সংগীতের শক্তি আর মুক্তিসংগ্রাম : একাত্তরের কনসার্ট ফর বাংলাদেশ
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ শক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন ছিল পাকিস্তানের প্রতি। বাংলাদেশে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর নির্মম আক্রমণ আর গণহত্যার পর এবং অগণিত সাধারণ মানুষ জীবন রক্ষার জন্য ভারতে শরণার্থী হিসেবে চলে যাওয়া সত্ত্বেও পাকিস্তানের প্রতি মার্কিন সমর্থন বন্ধ হয়নি। বরং ভারত কেন বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সমর্থন করছে সে কারণে বিভিন্ন পশ্চিমা গণমাধ্যম ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে প্রশ্ন করেছিল। কেন বাংলাদেশের লাখ লাখ সাধারণ মানুষ প্রাণ বাঁচানোর জন্য নিজের দেশ ছেড়ে পাশের দেশে আশ্রয় নিল সে সম্পর্কে পশ্চিমা দেশগুলোতে মানুষকে সচেতন করার যথেষ্ট চেষ্টা স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালে দেখা যায়নি। পাকিস্তানি সামরিক প্রশাসন যেমন বাংলাদেশ নামটি মেনে নিতে পারেনি, পশ্চিমের বিভিন্ন গণমাধ্যমেও তখন বাংলাদেশের পরিবর্তে পূর্ব পাকিস্তান নামটিই ব্যবহার করা হতো। এমন এক পরিস্থিতিতেই ১৯৭১ সালের পহেলা আগস্ট নিউ ইয়র্কের গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান কেন্দ্র ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেনে অনুষ্ঠিত হয় বিশ্বে প্রথমবারের মতো আয়োজিত বেনেফিট কনসার্ট : কনসার্ট ফর বাংলাদেশ। সমস্যাপীড়িত মানুষদের সাহায্য করার জন্য অর্থ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে কনসার্টের আয়োজন করা পরবর্তী সময়ে নিয়মিত একটি ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। কিন্তু বিশ্বের প্রথম বেনেফিট কনসার্টটি আয়োজিত হয়েছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে আশ্রয় নেওয়া দুর্দশাগ্রস্ত শরণার্থীদের সাহায্য করার জন্য। এবং এই কনসার্টটির অন্যতম আরেকটি উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে পুরো বিশ্বে একটি সচেতনতা সৃষ্টি করা।
বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধিতা সত্ত্বেও সেই ঐতিহাসিক কনসার্টটি অনুষ্ঠিত হয় যুক্তরাষ্ট্রেরই একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে এবং চল্লিশ হাজার দর্শকের সামনে সেই কনসার্টে একই মঞ্চে একসঙ্গে সংগীত পরিবেশন করেন বিশ্ববিখ্যাত বিভিন্ন সংগীতশিল্পী। এর আগে কখনো কোনো কনসার্টে একসঙ্গে এত তারকা সংগীতশিল্পী অংশগ্রহণ করেননি। ফলে এই কনসার্ট ঘিরে সেই সময় পশ্চিমা বিশ্বে এবং বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তরুণদের মধ্যে তৈরি হয় তুমুল