জীবনানন্দ
হৃদয়ে ঘাসের গন্ধ
‘ঘাসের বুকের থেকে কবে আমি পেয়েছি যে আমার শরীর
সবুজ ঘাসের থেকে; তাই রোদ ভালো লাগে, তাই নীলাকাশ
মৃদু ভিজে সকরুণ মনে হয়; পথে পথে তাই এই ঘাস
জলের মতন স্নিগ্ধ মনে হয়।’
জীবনানন্দের কবিতায় প্রকৃতি, উদ্ভিদ, তরুলতা, নদী এসেছে বারবার। এর মধ্যে ঘাস এসেছে বহুবার, বহু দ্যোতনায়।
তবে জীবনানন্দ ঘাসকে সামান্য গুল্ম হিসেবেই দেখেননি। দেখেছেন অহংমুক্তির অনুষঙ্গ হিসেবে। বড়ত্বের ভিড়ে নিজেকে সামান্য ভাববার উদারতা তিনি শিখেছেন ঘাসের কাছ থেকে।
নিজেকে ‘ঘাসের বুকের থেকে জন্ম’ উল্লেখ করে তিনি যে প্রকৃতির সন্তান, তা-ই বুঝিয়েছেন।
আবার কোথাও তিনি ঘাস, ঘুম ও মৃত্যুকে একাকার করে ফেলেছেন। সুতরাং জীবনানন্দের কাছে ঘাস যতটা না কবিতার অনুষঙ্গ, তার চেয়ে অনেক বেশি তার ব্যক্তিগত বোধ ও মননের প্রতীক।
মলয় রায়চৌধুরী তাঁর ‘পোস্টমডার্ন জীবনানন্দ’ গ্রন্থে এ প্রসঙ্গে লিখেছেন, ‘কিছু উদ্ভিদের বৈশিষ্ট্য হলো তারা বৃক্ষের মতো নয়, তারা রাইজোম। যেমন ঘাস বা আইরিস। এদের কাণ্ড আনুভূমিক। আধুনিকতাবাদ যেহেতু ছিল পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধ থেকে ছড়িয়ে পড়া সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদের বিশ্ববোধের রূপপ্রকরণ, সে কারণে সে নিজেকে এবং নিজের বরপুত্রদের তুলনা করেছে মহীরুহের সঙ্গে। মহীরুহের ভাবকল্পটি ব্যক্তি আধিপত্যের ধারণাপ্রসূত, যা ব্যক্তি প্রজ্ঞাকে ক্ষমতার উৎস মনে করে। ভাবকল্পটি উত্তর গোলার্ধের আকাশচুম্বী আকাঙ্ক্ষার, ইউরোপের অগ্রসরতা, খ্রিস্টীয় এনলাইটেনমেন্টর প্রগতিবিশ্বাসী ছত্রছায়ার, ব্যক্তিস্বার্থ অন্বেষণকারী যুক্তি প্রণালির, নিয়ম-নির্দিষ্ট অনুশাসনের।’
মলয় রায় লিখছেন, ‘ঘাস সারা পৃথিবীর ভূখণ্ড ছেয়ে ফেলতে পারে। প্রতিটি বৃক্ষের বিশেষ একটি অংশকে কেন্দ্ররূপে চিহ্নিত করা সম্ভব। কিন্তু ঘাসের বা অন্যান্য রাইজোমের ক্ষেত্রে তা সম্ভব নয়। রাইজোম রেখায় রেখায় ইতিউতি দিগ্বিদিক বিশৃঙ্খলার মহোল্লাসে প্রসারিত হয়, যা পোস্টমডার্নিটির কাঠামোহীন কাঠামো ভাবকল্পের সঙ্গে মেলে। ঘাসের বৈশিষ্ট্য সমগ্র সমাজের মতন, যেখানে ব্যক্তি, গোষ্ঠী, সম্প্রদায়, শ্রেণি, জাতি, পরিবার, সংস্থা ইত্যাদির পারস্পরিক দ্বন্দ্বজাত অজস্র ইতিহাস বয়ন চলছে প্রতিনিয়ত; যেখানে একটিমাত্র একমুখী ইতিহাস বলে কোনো গল্পস্রোত সম্ভব নয়। ঘাসের মতোই সমাজ কখন কোন দিকে পল্টি খাবে, কোথায় প্রসারিত হবে, তা আগে থাকতে সুনির্দিষ্টভাবে আঁচ করা সম্ভব নয়। বস্তুত ঘাস উন্মার্গ আক্রান্ত। তার যাযাবর গন্তব্য একযোগে বহুমুখী, অজস্র, খেইহীন।’
জীবনানন্দ পোস্টমডার্ন পরিসরের বিশ্ববোধে ঘাস কবিতাটি লিখেছিলেন উল্লেখ করে মলয় রায়চৌধুরী বলেন, ‘গাছের থাকে দিশা বা সিঙ্গল ডাইরেকশন, কিন্তু ঘাসের থাকে বিদিশা বা মাল্টি ডাইরেকশন। আসলে কোনো আধুনিকতাবাদীর পক্ষে নিজেকে ঘাসরূপী নগণ্য বলে কল্পনা করা অসম্ভব, কেন না তার আদর্শ ও উচ্চাকাঙ্ক্ষা হলো মহীরুহ হওয়া।’
