সাদাদের অস্কার ও পরিবর্তনের ডাক
অস্কারের মনোনয়ন তালিকা প্রকাশের পর কয়েক বছর ধরেই দেখা যাচ্ছে এ নিয়ে নানা অভিযোগ, উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠার বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে। বিশেষত মনোনয়নের তালিকায় বৈচিত্র্যের অভাব আর বর্ণ বিদ্বেষের অভিযোগ বরাবরই তীব্র ও সুনির্দিষ্ট। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। এবারও অভিযোগ উঠেছে এই অস্কার ‘সাদাদের অস্কার’। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে ‘অস্কারসোহোয়াইট হ্যাশট্যাগ’ দিয়ে প্রতিবাদ করছেন অনেকেই। উইল স্মিথ দম্পতিসহ বেশ কয়েকজন সেলিব্রেটি অস্কার অনুষ্ঠান বর্জনের ঘোষণাও দিয়ে দিয়েছেন এরই মধ্যে।
এসব ব্যাপার নিয়ে সম্প্রতি উইনিভার্সিটি অব স্টার্লিংয়ের ‘ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়া’ বিভাগের লেকচারার ক্যাথেরিনা লিন্ডারের একটি গবেষণাধর্মী আর্টিকেল প্রকাশিত হয় যুক্তরাজ্যের বিখ্যাত ‘দি ইনডিপেনডেন্ট’ পত্রিকায়। যেখানে তিনি বলেন, ‘গত ১৪ জানুয়ারি যখন একাডেমি অব মোশন পিকচার আর্টস অ্যান্ড সায়েন্সেস ২০১৬-এর অস্কারের মনোনয়ন তালিকা প্রকাশ করে, সেখানে বরাবরের মতোই দৃষ্টিকটু আধিক্য দেখা যায় ‘সাদা’ অভিনেতাদের। হতে পারে এই বছর সব সাদা অভিনেতাই প্রশংসনীয় অভিনয় করেছেন কিন্তু বিগত ২০ বছরের ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় সব অ্যাক্টিং ক্যাটাগরী মিলিয়ে সর্বমোট মনোনয়নের মাত্র ৮% পেয়েছেন কালো অভিনেতা-অভিনেত্রীরা। যা শুধু একটি পরিসংখ্যানের চেয়ে অনেক বেশি কিছু প্রকাশ করে।’ স্বনামধন্য এই বিশ্লেষক অভিযোগ করে বলেন, ‘মনোনয়ন ঘোষণার পর এ নিয়ে পত্রপত্রিকায় অনেক ‘সাদা’ লেখকই সমালোচনা করেন অস্কারের, যেখানে তাঁরা অভিযোগ করেন অস্কারে নারী এবং গোত্রীয় সংখ্যালঘুদের অনুপস্থিতি ইত্যাদি নিয়ে। কিন্তু এই বর্ণবৈষম্য নিয়ে কেউই তেমন জোরালো ভাবে কথা বলেননি। তাঁর মতে, পর্দার পেছনে এই নিয়ে চলছে বিরাট রাজনীতি।
সাদাদের অস্কার, হলিউডের বক্তব্য কী? সাধারণ দর্শক কিংবা সমালোচকদের চেয়ে এই বিষয়টি নিয়ে অনেক বেশি বিরক্তি আর উষ্মা প্রকাশ করেছেন কালো নির্মাতা আর কলাকৌশলীরা। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য অস্কারকে ‘লিলি-হোয়াইট’ নামে আখ্যায়িত করা বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা স্পাইকলির। অভিনেতা জাডা পিঙ্কেটের সাথে এই নির্মাতা ঘোষণা দেন অস্কার অনুষ্ঠান বর্জনের। পিঙ্কেট স্মিথ ডাক দিয়েছেন গণ-বয়কটের। তাঁর মতে বর্ণবাদী এই অনুষ্ঠানে কারোরই অংশগ্রহণ করা উচিত নয়।
