ঢাকার কথা ১৯
মুসলমানি পুঁথিপট্টি
ঢাকার ছাপাখানায় পুস্তক প্রকাশনার যাত্রা উনিশ শতকের আগে শুরু হওয়ার কথা জানা যায় না। খ্রিস্টান মিশনারিদের ধর্মীয় পুস্তক এবং দু একটি হিন্দু সাহিত্যিকের গ্রন্থ প্রকাশ বাদ দিলে উনিশ শতকের প্রথম পর্বের শেষ দিকে এবং দ্বিতীয়ার্ধে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মুসলমান কবির রচিত পুঁথি প্রকাশিত হতে থাকে। এভাবে চকবাজারে ‘কেতাবপট্টি’ নামে পুঁথি প্রকাশ ও বিক্রয় কেন্দ্র গড়ে উঠেছিল।
সতের ও আঠারো শতকে মুসলমান কবিরা অনেক পুঁথি রচনা করেন। তখন ছাপাখানা ছিল না। এসব পুঁথি পাওয়া গেছে পাণ্ডুলিপি আকারে। তখন পুঁথি গ্রাম বাংলার শিক্ষিত অর্ধ শিক্ষিত মানুষের মুখের ভাষায় রচিত হতো। প্রচুর আরবি ফারসি শব্দ ব্যবহার করতেন কবিরা। এই ভাষা এক সময় মুসলমানি বাংলা নামে পরিচিতি পায়। চকবাজার থেকে প্রকাশিত পুঁথিগুলো সাধারণত একই আকৃতির হতো। গ্রামের মানুষ যাতে কুপির আলোতে সহজে এসব পুঁথি পড়তে পারে তাই ছাপা হতো অপেক্ষাকৃত বড় অক্ষরে। পুঁথির প্রচ্ছদ তৈরিতে ব্যবহার করা হতো সাদা অথবা রঙ্গিন কাগজ। চারদিকে লতাপাতা এঁকে অঙ্গসজ্জা করা হতো প্রচ্ছদপটে।
সাধারণ ক্রেতার কথা বিবেচনা করে এসব পুঁথির দাম ধরা হতো খুব কম। চকবাজারের পুস্তক প্রকাশকরা পুঁথির প্রচারের দিকে বিশেষ মনোযোগ দিতেন। শুরুর দিকে চকবাজারের পশ্চিম দিকে কয়েকটি পুস্তক বিপণি প্রতিষ্ঠিত হয়। এদিকে ছাপাখানাও স্থাপিত হয়েছিল। এর আগে এই পর্বে ছাপাখানার কথা লেখা হয়েছে। আসলে ছাপাখানাকে কেন্দ্র করেই পুঁথি প্রকাশের যাত্রা শুরু হয়।
উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে মুন্সি হায়দার জান নামের ঢাকায় একজন পুঁথি রচয়িতা ছিলেন। চকবাজারের মুসলমানি পুঁথিপট্টিতে তাঁর একটি দোকান ছিল। এই কবির রচিত কাব্যগ্রন্থের নাম ছিল ‘খলিল গোলজার’। পুঁথিপট্টির আরেক দোকানের মালিকের নাম মুন্সি আলিমুদ্দিন। তিনি প্রকাশ করেন কবি গোলাম মাওলার লেখা পুঁথি। তাঁর রচিত উল্লেখযোগ্য পুঁথিগুলো হচ্ছে-‘শাহরুমের কেচ্ছা’, ‘জেবল মুলক ও মেহের জামাল’ এবং ‘তজহিজ তকফিন’। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মুসলমানি পুঁথি প্রকাশিত হয়েছিল আজিজিয়া প্রেস থেকে। এই প্রেসের মালিক মুন্সি ফয়েজউদ্দিন নিজে একজন পুঁথিকার ছিলেন। তাঁর বইয়ের দোকান ছিল মোগলটুলিতে।
এ যুগে প্রকাশকরা পুঁথির মধ্যে নানাভাবে বইয়ের বিজ্ঞাপন দিতেন। যেমন মুন্সি ফয়েজউদ্দিন তাঁর ‘তালেনামা’ পুঁথিতে বিজ্ঞাপন দেন এভাবে, ‘এই সকল কেতাব যাহাদের দরকার হইবে তাহারা মোকাম ঢাকায় মোগলটুলি আমার কেতাবের দোকানে শ্রীযুক্ত হাফেজ মনিরুদ্দিন ছাহেবের নিকট কিম্বা ঠাটারুবাজার আমার বাটিতে তালাশ করিলে পাইবেন।” আবার মুন্সি আলিমউদ্দিনের দোকানের বিজ্ঞাপনের ভাষা ছিল এমন, “এই কেতাব যাহার আবিশ্বক হইবে তিনি অত্র শহরের চৌকবাজারের পশ্চিম অধীনের কেতাবের দোকানে তত্ত করিলে পাইবেন।”
মুসলমানি পুঁথিপট্টি ক্রমে চকবাজার ছাড়িয়ে অন্যত্রও বিস্তার লাভ করে। যেমন বেশ কয়েকটি দোকান ছিল মোগলটুলি, বড়কাটরা, ছোটকাটরা, চম্পাতলি, ইমামামগঞ্জ প্রভৃতি এলাকায়। এ যুগে বইয়ের দোকান ছাড়াও ছাপাখানা, প্রকাশক এবং লেখকের বাড়িতেও বই বিক্রি করা হতো।
পুস্তক প্রকাশ বা বিক্রি ছাড়াও ঢাকার পুঁথিপট্টির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল। তা হচ্ছে পুঁথিকারদের নিয়ে একটি সাহিত্য সংগঠনের উদ্ভব। এই সাহিত্য সংগঠন যাঁদের পদচারণায় মুখরিত হতো তাঁরা হচ্ছেন ফয়েজউদ্দিন, খোয়াজ ডাক্তার, মনিরউদ্দিন ডাক্তার, হায়দার জান, মোহাম্মদ জহিরউদ্দিন প্রমুখ। ঢাকার মুসলমানী পুঁথি রচয়িতারা তাঁদের পুঁথির পাঠকশ্রেণি তৈরি করতে পেরেছিলেন। ফলে ঢাকা ও আশপাশের অঞ্চলে পুঁথির সমাদর বেড়ে গিয়েছিল।