আগ্রহ। কনসার্টের টিকেট বিক্রি শুরু হওয়ার অনেক আগে থেকেই টিকেট কেনার জন্য দর্শকদের ভিড় শুরু হয়ে যায়, একটি ভালো সিটের জন্য দর্শকরা ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেনের সামনে কয়েকদিন আগে থেকেই অপেক্ষা করতে শুরু করেন। বিখ্যাত এই অনুষ্ঠান কেন্দ্রের সামনে কনসার্টের আগের দিন রাতের বেলা দেখা যায় শুয়ে বসে আছে বহু তরুণ-তরুণী এবং সবাই উন্মুখ এই কনসার্ট দেখার জন্য। পরদিন যখন খ্যাতিমান সংগীতশিল্পীরা একের পর এক পরিবেশন করতে থাকেন বিখ্যাত সব গান, দর্শকরা আনন্দে বিমোহিত হয়ে ওঠেন। হাজার হাজার পশ্চিমা দর্শক দেখতে পান যে দেশে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর গণহত্যা এবং সাধারণ মানুষের অবর্ণনীয় দুর্দশা দেখার পরও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানি বাহিনীকে সমর্থন করছে, সেই বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের প্রতি সচেতনতা সৃষ্টির জন্য এবং সেই দেশের অসহায় বহু মানুষকে সাহায্য করার জন্য অর্থ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে বিশ্ববিখ্যাত সংগীতশিল্পীরা একই মঞ্চে সমবেত হয়ে সংগীত পরিবেশন করছেন।
যে বাংলাদেশ নামটি পশ্চিমা বিশ্বে পরিচিত করে তোলার আগ্রহ দেখা যায়নি, এই কনসার্টের কারণে সেই বাংলাদেশ নামটিই একদিনে সারা বিশ্বে পরিচিত হয়ে ওঠে। এই কনসার্ট তাই কেবল একটি সংগীতানুষ্ঠানই ছিল না, তা হয়ে ওঠে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সাহসী এক প্রতিবাদ। বরেণ্য সংগীতশিল্পীরা এই কনসার্টের মাধ্যমে স্পষ্ট করেন মানবতার পক্ষে তাঁদের অবস্থান। প্রিয় সংগীতশিল্পীদের মহৎ এই উদ্যোগের মাধ্যমে বিশ্বের বহু মানুষের মধ্যেও তৈরি হয় প্রয়োজনীয় এক রাজনৈতিক সচেতনতা। অসহায় মানুষদের সাহায্য করার জন্য পশ্চিমের বিখ্যাত এই শিল্পীরা মার্কিন প্রশাসনের রাজনৈতিক অবস্থানের বিরুদ্ধে যেতেও দ্বিধা করেননি।
ষাটের দশকে বিশ্বে সাড়াজাগানো বিখ্যাত ব্রিটিশ ব্যান্ড বিটলসের অন্যতম সদস্য জর্জ হ্যারিসন ছিলেন এই কনসার্টের মূল উদ্যোক্তা। বিটলসের বিখ্যাত চারজন সদস্যের মধ্যে জর্জ হ্যারিসন ছিলেন চুপচাপ স্বভাবের। বিটলস সদস্যদের একসঙ্গে থাকার বিখ্যাত বছরগুলোতে জন লেনন আর পল ম্যাকার্টনির পাশে যেন অনেকটাই আড়ালে থাকতেন জর্জ হ্যারিসন। যে কারণে জর্জ হ্যারিসনের নাম তখন দেওয়া হয়েছিল ‘কোয়ায়েট বিটল’। ১৯৭০ সালে বিটলস ভেঙে যাওয়ার পর বিখ্যাত চারজন সদস্যই আলাদাভাবে নিজ নিজ গানের কাজ করতে থাকেন। সেই সময় হঠাৎই অনেক বেশি জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন জর্জ হ্যারিসন। ১৯৭০ সালে তাঁর ‘অল থিংস মাস্ট পাস’ অ্যালবামটি ব্যাপক সাফল্য পায়। বলা হতে থাকে একসময় বিটলস ব্যান্ডকে ঘিরে দর্শকদের মধ্যে যেমন উন্মাদনা চোখে পড়ত, তেমনই উন্মাদনা এখন যেন জর্জ হ্যারিসনকে ঘিরে শুরু হয়েছে।
