হাসান আজিজুল হক লিখিত ‘সক্রেটিস’ গ্রন্থটি সামনে রেখে
‘তার কাছে গেলে চৈত্রের রক্তে-চামড়ায় বর্শা গেঁথে দেওয়া রোদের দুপুরে বটগাছের ছায়া পাওয়া যায়’। আশির দশকের মাঝামাঝি ২০-২১ বছরের তরুণ ডায়েরিতে হাসান আজিজুল হক সম্পর্কে লিখে রেখেছিল বাক্যটি। উত্তরবঙ্গের চরমভাবাপন্ন গ্রীষ্মে ছায়া হিসেবে বটগাছের উল্লেখ উপমা হিসেবে খুবই ক্লিশে, বহু-ব্যবহারে জীর্ণ। এতই জীর্ণ যে তা আজ হাতেখড়ি লিখিয়েরাও এই রকম উপমা ব্যবহার করবে না। কারণ বহু ব্যবহারে এটি তার সাহিত্যিক মূল্য হারিয়েছে। কিন্তু সেই তরুণ তো সাহিত্যিক অনুভূতি হিসেবে এই বাক্যটি লেখেনি। সাহিত্যের চেয়ে তার তখন রাজনীতিতেই সম্পৃক্ততা বেশি। গনগনে আগুনের মতো উত্তপ্ত তখন সময়টি। প্রতিদিন কিছু না কিছু ঘটছে। সেই ঘটনাগুলোর বেশির ভাগই আবার দেশের ৯৫ ভাগ মানুষের বিপক্ষেই। এখনো সেই রকমটাই ঘটে চলেছে।
তবে সেই সময়টাতে কিছুটা হলেও প্রতিবাদ অন্তত ছিল। এখনকার মতো পুরোপুরি হার মেনে বা তাৎক্ষণিক প্রাপ্তি ও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র লোভের শিকার হয়ে পানি-পড়া মুড়ির মতো মিইয়ে যাওয়া ছিল না ছাত্রসমাজ। কিছুটা হলেও প্রতিরোধের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করত জনগণের একটি অংশ। সমাজ, রাষ্ট্র এবং পৃথিবীটা যেভাবে চলছে, সেটি মানুষের মুক্তির অনুকূলে যে নয়, সমাজের একটি অংশ অন্তত সেটি স্বীকার করত এবং পরিবর্তনের রাজনীতির সপক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেছিল। কিন্তু সেই অবস্থানকারীদের মধ্যে থেকেও নিজের এবং অন্যদের চেতনার মান নিয়ে মাঝে মাঝেই হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়তে হতো। নিজেকেই বলতাম, যার চেতনার স্তর উন্নত বলে দাবি করা হয়, সে বা তারা এই রকম কাজ করবে কেন? আমি নিজেই বা এই রকমটি করব কেন? ইসমে আজম বা স্ট্রিং থিওরি, বা সমাজবিকাশের সাধারণ নিয়ম বা জীবনের মূলকথা বা যে কোনো সূত্রায়নের মাধ্যমে জীবনের সকল সার সত্য জানা ও ব্যাখ্যা করার বা জীবনের মূল চালিকাশক্তি আয়ত্ত করার বালসুলভ আকাঙ্ক্ষা মানুষের মধ্যে চিরকালই বিদ্যমান। তখনো রেডবুক পড়ে কেউ কেউ মনে করতেন যে পৃথিবীর সব সারকথা তাঁর জানা হয়ে গেছে।
