কাজির বিচার : হুমায়ুন কবিরের দুর্মতি
তথায় এমন এক লক্ষ বিংশতি সহস্রের অধিক মনুষ্য আছে, যাহারা দক্ষিণ হস্ত হইতে বাম হস্তের প্রভেদ জানে না; আর অনেক পশুও আছে।
—পবিত্র বাইবেল (পুরাতন নিয়ম, যোনা ৪: ১১)
হুমায়ুন কবির (১৯০৬-১৯৬৯) একদা ‘দ্বিগ্বিজয়ী ছাত্র’ পরিচয়ে বিখ্যাত হইয়াছিলেন। পরকালে তিনি জাঁদরেল সম্পাদক পরিচয়ে বাংলা সাহিত্যের সেবাশুশ্রূষা করেন। তাঁহার নাম বাংলা সাহিত্যের অগ্রগণ্য সমালোচক দলেও উচ্চারিত হইয়া থাকে। তবে দ্বিগ্বিজয়ী ছাত্রের পরিচিত গণ্ডি তিনি ছাড়াইয়া উঠিতে পারিয়াছিলেন বলিয়া মনে হয় না। কাজী নজরুল ইসলামের (এবং জসীম উদ্দীনের) কবিতা বিষয়ে তাঁহার মন্তব্যে সে সন্দেহই ঘনাইয়া ওঠে।
এক পর্যায়ে তিনি রাজনীতির সহিত জড়াইয়া পড়িয়াছিলেন। তাঁহার আত্মীয় আবু রুশদ জানাইতেছেন, ‘রাজনীতিতে তাঁর মন্ত্রগুরু ছিলেন মৌলানা আবুল কালাম আজাদ। ইসলামী শাস্ত্রে সুপণ্ডিত ও কোরান শরীফের তফসীর রচনার জন্য বিখ্যাত এই অভিজাত রাজনৈতিক নেতা তালতলার পীর সাহেবের সঙ্গে কোন এক আত্মীয়তাসূত্রে আবদ্ধ ছিলেন। তবে তিনি মনেপ্রাণে হিন্দু-মুসলিম সৌহার্দ্যে ও অবিভক্ত ভারতে বিশ্বাসী ছিলেন—সে বৈশিষ্ট্য পরবর্তীকালে হুমায়ুন কবিরের রাজনৈতিক জীবনে দীপ্যমান হয়ে উঠেছিল।’ (রুশদ ১৯৯৮: ৬১)
আবু রুশদ আরও বলিয়াছেন, আবুল কালাম আজাদ আর হুমায়ুন কবির—দুইজনেই—আজীবন ‘উদারপন্থী ও বিদ্যানুরাগী’ জওহরলাল নেহরুর অনুগত ছিলেন। কবির তাঁহার এক সময়ের সহপাঠী শান্তি দাশকে বিয়ে করেন। ধর্মে ইনি ব্রাহ্ম সম্প্রদায়ভুক্ত গণ্য হইতেন। ব্রাহ্মকন্যার সহিত এই বিবাহে কবিরের আত্মীয়স্বজন বিশেষ উষ্ণ সাড়া দেন নাই। হয়তো ইহাই নিয়তি।
নজরুল ইসলামের সহিত হুমায়ুন কবিরের পরিচয় ছিল। আবু রুশদের আত্মজীবনী পড়িয়া জানিতে পারিয়াছিলাম, একবার কবির তাঁহাকে সঙ্গে লইয়া নজরুল ইসলামের উত্তর কলিকাতার বাসায় উপস্থিত হইয়াছিলেন। আত্মজীবনীতে ঘটনার বিবরণ বেশ আছে।
নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ কবিতা পড়ে তার সম্পূর্ণ নতুন ধাঁচ ও পুরুষালী আবেগের প্রাবল্যে আমিও আর সব পাঠকের মতনই মোহিত আর আব্বাসউদ্দীনের কণ্ঠে কবির ইসলামী গান শুনে তাঁর প্রতি আমার কৌতূহল ও আগ্রহ তখন তুঙ্গে। নজরুল ইসলামকে দেখামাত্রই, তাঁর কিছুটা বাবুয়ানী সাজগোজ সত্ত্বেও, তাঁর ব্যক্তিত্ব আমাকে অভিভূত করে ফেলেছিল আর সেই যে তিনি হুমায়ুন মামার সঙ্গে কথা বলা শুরু করেছিলেন সে স্রোত আর কিছুতেই থামতে চায় না। এমনকি হুমায়ুন কবিরের মতো ধীমান লোককেও সেই বাচনের তোড়ে নিরব দর্শকের ভূমিকায় রূপান্তরিত হতে দেখলাম। (রুশদ ১৯৯৮: ১০০)
নজরুল ইসলাম বড় অসুখে পড়িবার পরও অনেকদিন পর্যন্ত হুমায়ুন কবির আমাদের কবির খোঁজ রাখিতেন। চিকিৎসার্থে তাঁহাকে যখন এয়ুরোপ লইয়া যাইবার আয়োজন চলিতেছিল তখন অভিপ্রেত জাহাজে স্থান পাওয়া কঠিন হইয়া দাঁড়ায়। ইহা ১৯৫০ সালের পরের কথা। কাজী আবদুল ওদুদ জানাইয়াছেন, ‘দিল্লীতে হুমায়ুন কবির সাহেবকে এই কথা জানান হয়।’ তাহার পর, ওদুদের দেওয়া খবর অনুসারে, সিন্ধিয়া কোম্পানির জাহাজে কবি, কবিপত্নী, পুত্র কাজী অনিরুদ্ধ, ‘নজরুল নিরাময় সমিতি’র প্রতিনিধি রবিউদ্দিন আহমদ ও স্বেচ্ছাসেবিকা লতিকা ঘোষের জন্য পাঁচখানি প্রথম শ্রেণীর টিকিট সংগ্রহ করা সম্ভব হয়। (ওদুদ ১৯৯০: ২০৪)
