্দের একটি অপরিহার্য অঙ্গ। বিয়ে বাড়িতে কয়েকদিন ধরে দিনরাত গান বাজানো হতো লাউড স্পিকারে।
বিয়ে পড়ানোর পর বরকে কনের বাড়ির অন্দর মহলে নিয়ে যাওয়া এবং কনেকে বরের বাড়িতে আনা নানা রকম আচার-উপাচার ও আনন্দঘন পরিবেশ সৃষ্টির মধ্য দিয়ে সম্পন্ন হতো। বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করার পর যখন বরকে অন্দরে নেওয়া হতো তখন পুরুষ তার অনুগামী হতে পারত না। এই পর্ব ছিল পুরো মেয়েদের হাতে। সেখানে মজা করা, বরকে জব্দ করা বা বোকা বানানোর জন্য ঠাট্টা সম্পর্কীয়রা নানা আয়োজন করত। বিয়ের পর কনেকে যখন বরের বাড়িতে আনা হতো তখন কয়েকটি উপাচার পালন আবশ্যিক ছিল। এসব আচার ধর্মীয় বিধিবদ্ধতা অতিক্রম করে এ দেশের সাংস্কৃতিক সংমিশ্রণকেই স্পষ্ট করে। পালকি বা অন্য কোনো বাহন থেকে নামার পর বাড়ির আঙিনায় বা নির্দিষ্ট কোনো ঘরে বর ও কনের জন্য পিঁড়ি বা আসন সাজানো হতো। কনেকে প্রথমে সেই আসনে দাঁড় করানো হতো। বরণডালা নিয়ে আসতেন মুরব্বিস্থানীয়রা। ধান, দুর্বা দিয়ে আর প্রদীপ জ্বালিয়ে সাজানো হতো বরণডালা। ডালা কনের কপালে ছোঁয়ানো হতো। বর-কনের মুখাবয়বের সামনে ডালা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বরণের কাজ সম্পন্ন করা হতো। দুধ আর আলতা মেশানো পানি দিয়ে ধোয়ানো হতো নববধুর পা।
উনিশ শতক এবং বিশ শতকের বেশির ভাগ কাল পরিসরে এ দেশে ফুল চাষের প্রবণতা ছিল না। তাই সে সময় বিয়েতে এ সময়ের মতো এত ফুলের ব্যবহার হতো না। তবুও ঢাকার বিয়েতে ফুল সংগ্রহ জরুরি ছিল। বিশেষ করে বরপক্ষ চেষ্টা করত ফুল সংগ্রহ করতে। তারা কনের বাড়িতে যে ডালা পাঠাত তাতে কাঁচা ফুলের গয়না দেবার রীতি ছিল। ধীরে ধীরে চকবাজার ও শাঁখারী বাজারে ফুটপাথে দু-একজন ফুল বিক্রেতা বসে থাকতেন। তাঁরা বিয়ের উপযোগী ফুলের গয়না বানিয়ে বিক্রি করতেন।
বরের বাড়িতে আসার মধ্যদিয়েই ঢাকার বিয়ে উৎসবের সমাপ্তি ঘটত না। একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক উৎসব হিসেবে দুই অপরিচিত পরিবারের মধ্যে সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা বাড়াতে আরো কয়েকদিন উৎসবের রেশ ধরে রাখা হতো। কনেকে বরের বাড়ি নিয়ে আসার আড়াই দিন পর (কিছুটা বিলম্বিতও হতে পারত) পুনরায় বর-কনেকে ‘নাইওর’ নেওয়া হতো কনের বাড়ি। পুনরায় নাইওর যাওয়ার ব্যাপার বলে তা ‘ফিরোল্টা’ অর্থাৎ ‘ফির উল্টা’ নামে পরিচিত ছিল। এই পর্বে বরকে একদিন নিজ হাতে শ্বশুরবাড়িতে বাজার করতে হতো। জামাই কত বড় মাছ কিনে তা ছিল এক ধরনের দেখার বিষয়। অবশ্য এই পর্বটি সামর্থ্যের সাথে সম্পর্কিত ছিল।
বর-কনের নানা আনুষ্ঠানিকতার ভেতরে উভয় বাড়িতে আসা-যাওয়ার মধ্যদিয়ে পারিবারিক সম্পর্ক দৃঢ় করা হতো। এভাবে ধীরে ধীরে সম্পন্ন হতো বিয়ের রীতিনীতি ও নানা উপাচার।