‘ঘাস’ কবিতায় জীবনদাশ লিখছেন :
‘কচি লেবুপাতার মতো নরম সবুজ আলোয়
পৃথিবী ভরে গিয়েছে এই ভোরের বেলা;
কাঁচা বাতাবির মতো সবুজ ঘাস তেমনি সুঘ্রাণ
হরিণেরা দাঁত দিয়ে ছিঁড়ে নিচ্ছে।
আমারো ইচ্ছে করে এই ঘাসের এই ঘ্রাণ হরিৎ মদের মতো
গেলাসে গেলাসে পান করি,
এই ঘাসের শরীর ছানি চোখ চোখ ঘষি,
ঘাসের পাখনায় আমার পালক,
ঘাসের ভিতর ঘাস হয়ে জন্মাই কোনো এক নিবিড় ঘাসমাতার
শরীরের সুস্বাদ অন্ধকার থেকে নেমে।’
কবিতাটির সরল ব্যাখ্যা করলে দাঁড়ায় কবির ইচ্ছে হলো ঘাসের গন্ধকে সবুজ মদে চোলাই করে গেলাস ভরে পান করেন। একই রকম বক্তব্য দেখা যায় অন্য এক কবিতায়, যেখানে ঘাসকে তিনি জলের মতন স্নিগ্ধ বলে উল্লেখ করেছেন। অর্থাৎ ঘাস যখন জল, তখন তা পানের প্রশ্ন আসে। মদও এক ধরনের পানীয়। ঘাসের নির্যাসকে তাই তিনি কখনো জল, কখনো মদের সঙ্গে তুলনা করেছেন। আবার ঘাসের নির্যাস কখনো ঔষধি হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। বিশেষ করে ক্ষতস্থানে রক্ত পড়া বন্ধে ঘাসের নির্যাস অতুলনীয়। এর ভেষজ গুণ ব্যাপক। অর্থাৎ তৃষ্ণা মেটানো তথা দেহের প্রশান্তি, মনের শ্রান্তি এবং শারীরিক সমস্যা সর্বস্তরে এই ঘাস এসেছে অনির্বাণ আশীর্বাদ হিসেবে।
তিনি বলছেন, ঘাসের শরীর ছানি চোখে চোখ ঘষি, অর্থাৎ তার ইচ্ছে হলো ঘাসের সঙ্গে নিজেকে মাখামাখি করা। ঘাসের ওপরে চোখ ঘষা। নিজে পাখি হয়ে ঘাসের ওপরে পালক ছড়ানো। কবির ইচ্ছা ঘাসমাতার গর্ভে ঘাসশিশু হয়ে জন্মগ্রহণ। ঘাসমাতার দেহের গভীরে অন্ধকারে তলিয়ে গিয়ে তার স্বাদ নেওয়া। পুরো কবিতাতেই জীবনানন্দ প্রকৃতির সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের কথা বলেছেন। ভেবেছেন পাখি হয়ে ঘাসের পাখনায় তাঁর পালক ঘষার কথা।
যখন তিনি ঘাসের পাখনার কথা বলেন, তখন উদ্ভিদ থেকে ঘাস প্রাণী হয়ে ওঠে। প্রাণের সঙ্গে তিনি প্রাণের সম্পর্ক খোঁজেন। এই জনমে মানুষ হয়ে ঘাসের সঙ্গে সঙ্গম সম্ভব না হলে, পরজনমে পাখি হয়ে ফিরে আসার ব্যাকুলতাও আমরা দেখি তাঁর ভেতরে। যেমন :
‘আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে এই বাংলায়,
হয়তো মানুষ নয়, হয়তো বা শঙ্খচিল শালিখের বেশে।’
আবার ঘাসের পাখনা বলে তিনি যেমন ঘাসকে পাখি বানিয়ে ফেলেন, তেমনি ঘাসমাতা শব্দের দ্বারা ঘাস হয়ে ওঠে নারী। আবার হরিণের মতো অরণ্যচারী নন বলে তিনি হরিণের মতো দাঁত দিয়ে ছিঁড়ে নিতে পারেন না ঘাস, যতই তা কচি বাতাবির মতো সুঘ্রাণ হোক। নিসর্গবস্তুকে আদি প্রাণময়তায় গ্রাস করে শরীরী অন্বয়ে সার্থক হয়ে ওঠার জন্য তার প্রগলভ মত্ততা তাই শুধু কামনা। বস্তুত জীবনানন্দ ঘাসমাতার গর্ভে বিশ্ব ভুলে নিরাপদ আশ্রয় প্রার্থনা করেছেন। ঘাসশিশু হয়ে জন্ম নিয়েও লক্ষকোটি ঘাস-বীজের আত্মীয়তার এবং প্রাচুর্যের অন্তরালে যদি হারিয়ে যাওয়া যায়, এই তাঁর প্রার্থনা।