হুমায়ুন কবির নজরুল ইসলামের শুভানুধ্যায়ী ছিলেন—এ সত্যে সন্দেহ করার কারণ নাই। তবে নজরুল ইসলামের কবিতা তিনি খুব প্রাণ দিয়া ভালোবাসিতেন তেমন প্রমাণও পাইতেছি না। ভালো না বাসাটা অপরাধের মধ্যে গণ্য হইতে পারে না। তবে বুঝিতেও না পারাটা শ্লাঘার বিষয় কিনা ভাবিতে হইবে। কবিরের মতে নজরুল ইসলামকে ‘মহৎ কবি’ গণ্য করা যাইবে না। কোন যুক্তিতে তিনি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছিয়াছিলেন তাহা আমাদের কৌতূহলের বিষয়। বাংলা কবিতার বিচারে বসিয়া নিজের কিছু পূর্বধারণা ও বিশ্বাসের প্রকাশ ঘটাইয়াছিলেন তিনি। তথাপি তাঁহার প্রভাব অন্তত বাংলাদেশে ব্যাপক। এখানে তাঁহার এই বিশ্লেষণকে কেহ কেহ ‘আশ্চর্য’ ও ‘আক্ষরিক অর্থে অতুলনীয়’ ইত্যাদি বিশেষণে ভূষিত করিতে কুণ্ঠিত হন নাই। (মান্নান ২০১২: ১০)
এই নিবন্ধে আমরা দেখাইতে চাহি নজরুল ইসলাম (এবং জসীম উদ্দীন) প্রসঙ্গে হুমায়ুন কবিরের সিদ্ধান্ত কয়েকটা পূর্বধারণার উপর নির্ভরশীল। একটা ধারণা অনুসারে ১৯৪০ সালের মধ্যেও বাংলার মুসলমান সমাজে ‘মহৎ কবি’ জন্মাইবার মতন সামাজিক পরিবেশ তৈরি হয় নাই। তাঁহার দ্বিতীয় ধারণা, নজরুল ইসলাম কিংবা জসীম উদ্দীন কেহই অলোকসামান্য প্রতিভার অধিকারী ছিলেন না যাহার পিঠে সওয়ার হইয়া কবিরা পরিবেশ ও প্রতিবেশের বাঁধা ছাড়াইয়া উপরে উঠিতে পারেন। ইহার কারণ—আমাদের ধারণা—খানিক কবির অনুসৃত পদ্ধতির মধ্যে আর খানিক তাঁহার পূর্বধারণার অন্দরে পাওয়া যাইবে।
১
বাংলা ১৩৪৭ (ইংরেজি ১৯৪০) সালে ছাপা ‘বাংলার কাব্য’ পুস্তকের উপান্তে পৌঁছিয়া নজরুল ইসলাম বিষয়ে গোটা দুই মন্তব্য করিয়াছিলেন হুমায়ুন কবির। তিনি বলিয়াছিলেন, নজরুল ইসলামের ‘সৃজনীপ্রতিভা’ অল্পদিনেই শেষ হইয়া গিয়াছিল। মানস সংগঠনে রূপান্তর হয় নাই বলিয়াই এই অঘটন ঘটিতে পারিয়াছিল। শুদ্ধ নজরুল ইসলামের বেলায় নহে, হুমায়ুন কবির বিশ্বাস করিতেন এই অঘটন জসীম উদ্দীনের বেলায়ও ঘটিয়াছিল। ঘটনার একটা ব্যাখ্যাও তিনি দিয়াছিলেন। আমরা বিষয়টার আরো আলোচনা দরকার আছে মনে করি।
নজরুল ইসলাম ও জসীম উদ্দীনকে একসারিতে দাঁড় করাইয়াছিলেন হুমায়ুন কবির। ইহাতে তাঁহার বুদ্ধির পরিচয় আছে। কবিরের মতে উঁহাদের দুইজনই বিখ্যাত হইয়াছিলেন সেদিন পর্যন্ত মুসলমান মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অবিকশিত থাকিবার কারণে। দ্বিতীয় কারণ—তাঁহার মতে—তখনও বাংলাদেশের বিপুল মুসলমান কৃষক সম্প্রদায় পশ্চাদমুখী থাকিয়া গিয়াছিল।
এই নিপীড়িত জনসাধারণের আশা-আকাঙ্ক্ষা নিজের লেখায় ফুটাইয়া তুলিতে পারিয়াছিলেন বলিয়াই নজরুল ইসলাম নাম কুড়াইয়াছিলেন। কিন্তু সেই আশা-আকাঙ্ক্ষার চেহারাটা তিনি পাল্টাইতে পারেন নাই। দেশের গণমানস যেমন ‘কল্পনা ও আবেগের নতুন নতুন রাজ্য জয়ে অগ্রসর’ হইতে পারে নাই, নজরুল ইসলামের মানস সংগঠনও তেমন অচল থাকিয়া গিয়াছিল। ফলে তাঁহার ‘সৃজনীপ্রতিভা’ অল্পদিনেই নিঃশেষ হইয়া আসিল।
নজরুল ইসলাম বিষয়ে এই নিরূপণ জসীম উদ্দীনেরও ব্যাধি বলিয়া ব্যবস্থা দিলেন হুমায়ুন কবির। বাংলা ১৩৪৭ সাল নাগাদ তিনি দুইজনেরই জানাজা পড়িলেন আর এই বলিয়া শোক প্রকাশ করিলেন : ‘আজ আত্মকেন্দ্রিক পুনরাবৃত্তির মধ্যেই তাঁদের সাধনা নিবদ্ধ।’ (কবির ২০১২ : ৬৩)
