ঢাকার কথা ১৬
ঢাকায় হাতি ও ঘোড়ার ব্যবহার
প্রাচীনকাল থেকে বাংলা ছিল এক সমৃদ্ধ জনপদ। রাজ্য গড়ার পরও ঐশ্বর্যশালী দেশ হিসেবে পরিচিতি পায় বাংলা। তাই বাংলার প্রতাপশালী রাজাদের সৈন্য বাহিনীতে হাতির বহর থাকত। গ্রিক বর্ণনায় বাংলা অঞ্চলে গঙারিডি নামে একটি শক্তিশালী রাজ্যের কথা জানা যায়। বলা হয়েছে এই রাজ্যের রাজার সৈন্য বাহিনীতে চার হাজার হাতি ছিল। পাল রাজাদের সময়ও হাতির ব্যাপক ব্যবহারের কথা জানা যায়। এ কারণে তখন হাতির চিকিৎসার জন্য ‘হস্তি আয়ুর্বেদ’ নামে একটি গ্রন্থও লেখা হয়েছিল। প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলায় পোড়ামাটির ফলকে অনেক হাতির প্রতিমূর্তি দেখা যায়। মোগল যুগে হাতির ব্যবহার অব্যাহত থাকে। এ সময়ের বিভিন্ন সাহিত্য সূত্র ছাড়াও মোগল চিত্রকলায় যুদ্ধের প্রয়োজনে এবং মোগল সম্রাট ও অভিজাতদের ব্যক্তিগত পরিবহনে হাতি ব্যবহারের বিষয়টি দৃশ্যমান।
ঢাকায় মোগল সুবাদার এবং নবাবী যুগে নায়েব নাজিমরা হাতির হাওদায় বসে নগর পরিভ্রমণ করতেন। নবাবী আমলে ঢাকার ঈদ মিছিলের আঁকা ছবিতে হাতির বহর ছিল। ঔপনিবেশিক যুগেও ইংরেজ শাসকদের তত্ত্বাবধানে ঢাকায় হাতির ব্যবহার অব্যাহত থাকে। ফারসি ‘পিলখানা’ শব্দের অর্থ হচ্ছে হাতিশাল। মোগলদের রাজভাষা ছিল ফারসি। তাই ঢাকার পিলখানা মোগল পর্বের হাতিশালের কথাই মনে করিয়ে দেয়। আবার এলিফেন্ট রোড মনে করিয়ে দেয় ইংরেজ শাসন যুগে হাতি চলাচলের কথা।
হাতির চালক সাধারণভাবে পরিচিত মাহুত নামে। পিলখানায় যে অনেক হাতি ছিল তা স্পষ্ট করে পুরান ঢাকার মাহুতটুলি এলাকাটি। নামেই বোঝা যায় এটি ছিল মাহুতদের বসবাসের নির্দিষ্ট এলাকা। উনিশ শতকের শেষ দিকে মাহুতদের পুরান ঢাকার মানুষ ‘সর্দার’ও বলত। হিন্দু ও ইসলাম দুই ধর্মের মানুষই মাহুতের কাজ করত।
ইংরেজ শাসনযুগে উনিশ শতকে ঢাকার পিলখানায় সরকারি হাতিশালা স্থাপন করা হয়। হাতিশালার প্রধান ছিলেন একজন সুপারিনটেডেনন্ট। তিনটি বিভাগের প্রয়োজনে হাতি রাখা হতো। যেমন, ক. সামরিক বাহিনীর পরিবহনের জন্য হাতি, খ. স্টেট বিভাগের প্রয়োজনে হাতি এবং গ. প্রশিক্ষণের জন্য হাতি। হাতির বিচরণের জন্য জায়গা রাখা হয়েছিল রমনা এলাকায়।
ঢাকায় যুদ্ধের প্রয়োজনে হাতি ব্যবহারের তেমন প্রমাণ নেই। ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানে হাতি সাজিয়ে আনা হতো। হাতি ছিল সে যুগে আভিজাত্যের প্রতীক। ঈদ, জন্মাষ্টমী এবং বিশেষ কোনো রাষ্ট্রীয় উৎসবে মিছিল বের করা হতো। এসব মিছিলে পিলখানার হাতি ছাড়াও অনেক জমিদারের হাতি অংশ নিত।
