ঢাকার কথা ৩২
প্রাক-মোগল পর্বে ঢাকার নাগরিক যাত্রা
প্রয়োজনীয় তথ্যের অভাবে মোগলপূর্ব যুগে ঢাকার নগর পরিকল্পনা কেমন ছিল সে সম্পর্কে বিস্তারিত লেখা সম্ভব নয়। ১৫ শতকের মাঝামাঝি পুরান ঢাকার নারিন্দা ও কেন্দ্রীয় কারাগারের কাছে মসজিদ গড়ে তোলার কথা জানা যায় শিলালিপি সাক্ষ্যে। শিলালিপির বক্তব্য অনুযায়ী সে সময় স্বাধীন সুলতানি বাংলার একটি প্রদেশ ছিল এ অংশে। সোনারগাঁও থেকে বিক্রমপুর ও ঢাকা হয়ে বরিশাল পর্যন্ত ছিল এই প্রদেশের সীমানা। ১৩৩৮ সালে সোনারগাঁওয়ে স্বাধীনতা ঘোষণাকারী সুলতান ফখরউদ্দিন মোবারক শাহের নাম থেকে এই প্রদেশের নাম রাখা হয় মোবারকাবাদ। ফারসিতে প্রদেশ বা বড় বিভাগকে বলা হতো ‘ইকলিম’। শিলালিপি সাক্ষ্যে ইকলিম মোবারকবাদের রাজধানী ছিল আজকের পুরান ঢাকা। সে যুগে নগর ঢাকার পরিধি কতটুকু ছিল তা বলার উপায় নেই। তবে শহরতলী হিসেবে মিরপুরে যে সুলতানি যুগে মুসলিম বসতি গড়ে উঠেছিল তা অধুনা বিলুপ্ত মসজিদ ও মসজিদের গায়ে সাঁটা শিলালিপি পাঠে জানা যায়।
বাংলায় স্বাধীন সুলতানি রাজ্যের অবসান ঘটে ১৫৩৮ সালে। এ সময় শেষ স্বাধীন সুলতান গিয়াস উদ্দিন মাহমুদ শাহ মোগল সম্রাট হুমায়ুনের কাছে পরাজিত হন। কিন্তু বাংলায় মোগল আধিপত্য সুপ্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি। হুমায়ুন গৌড় অধিকার করে মাত্র ছয় মাস টিকে থাকতে পেরেছিলেন। এ পর্যায়ে বিহার অঞ্চলের আফগান শাসক শেরখান হুমায়ুনের বিরুদ্ধে সৈন্য পরিচালনা করেন। ১৫৩৯ সালের জুলাই মাসে হুমায়ুন বিতাড়িত হন। এভাবে বাংলা আফগান শাসনের অধীনে চলে আসে আর দিল্লির মোগল শাসন যুগে বাংলা বিচ্ছিন্ন হয়ে এক ধরনের স্বাধীন অঞ্চলে পরিণত হয়। এভাবে দীর্ঘকাল বাংলা মোগল অধিকারের বাইরে থেকে স্বাধীনভাবে শাসন পরিচালনা করছিল। ভাটি বা নিচু অঞ্চল বলে পূর্ববাংলা বরাবরই বিচ্ছিন্ন থাকার সুযোগ পেয়েছে। স্বাধীন সুলতানি যুগের পরেও তাই পূর্ব বাংলা তার স্বাধীন সত্তা নিয়ে টিকে ছিল। এই পর্বে পূর্ববাংলায় একক কোনো রাজ্য গড়ে ওঠেনি। অনেক বড় বড় জমিদারের অধীনে বিভক্ত ছিল বাংলার এ অংশটি। এঁরা সাধারণভাবে ‘বারোভুঁইয়া’ নামে পরিচিত। এই বারোভুঁইয়ারা একযোগে মোগলদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। সম্রাট আকবরের আমলে বারভুঁইয়াদের নেতা ছিলেন ঈসা খান মসনদ-ই-আলা। ঈসা খানের মৃত্যুর পর পুত্র মুসা খানের হাতে নেতৃত্ব চলে আসে।
মোগল সুবাদার ইসলাম খানের ঢাকা দখলের সাধারণ কারণ বারো ভুঁইয়াদের চূড়ান্তভাবে পরাজিত করা। মোগলরা উত্তর থেকে পূর্ব বাংলার দিকে অগ্রসর হয়েছিল। পথে অনেক জমিদার মোগল বশ্যতা স্বীকার করেন। বারোভুঁইয়াদের শেষ ঘাঁটি শীতলক্ষ্যা নদীতে। সোনারগাঁওয়ের কাছে কাতরাবোতে ছিল মুসা খানের শাসন কেন্দ্র। বর্তমান নারায়ণগঞ্জ শহরে অবস্থিত মোগল জলদুর্গ হাজিগঞ্জ দুর্গ শীতলক্ষ্যার তীরে অবস্থিত। হাজিগঞ্জ দুর্গ বরারব নদীর পূর্ব পাড়ে নবীগঞ্জ। এখানেই ছিল মুসা খানের সামরিক ছাউনি। এখানে পরবর্তী সময়ে গড়ে উঠেছিল অনুপম স্থাপত্য শৈলীতে কদমরসুল ইমারত। কদমরসুলের সামনেই বারোভুঁইয়া পর্বে শীতলক্ষ্যা নদীতে ছিল বারোভুঁইয়াদের রণতরী। তাই বারোভুঁইয়াদের শেষ শক্তিতে আঘাত করার জন্য এর কাছাকাছি অঞ্চল ঢাকাকে বেছে নিতে হয়েছিল মোগল সুবাদারকে।
মোগল আগমনের পূর্বে ঢাকার নাগরিক জীবনের আরেকটি স্মৃতি বর্তমান কেন্দ্রীয় কারাগার এলাকায় নির্মিত একটি দুর্গ। আফগানদের বা স্থানীয় জমিদারদের গড়া ছিল এই দুর্গ। ঢাকা দুর্গ নামে পরিচিত এই দুর্গ সংস্কার করে এখানে সুবাদার ইসলাম খানের আবাসস্থল বানানো হয়। মোগল অধিকারের পূর্বে এই দুর্গ ঢাকার নাগরিক জীবনের কথাই মনে করিয়ে দেয়। মোগল যুগেই সম্ভবত দুর্গটি ভেঙে ফেলা হয়েছিল।
ঢাকা অধিকারের পর মোগল সেনাপতি ইতিমাম খাঁ ও মির্জা নাথানকে ডেমরা খালের মোহনার দুপাশে অবস্থিত জমিদার বেগ মুরাদ খাঁ নির্মিত দুর্গ দুটির দায়িত্ব গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হয়। এই বর্ণনায় ঢাকার অভ্যন্তরে ঢাকা দুর্গ এবং উপকণ্ঠ ডেমরায় দুটো দুর্গের অবস্থানও বারো ভুঁইয়াদের সময় ঢাকার গুরুত্বকে নির্দেশ করে। তবে তথ্যের অভাবে এ সময়েও নগর ঢাকার পূর্ণাঙ্গ চিত্র উপস্থাপন করা সম্ভব নয়। মোগল পর্ব থেকে ঢাকার নগর বিকাশের চিত্র অনেক বেশি স্পষ্ট হয়।