হুমায়ুন কবিরের বিশ্লেষণ যদি যথার্থ হইয়া থাকে তো বলিতে হইবে নজরুল ইসলাম ও জসীম উদ্দীনের—উভয়ের—পতনের কারণ উঁহাদের উত্থানের মধ্যে লুকাইয়া ছিল। উঁহারা জনপ্রিয়তা লাভ করিয়াছিলেন মুসলমান মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অপরিপক্কতা এবং কৃষক শ্রেণীর পশ্চাদমুখিনতার কারণে। এই দুই শ্রেণীর অর্থাৎ নিপীড়িত বাঙ্গালি মুসলমান জনমানসের রূপান্তর ঘটাইতে পারেন নাই তাঁহারা। পারেন নাই নিজেদের মানস সংগঠনে রূপান্তর ঘটাইতেও। ফলে উঁহাদের নিয়তি অকালমৃত্যু। ‘আত্মকেন্দ্রিক পুনরাবৃত্তি’ তো মৃত্যুরই অপর নাম।
হুমায়ুন কবিরের ব্যাখ্যার প্রভাব অনেক লেখকের উপর পড়িয়াছে। ১৯৫১ সনে জসীম উদ্দীনের কবিতা ‘মাটির কান্না’ বাহির হইবার পর সৈয়দ আলী আশরাফ অনেকটা কবিরের প্রতিধ্বনি করিয়াই দাবি করিয়াছিলেন ‘নকশি কাথার মাঠ’ (১৯২৯) ও ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ (১৯৩৩) লিখিবার পর জসীম উদ্দীন আর নতুন কিছু লিখিতে পারেন নাই। আগের দুই লোকগাথায় তিনি সর্বসাধারণের একজন হইয়া লিখিয়াছিলেন। কিন্তু নতুন কবিতায় তিনি গরিবের জন্য চোখের দুই ফোটা পানি ফেলিয়াছেন মাত্র। অধিক কিছু করিতে পারেন নাই। উত্তরকালের জসীম উদ্দীন—আলী আশরাফ মনে করেন—লিখিয়াছেন জনগণের একজন হইয়া নয়, বাহিরের লোকে যেমন দরদ দেখায় তেমন আলগা দরদ দেখাইয়া।
আলী আশরাফের ধারণা, জসীম উদ্দীনের কল্পনাশক্তি তখনও নিঃশেষ হয় নাই, তবে দুঃখের মধ্যে তাহা অভিজ্ঞতার নতুন নতুন রাজ্য জয়ে আর অগ্রসর হইতেছে না। ১৯৬০ সালের দশকে ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ গাথার ইংরেজি তর্জমা করিয়াছিলেন ইংরেজ ভদ্রমহিলা বারবারা পেইন্টার। তিনি তাঁহার তর্জমার ভূমিকাচ্ছলে জানাইতেছেন, সৈয়দ আলী আশরাফের এই গর্হিত ব্যাখ্যা জসীম উদ্দীন মহান ঘৃণার সহিত ছুঁড়িয়া ফেলিয়াছিলেন। (আশরাফ ১৯৫৫, পেইন্টার ১৯৬৯ : ২৬)
হুমায়ুন কবিরের লেখাটা নজরুল ইসলাম আদৌ পড়িয়াছিলেন কিনা কিংবা পড়িলেও কতখানি বা তাহা আমাদের জানা নাই। পড়িলে তাঁহার মন্তব্যটা কি দাঁড়াইত কল্পনা করা কঠিন নহে। কবিরের মন্তব্য তিনি গ্রহণ করিতেন না বলিয়াই আমরা নির্ণয় করি। কেন করিতেন না তাহা বুঝাইয়া বলার অবকাশ আছে। নজরুল ইসলামের কবিতা বিচারের বেলায় হুমায়ুন কবির কোন মাপকাঠি প্রয়োগ করিয়াছেন তাহাও দেখার অবসর আছে।
২
একটু মনোসংযোগ করিলেই দেখা যাইবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা আলোচনার ক্রমে হুমায়ুন কবির যে মাপকাঠি হাতে লইয়াছিলেন নজরুল ইসলামের বেলায় সেই কাঠিটা হাতে রাখেন নাই। সেখানে তিনি অন্য মাপকাঠি প্রদর্শন করিলেন। রবীন্দ্রনাথের বেলায় তিনি কবির ‘দুরন্ত প্রাণশক্তি ও অফুরন্ত সৃজনীপ্রতিভা’ বিশ্লেষণ করা দরকার মনে করিয়াছেন। (কবির ২০১২ : ৪৮)
অথচ নজরুল ইসলামের বেলায় কোন কারণ না দর্শাইয়াই তিনি লিখিয়াছেন, ‘তাঁর সাহিত্যসৃষ্টির প্রসঙ্গেও ব্যক্তিগত প্রতিভার বিচার অবান্তর, কারণ প্রতিভা সকল ক্ষেত্রেই অলৌকিক হলেও সামাজিক প্রতিবেশেই তার প্রকাশ। তাই সাহিত্য বিচারে একমাত্র সামাজিক পশ্চাদপট নিয়েই আলোচনা চলতে পারে।’ (কবির ২০১২ : ৬১-৬২)
