ঢাকার কথা ৩০
ঢাকার বাণিজ্যে মাড়োয়ারি
মোগল ও ঔপনিবেশিক আমলে ঢাকার বাণিজ্য ও ব্যাংকিং ব্যবস্থায় মাড়োয়ারি ব্যবসায়ীরা বিশেষ স্থান দখল করে নেয়। ভারতের মাড়োয়ার অঞ্চলের ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি গোষ্ঠীর মানুষেরা বাংলায় মাড়োয়ারি নামে পরিচিত। রাজস্থানের প্রাচীন যোধপুর রাজ্যে এই মাড়োয়ার অঞ্চলের অবস্থান। বিশ্বাসযোগ্যতা ও পেশাদারত্বের কারণে মাড়োয়ারিদের প্রতি মানুষের আস্থা ছিল। এ কারণে রাজস্থানের অন্যান্য অঞ্চলের বণিকরাও এ দেশে ব্যবসা করতে এসে নিজেদের মাড়োয়ারি বলে পরিচয় দিত। ইংরেজ শাসনযুগে ঢাকায় বাণিজ্যে প্রতিষ্ঠিত এবং সামাজকর্মে নিয়োজিত উত্তর ভারত থেকে আসা সবাইকেই মাড়োয়ারি বলে মনে করা হতো।
ঢাকায় মাড়োয়ারিদের আগমন শুরু হয় সতের শতকের আগে থেকেই। মাড়োয়ার অঞ্চলের মাড়োয়ারিরা কয়েকটি সম্প্রদায়ে বিভাজিত ছিল। যেমন পড়ওয়াল, ওসওয়াল, আগরওয়াল, মহেশ্বরী, খান্ডেশওয়াল প্রভৃতি। নবাবী শাসনকালে বাংলায় ব্যবসা বাণিজ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী ছিলেন ওসওয়াল সম্প্রদায়ের ব্যবসায়ীরা। এ সময় ঢাকায় ব্যাংকিং ব্যবস্থা গড়ে তোলায় এই সম্প্রদায়ের মাড়োয়ারিদের বিশেষ ভূমিকা ছিল। মাড়োয়ারিরা ব্যাংক ছাড়াও অর্থ লগ্নীকারী প্রতিষ্ঠানও গড়ে তোলে। তারা লবণ, কাপড়, খাদ্যশস্য ইত্যাদি ব্যবসায় একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছিল।
মাড়োয়ারি ব্যবসায়ীরা মোগল যুগে- সম্ভবত সম্রাট আকবরের সময়ে প্রথম বাংলায় প্রবেশ করে। এদের কেউ কেউ কিছুকাল ব্যবসা বণিজ্যে নিয়োজিত থেকে আবার স্বদেশে ফিরে যায় আবার কেউ কেউ স্থায়ীভাবে থেকেও যায়। ঢাকায় কোনো কোনো মাড়োয়ারি পরিবার পাকাপাকিভাবে থেকে গিয়েছিল। নবাব মুর্শিদ কুলি খানের সময় থেকে মাড়োয়ারিরা ব্যবসায়ে বেশ ফুলে ফেঁপে ওঠে। তাদের ভাগ্য প্রসন্ন হওয়ার পেছনে নবাবের ‘মালগুজার’ ব্যবস্থার ভূমিকা ছিল। এই ব্যবস্থায় ঋণগ্রস্ত ইজারাদার তালুকদাররা তাদের পক্ষে অর্থপ্রদানকারী জামিনদার হাজির করতে পারলে জমি নিলামের হাত থেকে রক্ষা পেত। এ সময়ে মাড়োয়ারিরা জামিনদার হতেন। ক্রমে জামিনদারি একটি বড় ব্যবসায়ে পরিণত হয়। এমন একজন বড় মাড়োয়ারি ব্যবসায়ী ছিলেন দুলালচাঁদ সিং। বিপুল অর্থের মালিক এই মাড়োয়ারি ব্যবসায়ী বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় অনেক জমিদারির স্বত্ব কিনে নেয়। দুলালচাঁদ সিং বসবাসের জন্য ঢাকা শহরকেই বেছে নিয়েছিলেন। ঢাকায় অনেক বিপণিকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। তিনি ছিলেন পড়ওয়াল গোত্রের মাড়োয়ারি। এক সময় এই মাড়োযারি পরিবার এ দেশে পাটের ব্যবসায় একচেটিয়া আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে।
বাংলায় মাড়োয়ারি ব্যবসায়ীরা ব্যাপক সংখ্যায় প্রবেশ করতে থাকে উনিশ শতকে। এ পর্বে ঢাকাসহ পূর্ববাংলার অনেক জেলায় মাড়োয়ারিরা বসতি বিস্তার করে। মাড়োয়ারিদের হাতে ক্রমে দেশের বাণিজ্য অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ চলে যায়। ঢাকার অনেক ব্যাংক ও বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানে মাড়োয়ারিরা বিপুল অর্থ লগ্নী করতে থাকে।
ধর্ম ও রাজনীতির প্রশ্নে বিশ শতকের প্রথম দিকে মাড়োয়ারিদের মধ্যে একটি বিভাজন লক্ষ করা যায়। অবশ্য এই বিভাজনের শুরুটা হয় কলকাতা কেন্দ্রিক মাড়োয়ারিদের মধ্যে। এদের একটি অংশ ছিল ব্রিটিশ শাসকদের অনুগত এবং ধর্মের ব্যাপারে বেশ গোঁড়া। অন্য অংশটি জাতীয়তাবাদী চেতনা লালন করতেন। এঁরা ছিলেন সংস্কারবাদী। এঁরা সমাজের কল্যাণমুখী নানা কাজে অর্থ ব্যয় করতেন। রক্ষণশীল অংশটি হিন্দু মুসলমানদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিভেদ সৃষ্টিতে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিল। এই অংশটি মুসলমানদের প্রতি মোটেই সদয় ছিল না।
বিশ শতকের প্রথম পর্বে ঢাকাসহ পূর্ববাংলার বিভিন্ন অংশে বিপুল মাড়োয়ারি বসতি গড়ে উঠেছিল। তবে দুই প্রস্থে মাড়োয়ারিদের অনেকে আবার বাংলা ছেড়ে চলেও যায়। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর বেশ কিছু সংখ্যক মাড়োয়ারি তাদের ব্যবসা গুটিয়ে ঢাকা থেকে চলে গিয়েছিল। এরপর থেকে যাওয়া মাড়োয়ারিদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ঢাকা ছাড়ে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময়। এখন বাংলাদেশে অবস্থানকারী মাড়োয়ারির সংখ্যা একহাজারেরও কম। ঢাকার বাণিজ্য অঞ্চলে মাড়োয়ারিদের অবস্থান এখনো লক্ষণীয়।