আমরাও হয়তো একটা পাঠচক্র থেকে বেরিয়ে এসে ভাবতাম এই দেশের অন্য অ্যাকটিভিস্টদের চেয়ে আমরা কতই না উন্নত তত্ত্বের শানিত অস্ত্রের অধিকারী! কিন্তু সমাজটাকে যখন কিছুতেই সেই তত্ত্ব দিয়ে ব্যাখ্যা তো দূরের কথা, আঁচ পর্যন্ত করা যাচ্ছে না, তখন কার কাছে যাব? সমকালীন ও সমসাময়িক ছাত্রনেতাদের কাছে গিয়ে লাভ হয় না, অভিভাবক পার্টিতাত্ত্বিকের কাছে গিয়ে কোনো লাভ হয় না। থোড় বড়ি খাড়া গোছের একটা উত্তর নিয়ে বেরিয়ে আসতে হয়। সেই চরম অস্বস্তিকর মেঘভারাতুর মন নিয়ে হাসান আজিজুল হকের কাছে যাওয়া হয়েছে অনেকবার। কোনো প্রেসক্রিপশন পাওয়া যায়নি তাঁর কাছে। চটজলদি কোনো সমাধান বাতলে দেওয়ার মানুষই তিনি নন। তবু তাঁর কাছে গিয়েই মনটাকে শান্ত করা যেত অনেকখানি। তিনি একথায়-সেকথায় জানিয়ে দিতেন যে দেখতে হবে আরো নানা দিকে আলো ফেলে।
সরাসরি কোনো মন্তব্য না করেও বুঝিয়ে দিতেন যে সমস্যাটিকে বুঝতে হবে বুদ্ধি দিয়ে। এই বুদ্ধি দিয়ে বোঝা, রাগ না করে বোঝা, বোঝার সময়টাতে কোনো আক্ষেপ-আফসোস-ক্রোধ-পূর্বধারণা-মতলব না জড়িয়ে বোঝা। এই কাজটি সক্রেটিস করতেন। এভাবেই যে কোনো জিনিস বুঝতে চাইতেন সক্রেটিস। আর এভাবে বুঝতে চাইলে যে অন্যকে বোঝানোর কাজটিও বিপুল মাত্রায় সমাধা হয়ে যায়, সেটি বুঝেছি অবশ্য অনেক পরে। দেশে তখন অনেক মার্কসবাদী। অনেক রকমের মার্কসবাদী। তারপরও মার্কসবাদের পাঠের জন্য হাসান আজিজুল হকের কাছে যেতে হয়। জানতে ইচ্ছা করে, তিনি কেন মার্কসবাদী। তিনি অনেক কথা বলে যান। দিনের পর দিন বলে যান। তারপর তাঁর বক্তব্যের সারসংক্ষেপ করে আমিসহ আরো কেউ কেউ হতভম্ব হয়ে পড়ি। সার-সংক্ষেপটি কোনো সাক্ষাৎকারেও তিনি হয়তো বলেছেন। সেটি এই রকম–সমাজের সত্যকে, সমাজের বিকাশের নিয়মগুলিকে এবং ইতিহাসকে ব্যাখ্যা করার বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি আয়ত্ত করার ক্ষেত্রে মার্কস-প্রদর্শিত পথটি একটি ভালো পথ। (একমাত্র পথ বলছেন না তিনি)।
সেই সঙ্গে তিনি আমাদের এটাও মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে এই পথ ধরে চলতে গেলে মার্কসের অনেক সিদ্ধান্তই বাতিল বলে গণ্য করতে হতে পারে। কারণ মার্কসবাদী পদ্ধতিই বলে দিচ্ছে যে মার্কসের অনেক সিদ্ধান্ত এবং অনুমানই যথার্থ নয়। মার্কসবাদকে আমরা তখন প্রায় ধর্মবিশ্বাসের মতো পালন করছি। সেই সময়ে হাসান আজিজুল হক এমন কথা বলেন! আর মার্কসবাদী পথে চলতে গেলে মার্কসের অনেক সিদ্ধান্তকেই ভুল প্রমাণ করতে পারা যায় বলেই নাকি মার্কসবাদ তাঁর কাছে প্রিয় মতবাদ!