অথচ, কবির লিখিতেছেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাব্য বিচারে এই নিয়মটি চলিবে না। কেননা তাঁহার প্রতিভা অলৌকিক। কথাটি ভাবিবার মতন। ঠাকুর প্রসঙ্গে কবির লিখিতেছেন, ‘রবীন্দ্রনাথ নিজে অভিজাত। ধ্বংসোন্মুখ সামন্ততন্ত্রের আবহাওয়ার সঙ্গে তাঁর পরিচয় এত নিবিড় যে বাংলার সেদিনকার বিলীয়মান সামন্ততন্ত্রের প্রতি মোহ তাঁর মনে জাগেনি, জাগতে পারেনি। শুধু তাই নয়, পলাশীর যুদ্ধের পর থেকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত, লাখেরাজ বাজেয়াপ্তি এবং ভাষা-বিপ্লবের মধ্য দিয়ে যে সামাজিক রূপান্তর শুরু হয়েছিল, উত্তরাধিকার সূত্রে তার প্রত্যেকটি ধারায় তিনি অবগাহন করেছেন, এবং অবগাহন করেছেন বলেই সেদিনকার সমাজমানসের দুর্বলতা অতিক্রম করা তাঁর পক্ষে সহজ না হলেও সম্ভব হয়েছিল।’ (কবির ২০১২ : ৪৪)
রবীন্দ্রনাথের কবিতা বিচারে হুমায়ুন কবির ব্যক্তিগত প্রতিভার জোরে সমাজমানস অতিক্রমের দৃষ্টান্ত দেখিতে পাইলেন আরও একবার। তিনি দাবি করিলেন, রবীন্দ্রনাথ অভিজাত (কিংবা সামন্ত) শ্রেণীর সন্তান হইয়াও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর প্রতিনিধি। আবার একই সাথে মধ্যবিত্ত মানসকেও তিনি অতিক্রম করিবার প্রয়াস করিয়াছেন। ইহার অর্থ দাঁড়ায় মানুষ ইচ্ছার প্রকোপে পড়িলে পরিবেশ ও প্রতিবেশ ছাড়াইয়া উঠিতে পারে। রবীন্দ্রনাথের প্রতিভা কিভাবে এই অসম্ভবকে সম্ভব করিল তাহার বয়ান কবির করিয়াছেন এই অবসরে।
মোগল সাম্র্রাজ্যের পতনের পরে যে রাষ্ট্রিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিপ্লব শুরু হয়েছিল, তার স্বাভাবিক পরিণতি ধনতন্ত্র ও রাষ্ট্রিক স্বাধীনতার প্রতিষ্ঠা। ভারতের জাতীয় জীবনে কিন্তু এ স্বাভাবিক পরিণতি ঘটেনি। পলাশীর যুদ্ধের অল্পদিন পরেই চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত, ভারতীয় শিল্প-বাণিজ্যের অবসান ও ভাষা-বিপ্লবের মধ্যে এ সুদূরপ্রসারী বিপ্লবের সম্ভাবনা নষ্ট হয়ে গেল। তবু যে সামাজিক বিপ্লব ঘটেছিল, তার ফলে হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সম্প্রসারণ বিস্ময়কর গতিতে শুরু হল, কিন্তু এ সম্প্রসারণের মধ্যেই পরাজয়ের বীজ নিহিত ছিল। জমিদারি এবং চাকুরির প্রতি অতিরিক্ত মোহে বর্ধনশীল সমাজে এল স্থিতিশীলতা এবং তার ফলে জীবনচাঞ্চল্যের মধ্যেও স্থিতিশীল হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ভাগ্য বিপর্যয়ের পূর্বচ্ছায়া দেখা দিল। সকলের চোখে তা ধরা পড়েনি, কিন্তু সমাজসত্তার শ্রেষ্ঠ প্রতীক রবীন্দ্রনাথের কাব্য যে এই অতৃপ্তির সুরে মুখর হয়ে উঠবে, তাতে আশ্চর্য হবার কারণ নাই। (কবির ২০১২ : ৪৭-৪৮)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অভিজাত শ্রেণীর সদস্য হইলেও তাঁহার রচনায় কিভাবে ভাগ্যবিপর্যস্ত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ‘আশা, আবেগ ও আকুতি’ মূর্তি পাইল সে প্রশ্নের উত্তর লিখিতে বসিয়া হুমায়ুন কবির শেষ পর্যন্ত ‘রবীন্দ্রনাথের দুরন্ত প্রাণশক্তি এবং অফুরন্ত সৃজনীপ্রতিভা’র আশ্রয় গ্রহণ না করিয়া পারেন নাই। তিনি যোগ করিয়াছেন : ‘এই অফুরন্ত প্রাণশক্তি এবং দেশের সমগ্র জীবনের মধ্যে তাঁর শিকড় ছিল বলেই পরবর্তীকালের রবীন্দ্রকাব্যে মধ্যবিত্ত মানসকে অতিক্রম করবার প্রয়াসের পরিচয় মেলে।’ (কবির ২০১২ : ৪৮)