জীবনানন্দের আরেকটা বিখ্যাত কবিতা ‘আকাশলীনা’র শেষে ঘাস ব্যবহৃত হয়েছে প্রেমিকার হৃদয় হিসেবে। কবিতার প্রথমাংশে প্রেমিকাকে অন্য পুরুষের সঙ্গে যেতে দেখে কবি তির্যককণ্ঠে বলছেন, ‘কী কথা তাহার সাথে, তার সাথে।’ তারপর নিজের দিকে ফিরে আসার ব্যাকুল আমন্ত্রণ জানিয়ে প্রেমিকা সুরঞ্জনা যে শুধু আকাশলীনা (যে আকাশে লীন হয়ে যায়) নয়, বরং মৃত্তিকাও, সেদিকে ইঙ্গিত করে বলছেন-
‘আকাশের আড়ালে আকাশে মৃত্তিকার মতো তুমি আজ :
তার প্রেম ঘাস হয়ে আসে।’
প্রেমিকা সুরঞ্জনা এখানে মানবী থেকে হয়ে ওঠেন প্রাণময়ী মৃত্তিকা। আর মৃত্তিকার প্রেম ঘাসের মতো জড়িয়ে রাখে তাকে।
পরবর্তী পঙক্তিতে বলছেন ‘সুরঞ্জনা তোমার হৃদয় আজ ঘাস, বাতাসের ওপারে বাতাস, আকাশের ওপারে আকাশ।’ তখন প্রেমিকা হয়ে ওঠে প্রাণময়ী প্রকৃতি। ঘাসের মতো সবুজ কোমল সজীব তার হৃদয়।
তাঁর বহুল পঠিত কবিতা শিকার-এ বলছেন :
‘সুন্দর বাদামি হরিণ এই ভোরের জন্য অপেক্ষা করছিল।
এসেছে সে ভোরের আলোয় নেমে;
কচি বাতাবিলেবুর মতো সবুজ সুগন্ধী ঘাস ছিঁড়ে-ছিঁড়ে খাচ্ছে’
এখানে ঘাসের সঙ্গে সবুজ ও সুগন্ধী শব্দ দুটি জুড়ে দিয়ে তিনি হয়তো ঘাসকে হরিণের জীবনদায়ী এবং পুষ্টিকর খাদ্য হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। হরিণের ছুটে চলার সঙ্গে উচ্ছলতার সম্পর্ক চিরন্তন। শক্তির সঙ্গেও হরিণের একটা যোগসূত্র আছে। তা ছাড়া কচি বাতাবিলেবুর সবুজের সঙ্গে গাঢ় সবুজ পাতার পার্থক্য আছে। নীল ও হলুদ রং মেশালে সবুজ হয়। এর মধ্যে নীলের চেয়ে হলুদের পরিমাণ বেশি হলে কচি বাতাবিলেবুর রং হয়।
মানুষের যাবতীয় খাদ্যের মধ্যেও হলুদের প্রাধান্য। তাই কচি বাতাবিলেবুর মতো সবুজ রং বলে যে ঘাসের কথা জীবনানন্দ বলেছেন, সেই ঘাসকে মানুষের খাদ্যের প্রতীকরূপেও দেখা যেতে পারে। আর বাদামি রঙের হরিণকে দেখা যেতে পারে মানুষের প্রতীক হিসেবে। কারণ মানুষের, বিশেষ করে বাংলাদেশের মানুষের গায়ের রং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বাদামি।
সবুজ ঘাস দ্বারা তিনি যে উচ্ছ্বলতার কথা বলেছেন, বস্তুত সে রকম উচ্ছ্বল তিনি নিজে ছিলেন না। বরং কথা কম বলা, লোকজনের সঙ্গে পারতপক্ষে না মেশা, এসব করে করে সমাজের তথাকথিত ভদ্রলোকদের কাছে তিনি ‘অসামাজিক’ হয়ে উঠেছিলেন। তবুও তিনি বারবার সবুজ ঘাসের উপমা টেনেছেন। এর একটা কারণ হয়তো এই যে, মানুষের মধ্যে, বিশেষত তার চারপাশের বস্তুজগৎ ও রক্তমাংসে গড়া যান্ত্রিক সভ্যগণের ভেতরে তিনি কোনো সবুজ দেখতে পাননি। তাদের ভেতরে দেখেছিলেন শুধুই রিরংসা, লালসা। তাই হয়তো বুকের ভেতরে আজীবন পুষেছেন ঘাসের সন্তান হওয়ার বাসনা।
অন্য এক জায়গায় বলছেন, ‘মৌরির গন্ধমাখা ঘাসের শরীরে ক্লান্ত দেহটিরে রেখে আশ্বিনের ক্ষেতঝরা কচি কচি শ্যামাপোকাদের কাছে ডেকে রব আমি।’ অর্থাৎ সেই একই বাসনা এবং মানুষের প্রতি যেন খেদ। সুগন্ধী ঘাসের শরীরে শুয়ে তিনি কথা বলতে চান পোকার সঙ্গে।