পরে বুঝতে পেরেছি কোনো মতবাদ বা ঘরানার কাছে মাথাটিকে পুরোপুরি বিকিয়ে না দিতে বলছেন তিনি। বলছেন মতবাদী হলেও দরজাটা একটু খুলে রাখতে। সেই খোলা জায়গাটি দিয়ে প্রশ্ন যেন ঢুকতে পারে অন্তত। এখন বোঝা যায়, এই খোলা দরজার অভাবেই সমাজতান্ত্রিক নিরীক্ষার ব্যর্থতা ভেসে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে কাতারে কাতারে শুয়ে পড়েছিলেন বাংলাদেশের বামপন্থীরা, সুড় সুড় করে গিয়ে ঢুকেছিলেন তথাকথিত বড় দলের ছোট ছোট অবস্থানে, কোনো পর্যালোচনা ছাড়াই পরিত্যক্ত ঘোষণা করেছিলেন সমাজমুক্তির পথ। অথচ হাসান আজিজুল হক আজও মার্কসবাদী। ওই প্রশ্নের জায়গাটা উন্মুক্ত রাখতে পেরেছিলেন বলেই।
প্রশ্ন প্রসঙ্গেই আবারও সক্রেটিস। সক্রেটিসকে আমরা কেউই দেখিনি। দেখার প্রশ্নই ওঠে না। বিশেষত, টাইম মেশিন এখনো যখন কেবলমাত্র কল্পবিজ্ঞানের স্তরেই রয়ে গেছে। তাঁর শিক্ষা যতটুকু এসেছে আমাদের কাছে এই প্রায় আড়াই হাজার বছর পরে, এসেছে নানাজনের হাতফেরতা হয়ে। প্রধানত প্লেটোর বরাতেই। ব্যক্তি সক্রেটিসের যতটুকু বর্ণনা পাওয়া যায়, সেটুকুও সেই অন্যের মুখেরই বর্ণনা। নিজে কিছুই লিখে যাননি সক্রেটিস। তাই হঠাৎ হঠাৎ মনে হয়, ব্যক্তি সক্রেটিস কেমন ছিলেন তা কোনোদিনও সঠিকভাবে জানা যাবে না। কথাটা মনে হয় হাসান আজিজুল হককে দেখে। তাঁর গল্প অনেক বছর পরেও পড়বে বাঙালি পাঠক। গল্প পড়লে যেমনটি মনে হয়, এক সূক্ষ্ম, নির্দয়, ক্ষমাহীন জীবনের কথক তিনি। ব্যক্তিজীবনেও সেই রকমই হবেন। কিন্তু ব্যক্তি হাসান আজিজুল হক যে ওই কল্পনার চেহারাটুকু ছাপিয়ে আরো অনেক কিছু। আমি অন্যরকম বলছি না, বলছি আরো অনেক বেশি। অনেক বেশি প্রাণবান। প্রাণেরই লক্ষণ তো প্রশ্ন। প্রাণেরই লক্ষণ তো জানার ইচ্ছা, দেখার ইচ্ছা, পরিচয়ের ইচ্ছা। তিনি যখন কোনো ব্যক্তির দিকে তাকান, পরিপূর্ণ মনোযোগের সঙ্গে তাকান।
তাঁর সামনে যেই থাকুক, মনে মনে ধরে নিতে বাধ্য যে হাসান আজিজুল হকের পুরো মনোযোগ এখন তাঁর দিকেই। চোখের সামনের মতো মনের সামনেই একা সেই-ই আছে। সামনের মানুষটিই তাঁর কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ। সেই মানুষটিকে অসংখ্য প্রশ্ন করতে থাকেন তিনি। তবে বিব্রত করেন না। শুনেছি সক্রেটিস যেমনটি করতেন। সক্রেটিস প্রশ্ন করতেন তাঁর সামনের মানুষটির ভেতরের অন্তঃসারশূন্যতাকে তাঁর নিজেরই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেবার জন্য। আর হাসান আজিজুল হক প্রশ্ন করেন নিখাঁদ নিজের আগ্রহের জ্যান্ততা হেতু।