বাক্য এতখানি সম্প্রসারণের পরও হুমায়ুন কবির অবশ্য স্বীকার করিতে একপ্রকার বাধ্য হইলেন, রবীন্দ্রনাথের সৃজনীপ্রতিভাও এক পর্যায়ে ফুরাইয়া গেল : ‘অসহযোগ আন্দোলনের যুগে ভারতবর্ষের জীবনধারায় সে বিপুল আলোড়ন জাতির প্রায় সমস্ত স্তরকেই তা স্পর্শ করেছিল। মহাত্মা গান্ধীর মন্ত্রবলে কুম্ভকর্ণের নিদ্রাভঙ্গ যেন আসন্ন হয়ে উঠল, দিকে দিকে তার চাঞ্চল্য নির্জীবকেও চঞ্চল করে তুলল। বাংলাদেশে কিন্তু এ জাগরণের যুগেও স্বদেশী যুগের মতো সমৃদ্ধ সাহিত্য না দেখে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে তার কারণ কি? ’ এতটুকু লিখিবার পর, রবীন্দ্রনাথ এই নবজাগরণে সাড়া দিতে পারেন নাই একথা প্রত্যক্ষে না বলিয়া ভদ্রতার খাতিরে কবির পরোক্ষে লিখিলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ অবশ্য এ নবজাগরণেও পরোক্ষ সাড়া দিয়েছিলেন।’ (কবির ২০১২ : ৬১)
গদ্যকবিতা রচনার সাধনা, পূরবী, মুক্তধারা, রক্তকরবী গয়রহ রচনা রবীন্দ্রনাথের উত্তরকালীন এই সমস্ত প্রয়াসের উল্লেখ সারিবার পর কবির বহুকষ্টে কবুল করিলেন, ‘তবু রবীন্দ্রনাথ অসহযোগ আন্দোলনের কবি নন।’ এই বিনয়-পরিপাটির পর মাত্র হুমায়ুন কবির নজরুল ইসলামের উল্লেখ করিতে প্রস্তুত হইলেন। তিনি লিখিলেন, ‘অসহযোগ আন্দোলনের আলোড়ন বাংলা কাব্যে বোধ হয় নজরুল ইসলামের মধ্যেই সবচেয়ে বেশি জেগেছিল এবং সেই জন্যই বর্তমান শতাব্দীর তৃতীয় দশকে তাঁর এত প্রতিষ্ঠা।’ (কবির ২০১২ : ৬১)
এই জায়গায় তিনি যাহা লিখিয়াছিলেন তাহা আমরা একটু উপরেও একবার উল্লেখ করিয়াছি। নজরুল ইসলামের সাহিত্যসৃষ্টি প্রসঙ্গেও কবিরের ধারণা ‘ব্যক্তিগত প্রতিভার বিচার অবান্তর,’ ‘কারণ প্রতিভা সকল ক্ষেত্রেই অলৌকিক হলেও সামাজিক প্রতিবেশেই তার প্রকাশ।’ তবে কথা থাকে, সামাজিক আন্দোলনের বিকাশ ও বিনাশ দুইটাই সামাজিক শ্রেণীর মনে।
হুমায়ুন কবিরের বিচারে ১৯২০ সালের দশকে বহুলদৃষ্ট অসহযোগ আন্দোলনের ব্যর্থতার কারণ স্ববিরোধী দ্বন্দ্বে বিভক্ত হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মনে পাওয়া যাইবে। তাঁহার কথায়, ‘গান্ধীজীর আবেদন ছিল দেশের বিপুল জনসাধারণের লুপ্তসত্তার পুনরুজ্জীবন, কিন্তু তার জন্য প্রয়োজন মধ্যবিত্ত শ্রেণী-মানসের স্বধর্মচ্যুতি।’ অথচ তিনি জানেন, ‘সাম্প্রতিক ব্যবস্থার সংরক্ষণেই যাদের স্বার্থ, তারা চিরদিনই পরিবর্তনবিরোধী।’ (কবির ২০১২ : ৬২)
তো প্রশ্ন জাগিবে, নজরুল ইসলাম এই অসহযোগ আন্দোলনের কবি হইলেন কি করিয়া? ‘মুসলমান মধ্যবিত্ত শ্রেণী সে সময়ে অপেক্ষাকৃত তরুণ এবং সেজন্য আশাবাদী’ লিখিতেছেন হুমায়ুন কবির।তাঁহার কথায়, ‘তার সামাজিক সত্তাও নানা কারণে দ্বিধাবিভক্ত হয়নি। সমাজজীবনের এই ঐক্যে নজরুল ইসলামের প্রতিশ্রুতির মূল প্রতিষ্ঠিত এবং সেই জন্য দেখি যে নিপীড়িত জনমানসের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে রূপ দেবার সাধনা তাঁর রচনায় সবল কণ্ঠে ফুটে উঠেছিল।’ নজরুল ইসলামের প্রতিভা বলিয়া কিছু যদি থাকিয়াও থাকে তাহা তিনি দেখিলেন নিছক ‘পুরাতন ঐতিহ্যের পুনরুজ্জীবনের মধ্যে’।