একাডেমির প্রেসিডেন্ট, Cheryl Boone Isaacs অবশ্য এরইমধ্যে এই বিষয়ে ক্ষমা চেয়ে একটি পাবলিক চিঠি প্রকাশ করেন। যেখানে এই বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাসও দেন তিনি। একাডেমি কমিটিতে বৈচিত্র্য আনারও অঙ্গীকার করেন তিনি।
বদলে যাওয়া পুরস্কারের সংস্কৃতিটা আসলে কেমন? জন্মসূত্রে বুন আইজাক আফ্রিকান- আমেরিকান নারী, যিনি ২০১৩ সাল থেকে একাডেমি অব মোশন পিকচার আর্টস অ্যান্ড সায়েন্সেসের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করছেন। ৯৪% সাদা আর ৭৭% পুরুষের (যাদের মাত্র ১৪% ভোটারের বয়স ৫০-এর নিচে) সমন্বয়ে ঘটিত একাডেমি কমিটির মুখপাত্র হিসেবে তাঁর উপস্থিতি সামান্য হলেও স্বস্তিদায়ক।
চলচ্চিত্র বিশ্লেষকদের অনেকেই মনে করেন, একাডেমি কমিটির সদস্যদের বৈচিত্র্যই একমাত্র পরিবর্তন করতে পারে অস্কারের এই বর্ণবাদী সংস্কৃতির, চলচ্চিত্র নির্মাণ আর অনুশীলনকে করে তুলবে আরো বিস্তৃত এবং গ্রহণযোগ্য। কারণ একমাত্র পুরস্কারপ্রাপ্তিই কখনো একটি ছবির শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ করে না বরং যাদের ভোট এই শ্রেষ্ঠত্ব নির্ধারণ করে তাদের পছন্দ- রুচিকেই প্রকাশ করে বেশি।
কিন্তু একাডেমি মেম্বার, ভোটার কিংবা মনোনীতদের তালিকা পরিবর্তন হলেই কি বদলে যাবে সব? যদি তা করা হয় তবে তা হবে ক্ষতের কারণ না দেখে, শুধু ক্ষততে মলম লাগানোর মতোই। অস্কারের এই বর্ণবাদী সংস্কৃতির পরিবর্তনের জন্য দরকার পুরো হলিউড ইন্ড্রাস্ট্রির মানসিকতার পরিবর্তন- স্বীকার করেছেন স্বয়ং বুন আইজ্যাক। শুধু বৈচিত্র্য আনয়নের কথা বলেই থেমে থাকেননি তিনি, পরিবর্তন এনেছেন সদস্যপদের সর্বোচ্চ সংখ্যার সীমারেখার আইনে, অন্তর্ভুক্ত করেছেন বিভিন্ন বয়স, পেশা আর জীবনধারার ভোটারদের। এ-২০২০ নামে একটি প্রকল্পও হাতে নিয়েছেন তিনি, যার উদ্দেশ্য এই পাঁচ বছরের মধ্যে একটি বৈচিত্র্যময় আর সমৃদ্ধ হলিউড বিনির্মাণ। কিন্তু বর্ণবাদ আর বৈষম্য যে সিস্টেমের মজ্জাগত বৈশিষ্ট্য, সে সিস্টেমকে একা কতটা পরিবর্তন করতে পারবেন তিনি? এই প্রশ্ন থেকেই যায়।
হলিউডের ইতিহাসে বেশির ভাগ ছবিতেই দেখা যায়, নারী এবং বিভিন্ন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে ‘খাটো করে’ উপস্থাপন করা হয়। শুধু কালো পরিচালক বা প্রযোজকের পরিমাণ বৃদ্ধি করেই সম্ভব নয় এর সমাধান করা, সম্ভব নয় শুধু কালোদের বেশি বেশি পুরস্কৃত করেও। বরং তাদের ঘিরে যে দৃষ্টিভঙ্গি তার পরিবর্তন, চরিত্র রূপায়ণে ভিন্নতা , গতানুগতিক চেতনার বাইরে গিয়ে কাজ করাই সমাধান করতে পারে এর।
ক্যাথেরিনা লিন্ডার তাঁর আর্টিকেলটি শেষ করেছিলেন এই বলে, ‘আমি সতর্কতার সাথে আশাবাদী যে ক্রমবর্ধমান ক্ষোভ আর সচেতনতা এই পরিবর্তন প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিবে এবং সফল সমাপ্তি হবে এর, যাতে আগামী বছর অথবা তাঁর পরের বছর এই বিষয় নিয়ে নতুন করে আরেকটি প্রবন্ধ লিখতে না হয়।’