ভারতীয় সংগীতের অনুরাগী জর্জ হ্যারিসনের সঙ্গে ভারতের বিখ্যাত সংগীতশিল্পী রবিশঙ্করের গভীর বন্ধুত্ব শুরু হয়েছিল ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকেই। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণের পর বহু মানুষের দুর্দশা রবিশঙ্করকে ব্যথিত এবং উদ্বিগ্ন করে তুলেছিল। ভারতে আশ্রয় নেওয়া অজস্র বাঙালি শরণার্থীকে সাহায্যের জন্য অর্থ সংগ্রহের ইচ্ছা থেকে একটি বেনেফিট কনসার্ট আয়োজন করা যায় কি না এই ব্যাপারে রবিশঙ্কর একাত্তর সালের মাঝামাঝি সময়ে জর্জ হ্যারিসনকে অনুরোধ করেন। বাংলাদেশের বিদ্যমান সমস্যাসংকুল পরিস্থিতি সম্পর্কেও জর্জ হ্যারিসনকে জানান রবিশঙ্কর। ঘনিষ্ঠ বন্ধুর এমন অনুরোধ পাওয়ার পর জর্জ হ্যারিসন সঙ্গে সঙ্গেই ঠিক করেন তিনি একটি কনসার্ট আয়োজনের চেষ্টা করবেন, আর তিনি অন্য অনেক বিখ্যাত শিল্পীকেও অনুরোধ করবেন এই কনসার্টে অংশ নেওয়ার জন্য। রবিশঙ্কর, জর্জ হ্যারিসনের ইচ্ছা আর চেষ্টা থেকেই এরপর অনুষ্ঠিত হয় ঐতিহাসিক এই কনসার্ট। যার মাধ্যমে বাংলাদেশ সম্পর্কে একাত্তরের আগস্ট মাসে নতুনভাবে সচেতন হয়ে ওঠে বিভিন্ন দেশের বিশেষ করে পশ্চিমা বিশ্বের বহু মানুষ।
১৯৭১ সালের পুরো জুন মাস আর জুলাইয়েরও অর্ধেক সময় জর্জ হ্যারিসন বিভিন্ন শিল্পীর সঙ্গে যোগাযোগ করে কাটান। তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে কনসার্ট ফর বাংলাদেশে অংশ নিতে রাজি হন বিভিন্ন বিখ্যাত মিউজিশিয়ান। বিটলস-এর অন্য তিনজন সদস্যের মধ্যে রিঙ্গো স্টার সঙ্গে সঙ্গেই রাজি হন। অন্য দুই সদস্য জন লেনন আর পল ম্যাকার্টনি আসতে না চাইলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেই সময়ের সবচেয়ে বিখ্যাত সংগীতশিল্পীদের একজন বব ডিলান কনসার্টে অংশ নিতে সম্মত হন। জর্জ হ্যারিসনের কথায় এগিয়ে আসেন আরো দুই বিখ্যাত মার্কিন গায়ক বিলি প্রেস্টন আর লিওন রাসেল এবং বিশ্বের অন্যতম সেরা গিটারিস্টদের একজন ব্রিটিশ সংগীতশিল্পী এরিক ক্ল্যাপটন। আসেন ব্রিটিশ রক ব্যান্ড ‘ব্যাডফিঙ্গার’-এর সব সদস্য, জার্মান মিউজিশিয়ান ক্লাউস ভুরম্যান, মার্কিন ড্রামার জিম কেল্টনার, জিম হর্নসের নেতৃত্বে ‘হলিউড হর্নস’ দলের সদস্যরা, গিটারিস্ট জেসি এড ডেভিস, ডন প্রেস্টন, কার্ল রেডল এবং অন্য আরো অনেক সংগীতশিল্পী যাঁরা কনসার্টে বিভিন্ন গানে কণ্ঠ দিয়েছেন। আর কনসার্টের প্রথম অংশে ভারতীয় সংগীত পর্বে রবিশঙ্করের সাথে অংশগ্রহণ করেন দুই বিখ্যাত ভারতীয় শিল্পী ওস্তাদ আলী আকবর খান আর আল্লাহ্ রাখা। সব শিল্পীই এই কনসার্টে