আর কথা বলা! কথাকে অমন জীবন্ত করতে কে পারে আর! আমাদের দেশে অনেক বাকশিল্পী রয়েছেন। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কথা বলার জন্য সম্মান ও সম্মানী দিয়ে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয় তাঁদের। রাজনীতির দলগুলিতে বক্তা নামক একটি প্রাণী তৈরিতে জোগানো হয় ব্যাপক উৎসাহ। ধর্মীয় অনুষ্ঠানের বক্তাদের তো বিশাল বিশাল ঘরানাই তৈরি হয়েছে আমাদের দেশে। কিন্তু হাসান আজিজুল হকের মতো কেউ কি আছেন? নিজেই বলি- নেই। আনুষ্ঠানিকতার বাইরে ঘরে-রাস্তায়-আড্ডায় এমনভাবে কথা বলতে আর কেউ জানেন বলে আমার জানা নেই। সমস্ত শরীর দিয়ে কথা বলেন তিনি। এমনভাবে বলেন যেন জিহ্বানিঃসৃত শব্দগুলোকেও শারীরিক অবয়ব দান করে চলেছেন। তাঁর ভক্তদের জবানির যে ছিটেফোঁটা অংশ আমাদের কাছে এসে পৌঁছেছে তা থেকে আমরা জানতে পারি যে সক্রেটিস ছিলেন কথক হিসেবে তুলনারহিত।
আলকিবিয়াডিস নামক একজন গুণগ্রাহীর জবানিতে প্লেটো ‘সিম্পোজিয়াম’ গ্রন্থে এ-সম্পর্কে যতটুকু তুলে ধরেছেন সেগুলির চুম্বক-অংশ হতে পারে এই রকম- ‘বাঁশিওয়ালার চেয়ে অনেক অদ্ভুত বাঁশিওয়ালা হচ্ছেন আপনি। সে তো অন্তত বাঁশি বাজিয়ে লোককে মোহগ্রস্ত করে। আপনি তাকে হার মানান, কেননা আপনিও মানুষকে তারই মতো মোহগ্রস্ত করে ফেলেন শুধুমাত্র কথার দ্বারা, কোনো বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার না করেই।’ কিংবা এই রকম- ‘তাঁর কথা শুনতে শুরু করলেই এক অদ্ভুত উন্মাদনায় আমার হৃৎপিণ্ড লাফাতে থাকে, দুই চোখ থেকে ছোটে অশ্রুর ধারা।’ কিংবা আরেক রকম- ‘সক্রেটিস আমাকে প্রায়ই এমন অবস্থার মধ্যে ফেলেছেন যে আমি ভেবেছি যে-জীবন কাটাচ্ছি, সে-জীবন যদি এই রকমই থেকে যায়, তাহলে বাঁচাটাই নিরর্থক।’
বোঝাই যাচ্ছে সক্রেটিসের শিক্ষাটা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তাঁর ব্যক্তিগত আকর্ষণের জায়গাটাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। সেই ব্যক্তিগত কারিশমা অর্জন করেছিলেন সক্রেটিস। কী ছিল তাঁর ব্যক্তিত্বের ভূষণ? ছিল স্বাবলম্বিতা, শুদ্ধতা, আত্মসংহতি, মানবিক করুণা। ছিল সংস্কৃতিবানতা, সদাপ্রসন্নতা, অবিচলিত প্রশান্তি। সর্বোপরি নিজেকে তিনি মুক্ত করতে পেরেছিলেন ভোগের দাসত্ব থেকে। শোনা যায়, এথেন্সের বাজারের ভেতর দিয়ে হাঁটার সময় দুই পাশের ভোগ্যদ্রব্যে পরিপূর্ণ দোকানগুলোর দিকে তাকিয়ে বলতেন, ‘এসবের কোনো কিছুতেই আমার কোনো প্রয়োজন নেই।’ শাসকবর্গের প্রিয়পাত্র ছিলেন না তিনি, উঁচু মহলের সঙ্গে ছিল না কোনো যোগাযোগ, সামাজিক-রাষ্ট্রীয় কোনো পদেই ছিলেন না তিনি; সর্বোপরি ছিলেন দরিদ্র, কুৎসিৎদর্শন, প্রৌঢ়। তবু যে তরুণসমাজ ছুটে আসত তাঁর কাছে সে তো সেই অর্জিত ব্যক্তিত্বের গুণেই। যে শিক্ষা তিনি বিলিয়ে যেতেন এথেন্সের রাস্তায়, পার্কে, বিপণিবিতানে, যে কোনো জনসমাগমস্থলে, সেই শিক্ষারও সারাৎসার পাওয়া যায় হাসান আজিজুল হকেরই জবানিতে- নিজেকে জানা মানে হচ্ছে নিজের ভেতরটা খোঁড়াখুঁড়ি করা, ভেতরে যা কিছু আছে তার সবটাই বুদ্ধি ও যুক্তির পরিষ্কার আলোতে মেলে ধরা। তিনি, সক্রেটিস কিন্তু কারো হাতে আত্মজ্ঞান তুলে দিতে পারেননি- কোনো প্রশ্নেরই চূড়ান্ত জবাব দেওয়ার চেষ্টা করেননি। তিনি শুধু মানুষকে সংক্ষুব্ধ করে তুলতে পারতেন, বিরামহীন জিজ্ঞাসার যন্ত্রণায় তাকে ক্ষত-বিক্ষত করে দিতেন। তাঁর সঙ্গে কথা শুরু করার কিছুক্ষণের মধ্যেই যে-কোনো জ্ঞানগর্বিত মানুষের অহংকার খসে পড়ত- তাঁর ভেতরের দৈন্য প্রকটভাবে প্রকাশ পেয়ে যেত, তিনি তখন উপলব্ধি করতে পারতেন, যেসব ধ্যান-ধারণা, বিশ্বাস, মূল্যবোধ, মত, সংস্কার নিয়ে তিনি এতকাল জীবন কাটিয়ে এলেন, তার কোনো কিছু সম্বন্ধেই তাঁর পরিষ্কার কোনো জ্ঞান নেই। তিনি সুন্দর সুন্দর বলে চেঁচিয়ে মরছেন, কিন্তু তিনি জানেন না ‘সৌন্দর্য’ বলতে কী বোঝায়; তিনি সারা জীবন ন্যায়-অন্যায় ভালো-মন্দের ওপর নির্দ্বিধায় রায় দিয়ে এসেছেন অথচ ‘ন্যায়’ সম্পর্কে, ‘ভালো’ সম্পর্কে তার আদৌ কোনো পরিষ্কার ধারণা নেই। উত্তম বা আদর্শ জীবন কাটাচ্ছেন বলে হয়তো অহমিকা প্রদর্শন করে থাকেন, কিন্তু সক্রেটিসের দুটো প্রশ্ন থেকেই ধরা পড়ে যাচ্ছে যে জীবনের ‘উত্তম’ সম্বন্ধে তিনি কোনো ধারণাই গড়ে তুলতে পারেননি।
এইভাবে সক্রেটিসের সঙ্গে আলাপের পরে জ্ঞানগর্বিত ব্যক্তিটির মনে দেখা দিত এক প্রচণ্ড লজ্জাবোধ, অজ্ঞানতার মধ্যে ডুবে থাকার লজ্জাবোধ, কিছুই না জেনে বাগাড়ম্বরকে প্রশ্রয় দেওয়ার লজ্জা, দেখা দিত এক ধরনের হীনতার উপলব্ধি। তা জন্ম নিত ওই অজ্ঞানতার সচেতনতা থেকে। মানুষটি তখন পড়ে যেতেন একরকম আত্মিক সংকটের মধ্যে। তাই বলা চলে, মানুষের অস্তিত্বের গভীরে প্রলয়ংকরী ঝড় সৃষ্টি করার নামই ছিল সক্রেটিস। এই প্রচণ্ড আলোড়নই সেই ব্যক্তিটির মধ্যে শেষ পর্যন্ত জাগিয়ে তুলত প্রবল জীবনতৃষ্ণা, মনুষ্যজীবনের শ্রেষ্ঠতার বোধ, শ্রেয়কে অনুসন্ধান ও প্রাপ্তির ক্ষান্তিহীন বাসনা। আলকিবিয়াডিসের ভাষায়- সক্রেটিস জাগিয়ে তুলতে পারতেন গভীরতম আধ্যাত্মিক আবেগ, হীনতাবোধ, অপরিসীম লজ্জা, নিজের অপারগতার উপলব্ধি আর আত্মোন্নতির সুতীব্র আকাঙ্ক্ষা।