এই পুনরুজ্জীবনের মধ্যে নতুনের যে দোলা তাহা তিনি কোনদিন ধরিতে চাহেন নাই। হুমায়ুন কবির এখানেও লিখিলেন, ‘ঐতিহ্যের লঙ্ঘন তিনি করেননি পুরাতন পুঁথি সাহিত্যের আবহাওয়ার লালিত বলে বাংলার বিপুল মুসলমান কৃষক সম্প্রদায়ের সঙ্গে তাঁর সহজ আত্মীয়তা। ভাষা ও ভঙ্গিতে নজরুল ইসলামের কাব্যে যে বিপ্লবধর্ম পুরাতন ঐতিহ্যের পুনরুজ্জীবনের মধ্যেই তার পরিচয় মেলে।’ (কবির ২০১২ : ৬৩)
নজরুল ইসলামের প্রতিভা পুরাতন ঐতিহ্যের পুনরুজ্জীবন পর্যন্ত গিয়াছে, তাহার অধিক যাইতে পারে নাই হুমায়ুন কবিরের কহতব্য এইটুকুই। কবির দেখা যাইতেছে নজরুল ইসলামকে মহৎ কবির মধ্যে গণনা করিতে ভুলেও প্রস্তুত নহেন। তিনি লিখিয়াছেন: ‘কালক্রমে মুসলমান মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সম্প্রসারণের সম্ভাবনা অত্যন্ত সংকীর্ণ এবং সেইজন্য বর্তমান সামাজিক পরিস্থিতির মধ্যে মুসলমান সমাজে মহৎ কবির আবির্ভাবের সম্ভাবনাও অত্যন্ত অল্প।’ প্রতিভার যে শক্তি এই সংকীর্ণ পশ্চাদপটের সম্প্রসারণ করিতে বা রূপান্তর ঘটাইতে পারে সে শক্তিও নজরুল ইসলামের নাই। বাঙ্গালি মুসলমান সমাজে অন্য কাহারো বা নাই। থাকিতে পারে না। হুমায়ুন কবির বলেন, ‘বর্তমানে তার সমস্ত উদ্যম সমাজ-সংগঠনের কাজেই ব্যয় হয়ে যায়, সাহিত্যসৃষ্টির জন্য আর কিছু বাকি থাকে না। সেই জন্যই সাম্প্রতিক বাঙ্গালি মুসলমান কবিদের মধ্যে প্রায় সকলেই পশ্চাদমুখী এবং নতুনের প্রচেষ্টা সত্ত্বেও প্রাচীনপন্থী।’ (কবির ২০১২ : ৬৩)
অসহযোগ আন্দোলনের যুগে বাঙ্গালি হিন্দু মনের যে দ্বিধাবিভক্তি হুমায়ুন কবির নিরূপণ করিয়াছিলেন সে বিভক্তি কিন্তু বাঙ্গালি মুসলমান মধ্যবিত্ত শ্রেণীকেও ছাড়ে নাই। সত্য কথাই লিখিয়াছিলেন তিনি : ‘বর্তমানেও মুসলমান সমাজে মধ্যবিত্ত শ্রেণী প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টাই প্রবলভাবে চলেছে। রাষ্ট্রিক, আর্থিক ও মানসক্ষেত্রে সর্বত্রই তার লক্ষণ স্পষ্ট, কিন্তু ইতিহাসের বিবর্তনে মধ্যবিত্ত শ্রেণী আজ প্রতিক্রিয়াপন্থী। তার ঝোঁক অতীতের দিকে, তার ধর্ম প্রচলিত ব্যবস্থার সংরক্ষণ। ইসলামের অন্তর্নিহিত সামাজিক সাম্যকেও তা ব্যাহত করে। দোটানার মধ্যে বাংলার মুসলমান সমাজ তাই অনিশ্চিতমতি ও গতিহীন।’ (কবির ২০১২: ৬৩)
এই দুই নিরূপণের কালি শুকাইতে না শুকাইতেই হিন্দু ও মুসলমান সমাজের বিচ্ছেদ চূড়ান্ত হইল। নকশিকাঁথার টানা ও পড়িয়ান খুলিয়া গেল। হুমায়ুন কবিরের আত্মবিশ্বাস এতই প্রবল হইয়াছিল যে নিজের লেখার মধ্যে ক্রুশের কাঁটার মত একটা কলংক যে ঢুকিয়া পড়িয়াছে, নজরুল ইসলাম যে একটা বিপ্লব ঘটাইয়াছেন এবং সে বিপ্লব যে নিরন্তর বর্তমান এবং তাহা তিনি যে দেখিতেই পান নাই সে কথা খেয়াল করিলেন না। তাঁহার ভবিষ্যদ্বাণী এ অর্থে সত্য হইল।
‘বাংলার কাব্যে’র প্রথম সংস্করণের আঠার বছর পর নতুন ভূমিকাচ্ছলে তিনি লিখিলেন, ‘যখন বইখানি লিখি ভারতবর্ষ তখনও স্বাধীন হয়নি বাংলাদেশ দ্বিখণ্ডিত হয়ে দুটি বিভিন্ন রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়নি।স্বাধীনতার সঙ্গে পরিবর্তন আসবে এটা স্বাভাবিক।’ মজার মধ্যে, দ্বিখণ্ডিত রাষ্ট্র আবার অখণ্ড হইবে এমন আশা তিনি কদাচ প্রকাশ করেন নাই। তবু তাঁহার বইখানি যে এত রক্তপাত, এত মন্বন্তর, এত ঘটনার পরও রাষ্ট্রবিভাগের বাধা-বন্ধন অতিক্রম করে বাঙ্গালির কাব্যসাধনার ঐক্য ও ধারাবাহিকতাকে মূর্ত করে তুলবে—এ আশা করিতে তিনি ত্রুটি করেন নাই। (কবির ২০১২: ১৩)