অংশগ্রহণে আগ্রহী ছিলেন, সবাই আন্তরিক ছিলেন সাহায্য করার জন্য। অনেক মিউজিশিয়ান অন্য দেশে নিজেদের কাজ বন্ধ রেখে জর্জ হ্যারিসনের ডাকে এই কনসার্টে অংশগ্রহণের জন্য নিউইয়র্ক চলে আসেন। আর এই জন্য তাঁরা কোনো অর্থও গ্রহণ করেননি। এতজন বিখ্যাত মিউজিশিয়ানের একসঙ্গে মঞ্চে উপস্থিতির কারণে এই কনসার্ট হয়ে ওঠে বিশাল আর আকর্ষণীয় এক আয়োজন। লিওন রাসেলের ভাষায়, প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত অত্যন্ত উঁচু মানের এক অভিজ্ঞতা।
এমন বিশাল আয়োজনের জন্য বিখ্যাত এই সংগীতশিল্পীদের মধ্যেও তৈরি হয়েছিল মানসিক চাপ। কনসার্টের আগে সংবাদ সম্মেলনে যখন জর্জ হ্যারিসনকে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেন যে এই অনুষ্ঠানে তিনিই হবেন প্রধান তারকা, এই ব্যাপারে তিনি কেমন বোধ করছেন তখন জর্জ হ্যারিসন বলে ওঠেন, ‘নার্ভাস’। অনুষ্ঠানের আগের দিন বব ডিলন ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেনে এসে মঞ্চের চারদিকে বিশাল সব ক্যামেরা, বহু মাইক্রোফোন দেখে অস্বস্তিতে পড়ে যান। জর্জ হ্যারিসনকে তিনি জানান যে এত মানুষের সামনে তাঁর পক্ষে গান গাওয়া সম্ভব নয়। হ্যারিসন ডিলনকে সাহস দেওয়ার চেষ্টা করেন, কিন্তু পরদিন ডিলনের মঞ্চে না আসা পর্যন্ত অনুষ্ঠানের আয়োজক আর শিল্পীদের মধ্যে সন্দেহ ছিল বব ডিলন আদৌ মঞ্চে আসবেন কি না। যখন বব ডিলন সত্যিই মঞ্চে উপস্থিত হন, তাঁকে দেখেই বোঝা যাচ্ছিল যে অজস্র মানুষের সামনে গান গাওয়ার ব্যাপারে তাঁর ভীতি পুরোপুরি কাটেনি। লিওন রাসেল শুরুতে ভেবেছিলেন তিনি খুব নার্ভাস থাকবেন। কিন্তু অনুষ্ঠানের দিন মঞ্চে একসঙ্গে এতজন বিখ্যাত মিউজিশিয়ানকে দেখে তিনি অনুভব করেন তাঁর ওপর আলাদাভাবে আর কোনো চাপ নেই। বিলি প্রেস্টনও আনন্দের সঙ্গে কনসার্টে অংশগ্রহণে রাজি হয়েছিলেন কারণ তাঁর মতে এতজন বিখ্যাত মিউজিশিয়ানের সঙ্গে একসঙ্গে কোনো অনুষ্ঠানে গান গাওয়ার সুযোগ সহজে পাওয়া যায় না। অত্যন্ত বিখ্যাত আর জনপ্রিয় ‘বিটল’-দের যে কোনো একজনকে মঞ্চে দেখতে পাওয়াই ছিল সংগীতপ্রেমীদের জন্য গভীর আনন্দের একটি ব্যাপার। আর এই কনসার্টে দুজন বিটল অংশ নেন এবং তাঁদের সঙ্গে দর্শকরা দেখতে পান আরো কয়েকজন বিখ্যাত মিউজিশিয়ানকে। শুরু থেকেই তাই দর্শকরা ছিলেন খুবই উচ্ছ্বসিত।
এই কনসার্টকে ঘিরে দর্শকদের তুমুল উৎসাহ স্পষ্ট হয় অনুষ্ঠানের প্রথম পর্বেই যখন ভারতীয় শিল্পীরা সংগীত পরিবেশন করেন। ভারতীয় ধ্রুপদী সংগীত পাশ্চাত্যের রক মিউজিকের চেয়ে অনেক বেশি গম্ভীর ধাঁচের সংগীত। জর্জ হ্যারিসন আর রবিশঙ্কর ভারতীয় সংগীত পর্বের শুরুতেই এই পার্থক্যের কথা উল্লেখ করেন। তুমুল হাততালির মধ্য দিয়ে দর্শকরা রবিশঙ্করের উদ্বোধনী বক্তব্যকে