সক্রেটিসকে নিয়ে গ্রন্থ রচনার পেছনে হাসান আজিজুল হকের আরো একটি উপলব্ধি কাজ করেছে বলে আমার বিশ্বাস। তিনি ধারণা করেন যে, পশ্চিমী সভ্যতার আজ যা কিছু শ্রদ্ধেয়- বুদ্ধির মুক্তি, সত্যের প্রতি অবিচলিত নিষ্ঠা, গভীর স্বদেশপ্রেম, মানবকল্যাণের আদর্শ, সুতীক্ষ্ণ, নির্মম, নির্মোহ আত্মবিশ্লেষণ, প্রবল জীবনতৃষ্ণা- এসবেরই একটা প্রধান উৎস হচ্ছে সক্রেটিসের দর্শন এবং সক্রেটিস নামের মানুষটি।
সক্রেটিসের সবচেয়ে পরিচিত উক্তি ‘নিজেকে জানো’-র কোনো পরিষ্কার ব্যাখ্যা আমাদের কারোই জানা ছিল বলে মনে হয় না। হাসান আজিজুল হক আলো ফেলছেন সেই জায়গাটিতেও। সক্রেটিস ও তাঁর মনোযোগের কেন্দ্রে ছিল মানুষ। ধর্ম, নৈতিকতা, জ্ঞান— এসব হলো তাঁর আলোচনা এবং অনুসন্ধানের বিষয়। মানুষ যেহেতু সমাজের মধ্যে সমাজের একজন হয়েই বাস করে, এ জন্য তাঁকে সুবিচার, কর্তব্যপরায়ণতা, শৌর্য, সংযম, সদগুণ ইত্যাদি প্রসঙ্গ নিয়ে মাথা ঘামাতে হবেই। ন্যায়বিচার, কর্তব্য-অকর্তব্য, ভালো-মন্দ ইত্যাদি প্রশ্নের মতিস্থির করতে না পারলে সুশৃঙ্খলভাবে সমাজে বসবাস করা অসম্ভব। বিশ্বজগতের গঠন আমাদের অজানা এবং অবিদিতব্য, আমরা একমাত্র নিজেদেরই জানতে পারি। ‘নিজেকে জানো’ বলে তাঁর যে কথাটি খুব প্রচলিত রয়েছে, সে কথাটার মূল এখানেই।
তখন মনে পড়ে যে আমরা বৈশ্বিক সাহিত্যিক মতবাদের নামে হাভাতের মতো যে পশ্চিম-দক্ষিণের দাক্ষিণ্যের দিকে তাকিয়ে থাকি, তা থেকে কোনোদিন নিজেকে জানা যায় না। কখনো মুখে বলেন না, কিন্তু অনেক রকমভাবে, অনেক উদাহরণ দাঁড় করিয়ে জানিয়ে দেন যে সাহিত্যেও নিজেকে না জানলে সেই সাহিত্য শেষ পর্যন্ত সাহিত্য হয়ে ওঠে না।
হাসান আজিজুল হকের কাছ থেকে সাহিত্য সম্পর্কে, আমাদের, অন্তত আমার জানার নির্যাস এটাই। খুব মোটা দাগে বলা হলেও এটাই তাঁর কাছ থেকে আমার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। অন্য অনেকেই বলেছেন এমন কথা, বলেনও অহরহ, এমনকি আমি নিজেও হয়তো বলি। কিন্তু বুকের মধ্যে গেঁথে নিয়ে বলা, বিশ্বাসের ভিত তৈরি করার মতো করে বলা, উপদেশের বদলে নিজের বিশ্বাস