৩
হুমায়ুন কবিরের সমসাময়িক আরেক নামজাদা বিচারক আবু সয়ীদ আইয়ুব এহেন কোন আশার ধারই ধারেন নাই। বাঙ্গালি মুসলমান লেখকদের সম্বন্ধে অন্তত সেদিনের লেখকদের সম্বন্ধে ইঁহার মনে বিশেষ শ্রদ্ধার জন্ম হয় নাই। হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের সহিত হাত মিলাইয়া ইনি ১৯৪০ সালের জুলাই নাগাদ ‘আধুনিক বাংলা কবিতা’ নামে একটা প্রভাবশালী সংকলন সম্পাদনা করিয়াছিলেন।
আইয়ুবের ‘আধুনিক বাংলা কবিতা’ উৎসর্গিত হইয়াছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শ্রীচরণে। ঐ সংকলনের ভূমিকাচ্ছলে আইয়ুব অন্যান্যের মধ্যে নজরুল ইসলামের নামটাও একবার লইয়াছিলেন। মানে আধুনিক কবিগণের তালিকায় নজরুল ইসলামের নাম তিনি কবুল করিয়াছিলেন। সংকলনে নজরুল ইসলামের গোটা পাঁচ কবিতাও স্থান পায়। তারপরও বলিতে হইবে নজরুল ইসলামের কি ঐতিহাসিক কি শিল্পতাত্ত্বিক কোন তাৎপর্যই আইয়ুব সমঝিতে পারেন নাই।
আধুনিক বাংলা কবিতা তাহা হইলে কি বস্তু? এই প্রশ্নের জওয়াবে আইয়ুব সংলনের ভূমিকায় লিখিয়াছিলেন, ‘কালের দিক থেকে মহাযুদ্ধ-পরবর্তী এবং ভাবের দিক থেকে রবীন্দ্রাপ্রভাবমুক্ত, অন্তত মুক্তিপ্রয়াসী, কাব্যকেই আমরা আধুনিক কাব্য বলে গণ্য করেছি।’ (আইয়ুব ১৯৪০ : ৮)
চকিত দৃষ্টিতে যদি আপনি ভাবিয়া থাকেন ইনি নজরুল ইসলামের মাপেই জামাটা সেলাই করিতেছেন তো ভুল করিবেন। নজরুল ইসলাম বাংলা কবিতায় কি বস্তু যোগ করিয়াছেন রবীন্দ্রনাথের ‘মায়াজাল’ কাটাইতে তাঁহার কি ভূমিকা তাহা দেখা যাইতেছে আইয়ুব ধরিতেই পারেন নাই। তিনি উঁহাকে একদিকে যেমন যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের জোড়া আকারে হাজির করিতেছেন, অন্যদিকে আবার তেমনি যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মাথার উপরে দিব্য জ্বলিতেছেন তাঁহার শীতল ছায়ায় দাঁড়ও করাইয়া দিলেন।আইয়ুবের বিচারের নমুনা এমনধারা :
বর্তমান শতাব্দীর প্রথম দুই দশকের কবিতা যে মোটের উপর রবীন্দ্রকাব্যেরই প্রতিধ্বনি, এতে সন্দেহ করা চলে না এবং আক্ষেপও করা যায় না যখন আমরা স্মরণ করি, রবীন্দ্রনাথের প্রতিভা বাংলার মতন দীন সাহিত্যকে ঋদ্ধির কোন স্তরে নিয়ে এসেছে। তৃতীয় দশকে নজরুল ইসলাম, যতীন সেনগুপ্ত প্রভৃতির শক্তি ও সাহসের ফলে সে-সর্বজয়ী প্রতিভার একচ্ছত্র সাম্রাজ্যে বিদ্রোহ ঘোষণা করে নবীন বাঙ্গালি কবিদের নিজেকে চিনবার এবং চেনাবার সুযোগ দেখা দিল। রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং বিদ্রোহী দলে যোগ দিয়ে তাকে আশাতীত মর্য্যাদা দান করলেন। গদ্যরীতির প্রচলন করে, কাব্যের বিশিষ্ট ভাষা বর্জন ক’রে, কবিকুলপরিত্যক্ত অসুন্দর প্রাকৃতিক ও মানবিক পরিবেষকে গ্রহণ করে, তিনি নিজের ঐতিহ্য নিজেই ভেঙেছেন। তার স্থানে নতুন কোন ঐতিহ্য এখনো গড়ে ওঠেনি, অদূর ভবিষ্যতে গড়ে ওঠবার কোন লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। যুদ্ধপরবর্তী মেজাজ ঐতিহ্যগঠনের অনুকূল নয়। (আইয়ুব ১৯৪০: ৮)
আইয়ুবের এই বয়ানের সহিত হুমায়ুন কবিরের বাহানা বেশ মিলিয়া যায়। এই সাদৃশ্যের কারণ আবু রুশদ কিছু পরিমাণে ধরিতে পারিয়াছিলেন বলিয়াই মনে হয়। আবু রুশদ বয়ান করিতেছেন : ‘সেই সময় কোন এক সূত্রে আর একটা উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্বের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়ে যায়, আবু সয়ীদ আইয়ুব। তখনও তিনি সমালোচক হিশেবে ততটা পরিচিত হননি, পরিচিত মহলে রুচিশীল বিদগ্ধ পাঠক ও পণ্ডিত বলেই তাঁর প্রতিষ্ঠা ও খাতির ছিল।’
আবু রুশদের মতে, ‘বাঙ্গালি মুসলমান লেখকদের সম্বন্ধে আইয়ুব সাহেবের নিঃসন্দেহে কিছুটা উন্নাসিক ভাব ছিল আর পরবর্তীকালে তাঁর মধ্যে দেখা গিয়েছিল রবীন্দ্রনাথের প্রতি অতিরিক্ত নমঃ নমঃ ভাব।’
ইহার পর আবু রুশদ একটু রূঢ়ই হইয়াছেন : ‘“পান্থজনের সখা” পড়ে আমার মনে হয়েছিল আইয়ুব প্রশস্তিকেই সমালোচনা বলে ধরে নিয়েছিলেন আর তাঁর গদ্যও খুব দৃঢ়ভিত্তিক ছিল তাও কিন্তু আমার মনে হয়নি। রবীন্দ্রনাথে সব জীবন-জিজ্ঞাসারই উত্তর আছে এ কথা যদি কোন সমালোচক বিশ্বাস করেন অন্য কারুরই তা নিয়ে আপত্তি করবার কিছু নেই, তবে সেই বিশ্বাসটা কোন রবীন্দ্রসমালোচক এ পর্যন্ত যুক্তি বিশ্লেষণ ও উদাহরণের ভিত্তিতে দাঁড় করাতে পেরেছেন বলে আমার জানা নেই।’ (রুশদ ১৯৯৮: ১০১)
১৯২০ সালের দশকে ঢাকার প্রবীণ কবি কায়কোবাদ (১৮৫৭-১৯৫২) একবার অনুযোগ করিয়াছিলেন, বঙ্গভাষার এই দুর্দিনে উপযুক্ত ও নিরপেক্ষ কোন সমালোচক নাই। যাঁহারা আছেন তাঁহাদের শক্তিও ততদূর কার্যকরী নহে।এখন শূন্য আসর, যাহার [যাহা] ইচ্ছা তাহাই লিখিয়া থাকে, বাধা দিবার কে আছে? (কায়কোবাদ ১৩৮০ : ২৩১)
হুমায়ুন কবির ও আবু সয়ীদ আইয়ুবের উদাহরণ দেখিয়া মনে হইতেছে কায়কোবাদ ভবিষ্যত দ্রষ্টাও কম ছিলেন না।
দোহাই
১. কাজী আবদুল ওদুদ, ‘ইয়োরোপে নজরুল,’ কাজী আবদুল ওদুদ রচনাবলী, আবদুল হক (সম্পাদিত), ২য় খণ্ড (ঢাকা : বাংলা একাডেমী, ১৯৯০), পৃ. ২০৩-২০৮।
২.আবু রুশদ, আত্মজীবনী: ১৯১৯-১৯৮৮ (ঢাকা : এ্যাডর্ন প্রকাশনী, ১৯৯৮)।
৩. হুমায়ুন কবির, বাঙলার কাব্য, ২য় সংস্করণ (ঢাকা: বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, ২০১২)।
৪. আবদুল মান্নান সৈয়দ, ‘মুখবন্ধ,’ হুমায়ুন কবির, বাঙলার কাব্য, ২য় সংস্করণ (ঢাকা: বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, ২০১২), পৃ. ৫-১০।
৫. আবু সয়ীদ আইয়ুব ও হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় (সম্পাদিত), আধুনিক বাংলা কবিতা (কলিকাতা : দেজ পাবলিশিং, ১৯৪০)।
৬. কায়কোবাদ, অশ্রুমালা, ৬ষ্ঠ সংস্করণ, পুনর্মুদ্রণ (ঢাকা : বাংলাদেশ বুক করপোরেশন, ১৩৮০)।
৭. পবিত্র বাইবেল : পুরাতন ও নতুন নিয়ম পুনর্মুদ্রণ (ঢাকা : বাংলাদেশ বাইবেল সোসাইটী, ১৯৮৮)।
৮. Jasim Uddin, Gipsy Wharf (Sojan Badiar Ghat), trans. Barbara Painter and Yann Lovelock (London: George Allen and Unwin, 1969).
৯. Syed Ali Ashraf, Contemporary Poetry and Prose Fiction in East Pakistan, Literary Scene in East Pakistan(P.E.N., 1955).
(প্রবন্ধে লেখকের বানানরীতি অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে।– বিভাগীয় সম্পাদক)