ঢাকার কথা
ঢাকায় রেল ব্যবস্থা
বিশ্বে রেল ব্যবস্থার সূচনা হয়েছিল উনিশ শতকের প্রথমার্ধে। ১৮২৫ সালে ইংল্যন্ডে রেলের যাত্রা শুরু হয় জর্জ স্টিফেনসনের হাত ধরে। রেল যোগাযোগ ব্যবস্থায় একটি যুগান্তকারী পরিবর্তনের সম্ভাবনা জাগিয়ে তোলে। ভারতবর্ষের ইংরেজ শাসকরাও পরিকল্পনা গ্রহণ করে এ অঞ্চলে রেলওয়ের নেটওয়ার্ক গড়ে তোলে। রেল ব্যবস্থা গড়ে তোলার পেছেনে শাসকদের বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সক্রিয় ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রচুর পাট ও অন্যান্য ফসল উৎপাদিত হতো। কিন্তু যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো না থাকায় ইংরেজ শাসকদের বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য অনেকটা ব্যহত হতো। আবার উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে ইংরেজ শাসনবিরোধী আন্দোলন পল্লবিত হতে থাকলে তা প্রতিহত করার জন্যও যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত করার কথা ভাবতে হয়।
ভারতে রেলওয়ে স্থাপনের স্বপ্ন দ্রষ্টা ছিলেন লর্ড ডালহৌসি। তিনি ইংল্যন্ডে ইস্ট ইন্ডিয়া পরিচালক পর্ষদের কাছে এ ব্যাপারে তাঁর সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব পাঠান। এই সূত্রে বাংলা অঞ্চলে প্রথম রেলওয়ের যাত্রা শুরু হয়। এ সময় একটি বেশ বড় কয়লা খনি ছিল পশ্চিম বাংলার রানীগঞ্জে। সিদ্ধান্ত হয় কয়লা পরিবহনের জন্য কলকাতা থেকে রানীগঞ্জ পর্যন্ত রেল লাইন স্থাপন করা হবে। এই উদ্দেশ্যে ১৮৪৪ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ে কোম্পানি গঠন করা হয়। এই কোম্পানির তত্ত্বাবধানে ১৮৫৪ সালে হাওড়া থেকে হুগলি পর্যন্ত ৩৮ কিলোমিটার রেল লাইন নির্মাণ করে রেলের যাত্রা শুরু করা হয়।
পূর্ববাংলায় রেলের নেটওয়ার্ক তৈরির পরিকল্পনা এর আগেই গ্রহণ করা হয়েছিল। এই লক্ষ্যে ১৮৫৫ সালে ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে নামে একটি কোম্পানি গঠনের পরিকল্পনা করা হয়। এই কোম্পানি লাইন বসানো ও রেল চলাচলের সূচনা করে ১৯৬২ সাল থেকে। প্রথম দফায় কলকাতা থেকে কুষ্টিয়া পর্যন্ত ট্রেন চলাচল শুরু করে। এর পর রেল নেটওয়ার্ক গড়ে ওঠে উত্তর বাংলায়। প্রধানত বাণিজ্যিক উদ্দেশেই ঢাকায় রেল ব্যবস্থা চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। বিশেষ করে ঢাকা ও ময়মনসিংহ থেকে পাট কলকাতাতে সহজে নেওয়ার জন্য রেল পথের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করা হয়। উদ্দেশ ছিল ময়মনসিংহ থেকে রেল পথে পাট ঢাকা হয়ে নারায়ণগঞ্জে এনে সেখান থেকে নৌপথে কলকাতায় পাঠানো হবে। এই লক্ষ্যে ‘ঢাকা স্টেট রেলওয়ে’ নামে রেল কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হয়। এই কোম্পানির তত্ত্বাবধানে ১৮৮৫ সালে পর্যায়ক্রমে ময়মনসিংহ থেকে ঢাকা হয়ে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত রেল লাইন স্থাপন করা হয়। এ পর্যায়ে ১৪৪ কিলোমিটার লম্বা মিটারগেজ লাইন বসানো হয়েছিল। তবে রেল পরিচালনা করা হয় ধাপে ধাপে। ১৮৮৫ সালের জানুয়ারি মাস থেকে চালু হয় ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রেলপথ। এরপর ঢাকা-জয়দেবপুর রেলপথ এ বৎসরের আগস্ট মাসে স্থাপন করা হয়। পরের বছর অর্থাৎ ১৮৮৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ময়মনসিংহ পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়েছিল রেলপথটি।
পাকিস্তান আমলে ১৯৬০-এর দশকে ঢাকা-টঙ্গী ডাবল লাইনট্র্যাকের কাজ শুরু হয়। ১৯৫০ সালের মাঝপর্ব পর্যন্ত ঢাকার রেল স্টেশন ছিল ফুলবাড়িয়ায়। ক্রমে এই এলাকা ঘন বসতিপূর্ণ হয়ে পড়ে। এ কারণে রেল স্টেশন সরিয়ে নেওয়ার চিন্তা করা হয়। এই সূত্রেই ১৯৫০ সালের শেষ দিকে ফুলবাড়িয়া থেকে রেল স্টেশন স্থানান্তর করে নিয়ে আসা হয় কমলাপুরে। কমলাপুর রেল স্টেশন নির্মাণ ও রেল লাইন স্থাপনের কাজ ১৯৫০-এর শেষ দিকে শুরু হলেও তা চলতে থাকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত। এ বৎসর মে মাস থেকে কমলাপুর স্টেশনে রেল চলাচল শুরু হয়। ১৯৬০ সালের মাঝামাঝি ঢাকা-চট্টগ্রাম লাইনে আধুনিকীকরণ সম্পন্ন করা হয়। এ পর্যায়ে রাজধানীর সাথে চট্টগ্রামে যাত্রী ও পণ্য পরিবহনে রেল ছিল প্রধান বাহন।