ভাগ করে নেওয়ার মতো বলা- এটি পেয়েছি কেবলমাত্র হাসান আজিজুল হকের কাছ থেকেই। আমরা যে স্যুররিয়ালিজম, ম্যাজিক রিয়ালিজম নিয়ে চেঁচামেচি করি, সেসব নিয়ে ইউরোপে কেউ মাথা ঘামায়? যারা নিজেরা ম্যাজিক রিয়ালিজমের লেখক, তারা নিজেরাই কি তা নিয়ে মাথা ঘামায়? তারা আসলে মাথা ঘামায় নিজেদের নিয়ে। সেটাই ম্যাজিক রিয়ালিজম হয়ে বেরিয়ে আসে, অথবা সমালোচকদের দেওয়া অন্য কোনো নাম নিয়ে বেরিয়ে আসে।
হাসান আজিজুল হকই মনে করিয়ে দিয়েছিলেন অস্ট্রিয়ান যে মহিলা সাহিত্যিক নোবেল পুরস্কার পেলেন, তাঁর মধ্যে অস্ট্রিয়া ছাড়া, নিজের দেশ ছাড়া আর কিছু নেই। এরা যে বড় লেখক হয়ে ওঠেন তা এই জন্যই। নিজেকে নিজের দেশ এবং মাটি থেকে বিচ্ছিন্ন না করে ফেলার জন্যই। আফ্রিকার লেখা পড়লেও সেটা বোঝা যায়। হয়তো তাঁরা লিখছেন অন্য ভাষায়, কেউ ইংরেজিতে, কেউ ফরাসিতে- কিন্তু লিখছেন একেবারে ঠিক নিজেদের কথাই। চিনুয়া আচেবের গল্পের কথা মনে করিয়ে দেন হাসান অজিজুল হক। আফ্রিকার জীবনযাপনের বৈশিষ্ট্য ছিল, কেউ একা একা নিজের জন্য কিছু না করা। একা কিছু না করা। কেউ একার জন্য বাঁচে না সেখানে। গ্রামের লোকেরা সবাই মিলে খরচ দিয়ে একটি ছেলেকে ইংল্যান্ডের শহরে পাঠাল ব্যারিস্টার হয়ে আসার জন্য। কিন্তু ব্যারিস্টার হয়ে ফেরত আসার পরে সে আর গ্রামে থাকতে পারে না। কারণ গ্রামে তো আর প্র্যাকটিস হয় না। তখন সে চলে গেল শহরে। ইংল্যান্ডে ব্যারিস্টারি পড়তে যাওয়ার সময় তার বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়নি নিজের জীবনধারার সঙ্গে। বিচ্ছিন্নতা তৈরি হলো এবার নিজ দেশে ফিরে এসে। যে-ই তথাকথিত উন্নতি এলো, সঙ্গে সঙ্গে এলো বিচ্ছিন্নতা। এটি এমনভাবে ধরতে পারেন বলেই চিনুয়া আচেবে বড় লেখক, মৌলিক লেখক।
কত রকমের ফেনিল উচ্ছ্বাস এবং আলোড়ন যে আসে আমাদের দেশে! একটু অসতর্ক হলেই বা ভিত্তিতে দুর্বলতা থাকলেই ভাসিয়ে নিয়ে যায় নিজস্ব চিন্তাধারাকে। কত রকমের হুলস্থুলই না আমদানি হয় সাহিত্যের জগতে। শিল্পের জন্য শিল্প, নন্দনতাত্ত্বিক শিল্প, ব্যক্তিকেন্দ্রিক রচনা, আধুনিক মানুষের যুগযন্ত্রণা, উত্তর আধুনিকতা, জাদুবাস্তবতা, নাগরিক শিল্প- কত নামে বিভ্রান্তি আসে। সেই সব স্রোতে গা না ভাসালে অভিধা জোটে ‘যথেষ্ট আধুনিক লেখক নন’ বলে। নিজের লেখকজীবনের শুরু থেকেই এই রকম মন্তব্য শুনতে হয়েছে তাঁকে। কিন্তু সমাজের এবং নিজের মনের আগুনকে