ঢাকার কথা ১৮
বঙ্গভঙ্গ ও কার্জন হল
ব্রিটিশ ভারতের ভাইসরয় লর্ড কার্জন ছিলেন বঙ্গভঙ্গের প্রবক্তা। বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাবনার পেছনে সরকারি ব্যাখ্যা যথেষ্ট যৌক্তিকভাবে দেওয়া হয়েছিল। বলা হয়েছে বাংলা হচ্ছে একটি বিশাল প্রদেশ। পূর্ব ও পশ্চিম বাংলা ছাড়াও বিহার এবং উড়িষ্যা ছিল বাংলার অন্তর্গত। তাই কলকাতা কেন্দ্রে বসে গভর্নর জেনারেলের পক্ষে পুরো বাংলায় সুশাসন প্রতিষ্ঠা ছিল কষ্টকর। এই কারণেই পূর্ব বাংলা ও আসাম অবহেলিত থেকে গিয়েছিল। কার্জন ভেবেছিলেন বাংলায় সুশাসন প্রতিষ্ঠিত করতে হলে বাংলা প্রদেশকে দুটো অংশে ভাগ করে শাসন করতে হবে। নতুন একটি প্রদেশ করা হবে। যার নাম হবে পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশ। এই প্রদেশের রাজধানী হবে ঢাকা। প্রদেশটির শাসনভার দেওয়া হবে একজন লেফটেন্যান্ট গভর্নরের হাতে। এই ঘোষণায় পূর্ববঙ্গের মানুষ উৎফুল্ল হয়ে ওঠে। মুসলমান অধ্যুষিত এই দেশের মুসলমান নেতারা এ কারণে ইংরেজ শাসকদের সবরকম সহায়তা প্রদানের আশ্বাস দেন। মুসলমানদের নেতৃত্বে তখন ছিলেন ঢাকার নবাব স্যার সলিমুল্লাহ।
লর্ড কার্জন বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব প্রস্তুত করেন ১৯০৪ সালে। এরপর তিনি পূর্ববঙ্গে প্রস্তাবের সমর্থনে জনমত তৈরির জন্য সফরে বের হন। ঢাকাসহ কয়েকটি জেলা ভ্রমণ করেন তিনি। পূর্ববঙ্গের মানুষ বুঝতে পারে এবার এ অঞ্চলের উন্নয়ন হবে। কার্জন ঢাকায় এসে উন্নয়নের সূচক হিসেবে ১৯০৪ সালে ঢাকায় একটি টাউন হল নির্মাণের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। গভর্নর জেনারেলের নামানুসারে এর নামকরণ করা হয় কার্জন হল। পরের বছর অর্থাৎ ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ কার্যকর করা হয়। শিক্ষিত ও অভিজাত হিন্দুদের বড় অংশ বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে থাকে। তারা মনে করে এটি হচ্ছে ইংরেজ শাসকদের চালাকি। তারা আসলে বঙ্গভঙ্গের মধ্যদিয়ে বাংলার হিন্দু-মুসলমানের সম্পর্কে ফাঁটল ধরাতে চায়। যাতে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে ঝগড়া লাগিয়ে নিজেরা নিশ্চিন্তে শাসন করতে পারে।
এই ধরনের রাজনৈতিক ঝগড়ায় উন্নয়নের যে ধারা সূচিত হয়েছিল তাতে ছেদ পড়ে। বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলন একপর্যায়ে সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনে রূপ নেয়। শেষ পর্যন্ত ইংরেজ সরকার ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ ঘোষণা করতে বাধ্য হয়। তাই নতুন প্রদেশে সরকারি কাজে ব্যবহৃত হবে বিবেচনায় কার্জন হলের কার্যকারিতা আর রইল না। এই সুরম্য ভবনটি এ সময় ঢাকা কলেজ ভবনে রূপান্তরিত হয়। ঢাকা কলেজ হিসেবে কার্জন হল ব্যবহৃত হতে থাকে ১৯২১ সাল পর্যন্ত। এই সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। তখন থেকে কার্জন হল রূপান্তরিত হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান ভবনে। কার্জন হল ইন্দো-ইউরোপীয় স্থাপত্য রীতিতে তৈরি একটি দৃষ্টিনন্দন দ্বিতল ইমারত। মোগল ও ইউরোপীয় স্থাপত্য শৈলী ভবনটির স্থাপত্যিক ঔজ্জ্বল্য অনেক বৃদ্ধি করেছে। বহুখাঁজ বিশিষ্ট খিলান এবং অনেক ছোট বড় গম্বুজ মোগল স্থাপত্যের প্রতিনিধিত্ব করছে। সামনের প্রশস্ত আঙিনায় ছিল নয়নাভিরাম বাগান। ভবনটিতে রয়েছে একটি বিশাল হল। ভবনের পূর্ব ও পশ্চিম পার্শ্বে রয়েছে অনেকগুলো কক্ষ। আর রয়েছে টানা বারান্দা। মোগল যুগে দিল্লি, আগ্রা, জয়পুর প্রভৃতি অঞ্চলে প্রচুর লাল বেলে পাথরের ইমারত নির্মাণ করা হতো। বাংলায় পাথর সহজলভ্য ছিল না। তাই লাল বৈশিষ্ট্য ধরে রাখার জন্য ইটের ভবনে লাল রং ব্যবহার করা হয়েছে। কার্জন হল পরবর্তীকালে বাঙালির আন্দোলন সংগ্রামেরও সাক্ষী ছিল। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানি শাসকরা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দু চাপিয়ে দিলে প্রতিবাদে বাঙালির ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। এই কার্জন হলেই পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার কথা পুনরায় উচ্চারণ করলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা তীব্র প্রতিবাদ জানায়। কার্জন হলের সাথে বঙ্গভঙ্গকে সম্পৃক্ত করলে ইতিহাসের একটি যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া সহজ।