ঢাকার কথা ২৪
হুঁকা-টিক্কা ও অন্যান্য
ধূমপান এ দেশের উল্লেখযোগ্য মানুষের পুরোনো অভ্যাসের একটি। সিগারেট, বিড়ি অনেকটা আধুনিক কালের তামাকগুঁড়ো সংবলিত ধূম্রদ-। তারও আগে হুঁকার ব্যবহার ছিল। এখনো টিকে আছে। মাটির তৈরি কল্কেতে রাব (এক ধরনের চিটাগুড়) মেশানো তামাকগুঁড়ো ভরে তার ওপর টিক্কা রেখে আগুন দেওয়া হতো। টিক্কার আগুন ধিকি ধিকি জ্বলত। কল্কেটি লাগানো হতো একটি কাঠের নলের মুখে। নলের অপর প্রান্ত যুক্ত থাকত একটি পানি রাখার আধারের সাথে। সাধারণত এই আধার একটি অভঙ্গ নারকেলের মালা দিয়ে বানানো হতো। সেই আধারে থাকত একটি ছিদ্র। ধূমপায়ীরা এই ছিদ্র দিয়ে টেনে তামাকের ধূয়া গ্রহণ করত।
এ ছিল সাধারণ মানুষের হুঁকা। এখনো গ্রামে-গঞ্জে এ ধরনের হুঁকার ব্যবহার রয়েছে। ধনী অভিজাতরা ব্যবহার করতেন নলের জমকালো গড়গড়ি হুঁকা। ধাতু দিয়ে তৈরি হতো বিলাসী হুঁকা। অনেক সময় তাতে রূপোর পাত, পাথর ইত্যাদি বসানো হতো। ছিদ্র পথ দিয়ে একটি নল বের করা হতো। নলে মুখ রেখে হুঁকা বিলাসীরা হুঁকা টানতেন আয়েসী ভঙ্গিতে। সেই টানের সাথে আধারে রাখা পানিতে একটি গড়গড় শব্দ হতো।
ইংরেজ শাসন যুগে ঢাকা শহরে অনেক হুঁকাসেবী ছিল। এ কারণে হুঁকাকে ঘিরে নানা পেশাজীবীরও বিকাশ ঘটে। যেমন কুমোর বাড়িতে তৈরি হতো কল্কে, টিক্কাওয়ালারা টিক্কা বানাতেন, কাঠমিস্ত্রি কাঠের নল বানাতেন আর নারকেলের মালাকে হুঁকার উপযোগী করে তৈরি করতেন আরেক শ্রেণীর কারিগর।
ইংরেজ সিভেলিয়ান জেমস ওয়াইজ ১৮৮৩ সালে পূর্ববঙ্গের জনমানস ও বাণিজ্য নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ লিখেছিলেন। এই গ্রন্থে তাঁর দেখা ঢাকা সম্পর্কে মূল্যবান অনেক তথ্য পাওয়া যায়। তিনি উনিশ শতকের শেষে ঢাকায় হুঁকার রমরমা ব্যবসা দেখতে পেয়েছিলেন। তিনি ঢাকায় প্রায় একশ পরিবার দেখেছিলেন যাদের পেশাই ছিল হুঁকার নল বানানো। নল বানাতে তারা জাম, জারুল, শিমুল ইত্যাদি কাঠ ব্যবহার করতেন। লোহার শলাকা দিয়ে বিশেষ কায়দায় নলের ভেতরের কাঠ সরিয়ে ফাঁকা করা হতো। সমকালীন কোনো কোনো লেখক দাবি করেছেন ভারতবর্ষের মধ্যে ঢাকার কারিগররা হুঁকার নল তৈরিতে সবচেয়ে পারদর্শী ছিলেন।
নারকেলের মালা থেকে অপূর্ব দক্ষতায় ভেতরের নারকেলের শাস সরিয়ে নেওয়া হতো। এ কাজে দক্ষ কারিগররা হুঁকার গুরুত্বপূর্ণ এই অংশ তৈরি করতেন। আমি বছর চারেক আগেও জিঞ্জিরার বাজারে হুঁকার জন্য প্রস্তুত নারকেলের মালা বিক্রি হতে দেখেছি। আর কুমোর বাড়িতে এখনো তৈরি হচ্ছে কলকে। উনিশ শতকে ঢাকার আশপাশে অনেক কুমোরবাড়ি ছিল।
হুঁকা ব্যবহারকারীদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান টিক্কা। টিক্কা তৈরির কারিগররা এ পেশাতেই পারদর্শী ছিলেন। এই কারিগররা টিকাওয়ালা বা টিক্কাওয়ালা নামে নগরবাসীর কাছে পরিচিত ছিলেন। জেমস ওয়াইজ উনিশ শতকের শেষদিকে ঢাকায় প্রায় পঁয়ত্রিশটি টিক্কাওয়ালা পরিবার দেখেছিলেন। আজকের টিকাটুলি অঞ্চলে ছিল এদের বাস। অনেকের ধারণা টিকাওয়ালা থেকে টিকাটুলি নামকরণ হয়েছে। জেমস ওয়াইজের বর্ণনায় শুক্রবার ছাড়া সপ্তাহের অন্যান্য দিন টিক্কাওয়ালারা টিক্কা বিক্রি করতেন।
টিক্কা তৈরি করা হতো কাঠকয়লার গুড়ো দিয়ে। টিক্কা তৈরিতে পরিবারের সবাই কম-বেশি অংশ নিত। বিশেষ পদ্ধতিতে টিক্কা তৈরি করা হতো। কাঠ কিছুক্ষণ পোড়ানোর পর সেই কয়লা সংগ্রহ করা হতো। কয়লা গুঁড়ো করা হতো ঢেঁকিতে। তারপর ছোট চ্যাপটা ও গোলাকৃতির পিঠার মতো আকার দেওয়া হতো যাতে তা কল্কেতে রাখা যায়। এগুলো বাঁশের চাটাই বা মাদুরে বিছিয়ে রোদে শুকানো হতো। জেমস ওয়াইজের ভাষ্য মতে, তখন তিন মাদুর সমান টিক্কা বিক্রি করা হতো পাঁচ থেকে ছয় আনা। টিক্কার গুণগত মানে দামের হের ফের হতো। সস্তা টিক্কা খুব দ্রুত জ্বলে শেষ হয়ে যেত আর গুণগত মানসম্পন্ন টিক্কা বেশিক্ষণ কল্কেতে থাকত।
হুঁকার নানা উপকরণের মতো ঢাকার টিক্কার গুণগত মানেরও সুনাম ছিল।