হাতির পাশাপাশি ঘোড়ার উপস্থিতিও ছিল ঢাকায়। তবে হাতির চেয়ে ঘোড়া ছিল সাধারণ মানুষের অনেক কাছের পশু। ঢাকায় রিকশা বা মোটরগাড়ি চলাচলের আগে বাহন হিসেবে আভিজাত্যের প্রতীক ছিল ঘোড়ার গাড়ি। ‘টপোগ্রাফি অব ঢাকা’ গ্রন্থের লেখক জেমস ওয়াইজ আঠার শতকের মাঝামাঝি সিভিল সার্জন হিসেবে ঢাকায় এসেছিলেন। তিনি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে লিখেছেন যে ঢাকায় ঘোড়ার গাড়ির প্রচলন শুরু হয় ১৭৯০ সালে। এ সময় একদল সৈনিক ভাড়াটে ঘোড়ার গাড়ি চালু করে। উনিশ শতকে কলকাতা, ঢাকা ও মুর্শিদাবাদ শহরে নানা ধরনের ঘোড়ার গাড়ি চলত।
ঘোড়ার গাড়ির চালক গাড়োয়ান বা কোচোয়ান নামে পরিচিত ছিল। যাত্রীবাহী ঘোড়ার গাড়ি চার আসন বিশিষ্ট হতো। একটি বড় কাঠের বাক্সের মধ্যে যেন আসন পাতা থাকত। প্রতি গাড়িতে দুটো করে চারটি জানালা কাটা হতো। গাড়িতে প্রবেশ করার জন্য ছিল দুটি দরোজা। গাড়ির সামনের দিকে ছাদের ওপর বা গাড়ির দেয়াল ঘেঁষে আসন পাতা থাকত। এতে গাড়োয়ান বসত। এক হাতে ঘোড়ার লাগাম ধরা থাকত আর অন্য হাতে থাকত দড়ির বা চামড়ার চাবুক। এভাবেই সে ঘোড়া নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করত। গাড়ির পেছনে একটি বাড়তি পাদানি থাকত। সেখানে গাড়োয়ানের সহকারী দাঁড়িয়ে থেকে তাকে সহায়তা করত। ঘোড়ার গাড়িতে সাধারণত জুড়ে দেওয়া হতো দুটো ঘোড়া।
ঢাকায় লোক সংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে ঘোড়ার গাড়ির চাহিদাও বৃদ্ধি পায়। স্কুল-কলেজের ছাত্রী এবং সাধারণ পরিবহন ছাড়াও এ সময় অফিস-আদালতে যাওয়ার জন্যও ঘোড়ার গাড়ি ব্যবহার করতে দেখা যায়। ডাক বিভাগের অধীনে ছিল বেশ কয়েকটি ঘোড়ার গাড়ি। এগুলো দিয়ে বিভিন্ন ডাকঘরে ডাক পৌঁছে দেওয়া হতো। ট্রেন স্টিমার নির্দিষ্ট সময়ে ধরার জন্য ঘোড়ার গাড়িই ছিল সে যুগে মানুষের একমাত্র দ্রুতযান।
নির্দিষ্ট রুটে চলা ছাড়াও যাত্রী পেলে কোচোয়ানরা শহরের দূর প্রান্ত মিরপুরেও যেত। ঘোড়ার গাড়ির সাধারণ রুট ছিল সদরঘাট থেকে চকবাজার। ঢাকায় হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার সময় মানবিক দায়িত্ব পালন করত কোচোয়ানরা। তারা হিন্দু-মুসলমানদের এলাকার ভেতর দিয়ে যাত্রীদের দ্রুত বেগে নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছে দিত।
লেখক : অধ্যাপক, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়