স্বাগত জানান। এরপর তিন বিখ্যাত ভারতীয় শিল্পী অল্প কিছুক্ষণ তাঁদের বাদ্যযন্ত্রগুলোর সুর ঠিকঠাক করার পরই আবার শোনা যায় তুমুল করতালির শব্দ। বোঝা যায় পশ্চিমের তরুণ দর্শকরা সেতার-সরোদ-তবলা-তানপুরার শব্দ অনেক পছন্দ করেছে। রবিশঙ্কর হাসতে হাসতে দর্শকদের লক্ষ্য করে মাইকে বলে ওঠেন : ‘ইফ ইউ অ্যাপ্রিশিয়েট দ্য টিউনিং সো মাচ, আই হোপ ইউ উইল এনজয় দ্য প্লেয়িং মোর।’ এরপর রবিশঙ্কর-আলী আকবর খান-আল্লাহ্ রাখা আর তানপুরায় কমলা চক্রবর্তীর অংশগ্রহণে বেজে ওঠে ‘বাংলা ধুন’ - বাংলাদেশের লোকসংগীতের এক অনন্য সুর। বাংলার গ্রামের সবুজ প্রান্তরের সৌন্দর্য আর সারল্য ভরা জীবনের ছবি সংগীতের মূর্ছনায় যেন স্পষ্ট ভেসে ওঠে বাংলাদেশ থেকে বহু দূরে নিউইয়র্কের এক ভিন্ন পরিবেশে। দর্শকরা নীরব হয়ে শোনেন সেই অসাধারণ সুর, বোঝা যায় তাদের মুগ্ধতা। চোখের সামনে তারা দেখতে পান সেতার-সরোদ-তবলা-তানপুরা যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে এই গুণী শিল্পীদের হাতের ছোঁয়ায়।
পরবর্তী সময়ে জর্জ হ্যারিসনের ‘হোয়াইল মাই গিটার জেন্টলি উইপস’ গানটির সময় আরেকবার সুরের মূর্ছনা মন্ত্রমুগ্ধ করে তুলেছিল ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেনে সমবেত হাজারো দর্শককে। এই গানটির লিড গিটারের অংশটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ; দরকার ছিল এমন একজন গিটারিস্ট যিনি গিটারের সুর কিছুটা বিষাদমগ্ন আবার একই সঙ্গে আন্দোলিত আর অস্থির করে তুলতে পারবেন। এই কঠিন কাজটির দায়িত্ব সেদিন পালন করেন বিশ্বের অন্যতম সেরা গিটারিস্টদের একজন এরিক ক্ল্যাপটন। আর যাঁরা কনসার্টটি দেখেছেন, তাঁরা জানেন সেদিন কী অসাধারণভাবে এরিক ক্ল্যাপটন এই কঠিন দায়িত্বটি পালন করেছিলেন, এই গানটির সময় তাঁর গিটারের সুর কতটা মোহময় হয়ে উঠেছিল।
অথচ এই কনসার্টে অংশ নেওয়া এরিক ক্ল্যাপটনের জন্য সহজ ছিল না। ষাটের দশকের শেষ ভাগে রকসংগীতের মন্থর আর বিষণ্ণ এক সময়ে এরিক ক্ল্যাপটনও হয়ে পড়েছিলেন অনেকটা নির্জীব; প্রায় আড়াই বছর তিনি নিজেকে গুটিয়ে রেখেছিলেন। সেই সময় তারকাশিল্পীদের হার্ড ড্র্রাগস নেওয়ার প্রবণতার কারণে পাশ্চাত্য সংগীতের জগতে তৈরি হয়েছিল একধরনের স্থবিরতা। হার্ড ড্রাগস নেওয়ার কারণে মারা যান জিমি হেনড্রিকস আর জেনিস জপলিনের মতো বিখ্যাত দুই শিল্পী। নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখা এরিক ক্ল্যাপটনের পক্ষে সেই মানসিক অবস্থায় লন্ডন থেকে নিউ ইয়র্কে এসে এত গুরুত্বপূর্ণ এক কনসার্টে অংশ নেওয়া সহজ ছিল না। কিন্তু অন্য অনেক শিল্পী নিজেদের নিয়মিত কাজ বাদ দিয়ে যেভাবে এই কনসার্টে অংশগ্রহণ করছিলেন, তা দেখে এরিক ক্ল্যাপটনও শেষ পর্যন্ত উপস্থিত হন নিউইয়র্কে। তাঁর মানসিক আর শারীরিক অবস্থা দেখে একপর্যায়ে জর্জ হ্যারিসন তাঁকে আসতে মানা করলেও, এরিক ক্ল্যাপটন ঠিকই যোগ দেন অন্য সংগীতশিল্পীদের সঙ্গে। কনসার্টের জন্য তিনি কোনো রিহার্সেলেও অংশ নিতে পারেননি কিন্তু কোনো প্রস্তুতি না নেওয়ার পরও গিটার হাতে তার অনবদ্য পারফরম্যান্স মোহমুগ্ধ করে তোলে দর্শকদের। ‘হোয়াইল মাই গিটার জেন্টলি উইপস’ গানটির জন্য তিনি ব্যবহার করেছিলেন একটি সেমি-অ্যাকুউসটিক গিটার। কিন্তু পরে তিনি বলেছিলেন, এমন একটি গানের জন্য তিনি সঠিক গিটার বাছেননি। উচিত ছিল একটি ফেন্ডার বা সলিড গিবসন গিটার ব্যবহার করা। সেমি-অ্যাকুউসটিক গিটার বেছে নিয়ে এই গানের জন্য বিশেষ সুর সৃষ্টি করার কাজটি তিনি নিজের জন্য অনেক কঠিন করে ফেলেছিলেন। কিন্তু এরিক ক্ল্যাপটনের মতো একজন গিটারিস্টের পক্ষে যে কোনো পরিস্থিতিতেই গিটারের সুর অসাধারণ আকর্ষণীয় করে তোলা সম্ভব, কনসার্ট ফর বাংলাদেশে তাঁর পারফরম্যান্স তাই প্রমাণ করে।
দর্শকরা এই কনসার্টে জর্জ হ্যারিসনের অনুপম, স্নিগ্ধ কণ্ঠে একে একে শুনতে পান তাঁর বিখ্যাত সব গান - ‘ওয়াহ্ ওয়াহ্,’ ‘মাই সুইট লর্ড, ‘বিওয়ের অব ডার্কনেস,’ ‘হিয়ার কামস দ্য সান,’ ‘সামথিং।’ তুমুল করতালি আর হর্ষধ্বনিতে বারবার মুখরিত হয়ে ওঠে ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেন। নিজের নার্ভাসনেস কাটিয়ে উঠে বব ডিলন পরিবেশন করেন তাঁর দর্শকনন্দিত সব গান। হাজার হাজার দর্শক উপভোগ করেন সেই দৃশ্য - বব ডিলন তাঁদের সামনে দাঁড়িয়ে গাইছেন তাঁর বিখ্যাত গান ‘ব্লোয়িং ইন দ্য উইন্ড।’ রিঙ্গো স্টার, বিলি প্রেস্টন, লিওন রাসেলের বিভিন্ন গানের সময়ও আনন্দে মেতে ওঠেন দর্শকরা। বিলি প্রেস্টন আর লিওন রাসেলের পিয়ানো, বিভিন্ন ধরনের গিটার, রিঙ্গো স্টার আর জিম কেল্টনারের ড্রাম আর বিভিন্ন হর্ন ইন্সট্রুমেন্টের মাধ্যমে কনসার্টে যে সংগীত সৃষ্টি করা হয় তা ছিল এককথায় চিত্তাকর্ষক। কনসার্টের শেষ সংগীতটি ছিল জর্জ হ্যারিসনের লেখা বিশেষ গান - ‘বাংলাদেশ’। জর্জ হ্যারিসনের বিখ্যাত কণ্ঠে সেদিন অজস্র দর্শক আর পরবর্তী সময়ে সারা বিশ্বের অগণিত মানুষ শুনতে পান সেই অসাধারণ গান। এই মহৎ অনুষ্ঠান আয়োজনের মাধ্যমে বরেণ্য এই সংগীতশিল্পীরা মানবতার বার্তা পৌঁছে দেন বহু মানুষের কাছে, সৃষ্টি করেন অন্যায় আর অত্যাচারের বিরুদ্ধে সচেতনতা। আর এমন একটি অনুষ্ঠান শেষ হয় মনকে গভীরভাবে স্পর্শ করে যাওয়া এই গানটির মধ্য দিয়ে। গানের শুরুর কথাগুলি ছিল –‘মাই ফ্রেন্ড কেম টু মি, উইথ স্যাডনেস ইন হিজ আইজ; টোল্ড মি দ্যাট হি ওয়ান্টেড হেল্প, বিফোর হিজ কান্ট্রি ডাইজ। অলদো আই কুডন্ট ফিল দ্য পেইন, আই নিউ আই হ্যাড টু ট্রাই; নাউ আই অ্যাম আসকিং অল অব ইউ টু হেল্প আস সেভ সাম লাইভস।’
জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কোফি আনান পরে বলেছিলেন গানটির এই কথাগুলো সংগীতের পেছনে যে মানুষটি আছে, যিনি এই কথাগুলো লিখেছেন তাঁর মন কতটা অনুভূতিশীল তাই স্পষ্ট করে তোলে। বিখ্যাত এই শিল্পীরা সেদিন অনেক সাহস নিয়ে সমবেত হয়েছিলেন বাংলাদেশকে সাহায্য করার জন্য। রবিশঙ্কর কনসার্টের শুরুতেই দর্শকদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন : ‘আমরা কোনো রাজনীতি করতে আসিনি। আমরা শিল্পী। আমরা শুধু আমাদের অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে একটি বার্তা পৌঁছে দিতে এসেছি। আমরা চাই আমাদের সংগীত বাংলাদেশের মানুষের তীব্র মনোযন্ত্রণা অনুভব করতে আপনাদের সাহায্য করুক।’ এরিক ক্ল্যাপটন পরে এই কনসার্টের স্মৃতিচারণায় বলেছিলেন, ‘সেই কনসার্টটির কথা যখন ভাবি শিল্পী হিসেবে আমরা গর্বিত বোধ করি। সেদিন আমরা কেউই পাঁচ মিনিটের জন্যও নিজেদের কথা চিন্তা করিনি, আমরা সবাই ভাবছিলাম আরো অনেক বৃহৎ একটি ঘটনা আর আমাদের দায়িত্ব নিয়ে।’ বাংলাদেশকে কেন সমর্থন দেওয়া জরুরি এই বক্তব্যটিই বহু মানুষের কাছে পৌঁছে যায় এই কনসার্টের মধ্য দিয়ে। যে কিংবদন্তি-প্রতিম সংগীতশিল্পীদের গান মুগ্ধ করে রেখেছিল অগণিত মানুষকে, বাংলাদেশের জন্য সেই শিল্পীদের সমবেত হওয়ার শক্তি ১৯৭১ সালের পহেলা আগস্টের পর থেকে যুক্ত হয় বাংলাদেশের মানুষের মুক্তিসংগ্রামের সঙ্গে।
মুক্তিযুদ্ধের ঠিক ২০ বছর পর ১৯৯১ সালে বিটিভিতে ‘ইত্যাদি’ অনুষ্ঠানে প্রথমবারের মতো দেখেছিলাম জর্জ হ্যারিসনের ‘বাংলাদেশ’ গানটি। এর আগে বাংলাদেশে কখনো এই গানটি প্রচার করা হয়েছিল বলে আমার জানা নেই। গানটি দেখানোর পর বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের বহু দর্শক প্রথমবারের মতো জানতে পারে কনসার্ট ফর বাংলাদেশ সম্পর্কে। বাংলাদেশে নতুন সময়ের বহু মানুষকে এই কনসার্ট আর জর্জ হ্যারিসনের এই গানটি সম্পর্কে জানানোর ক্ষেত্রে ‘ইত্যাদি’-র রচয়িতা হানিফ সংকেতের অবদান তাই গুরুত্বপূর্ণ। মনে আছে, প্রথম যেদিন ‘বাংলাদেশ’ গানটি দেখি বিটিভিতে, কী প্রচণ্ডভাবে সেদিন আলোড়িত হয়েছিলাম; শরীরে যেন কাঁটা দিয়ে উঠেছিল। পরে সমবয়সী বন্ধুরাও বলেছিল তাদেরও একই অনুভূতি হয়েছিল গানটি দেখার পর। এরপর কেটে গেল আরো দুই যুগ। এখনো যখন গানটি শুনি, আলোড়িত হই প্রতিবার। জানি আমার মন চিরদিন এভাবে স্পর্শ করে যাবে জর্জ হ্যারিসনের এই অসাধারণ গান। আর চিরদিন মনে থাকবে এই বিশেষ কনসার্টের কথা, আর সেই সংগীতশিল্পীদের কথা যারা ১৯৭১ সালের সেই সংকটময় সময়ে দাঁড়িয়েছিলেন বাংলাদেশের পাশে।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।