কথাসাহিত্যে রূপ দেওয়ার স্থির লক্ষ্য নিয়ে যেভাবে তিনি কাজ করে যাচ্ছেন, তাঁর কাছ থেকে সেটাই আমার মূল শেখার জিনিস। তাঁর মতো আমাকেও কেউ ‘যথেষ্ট আধুনিক’ না বললে কিংবা ‘আঞ্চলিক’ বললে আমি মোটেও ঘাবড়ে যাই না। কারণ আমার মতো অনেকের হয়ে তিনি উত্তর দিয়ে রেখেছেন- ‘সেভাবে দেখতে গেলে সব লেখাই আঞ্চলিক। লাতিন আমেরিকার সমস্ত লেখাই ওই অর্থে আঞ্চলিক।’ পৃথিবীর সব বড় লেখকদের মধ্য থেকে সাধারণ যে প্রবণতাটি আবিষ্কার করা যায়, সেটাও সেই কথার সপক্ষেই দাঁড়ায়।
নিজের সেই পাঠ-অভিজ্ঞতাকে সামনে রেখে তিনি জানিয়ে দেন-প্রামিদ্যা অনন্ত তোয়ের, হোসে সারামাগা, সালমান রুশদী, অনিতা দেশাই, অরুন্ধতী রায়, লাতিন আমেরিকার সমস্ত বড় লেখক- তাঁদের একটাই ধ্রুব আছে-সময়, সমাজ, মানুষ। আমাদের ভাষার যাঁরা বড় লেখক, সে রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে অমিয়ভূষণ মজুমদার, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস পর্যন্ত, তাঁদের ক্ষেত্রেও এই একই কথা প্রযোজ্য। আর পুরস্কার, পিঠ চাপড়ানি, বড় পত্রিকা, বড় মিডিয়া, সমাজের ও রাষ্ট্রের প্রভাবশালীদের পৃষ্ঠপোষকতা-এসব সাধারণত জোটে মধ্যম মানের লেখকদের। কারণ বড় ও স্থিতধী প্রতিভাকে চেনার ক্ষমতা মিডিয়ার নেই। বড় লেখক কখনো কখনো এসব পেয়ে যান। তবে এর পেছনে আছে সেই অভিসন্ধি, যার মাধ্যমে মিডিয়া ও পুরস্কারদাতারা নিজেদের ক্রেডিবিলিটি বজায় রাখার চেষ্টা করেন। বলতে পারেন যে, আমাদের পুরস্কার বা তোল্লাই-প্রবণতা জায়েজ, কারণ আমরা অমুককেও পুরস্কৃত করেছি। স্থিতধী লেখক পুরস্কার না পেলেও নিজের কাছ থেকে একচুল নড়েন না, আবার পুরস্কার পেলেও এটা ভোলেন না এসব হলো বাই প্রোডাক্ট, মূল কাজটা লেখা, নিজের জায়গা থেকে নিজের মতো করে লেখা। এটি কি সক্রেটিসের ‘নিজেকে জানো’র মতোই শোনাচ্ছে না? শোনাচ্ছে। কারণ, এটিও লেখকের নিজেকে জানা। খুব গুরুত্বপূর্ণ জানা।
হাসান আজিজুল হকের লেখা পাঠ করে এবং তাঁকে দিনযাপনের নানা প্রক্রিয়ার মধ্যে দেখে এই নাবুঝ অসম্ভব আক্ষেপটাও মাঝে মাঝেই জেগে ওঠে- আহা সক্রেটিসের শিক্ষাটা তো এসেছে আমাদের কাছে, মানুষটার নৈকট্য যদি পেতাম! বড় মানুষের জীবনযাপন দেখলে যতখানি জানা যায়, লেখা পড়ে অতখানি জানা সম্ভব নয়। রবীন্দ্রনাথ যতই বলুন না কেন- কবিকে পাবে না তাঁর জীবন চরিতে-তাঁর সব কথা মেনে নিলেও এই কথার অভ্রান্ততায় বিশ্বাস করতে মন সায় দেয় না।