সত্যজিৎ রায় ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ
যেকোনো বড় ঐতিহাসিক ঘটনাই সত্যিকারের সৃষ্টিশীল মানুষকে আন্দোলিত করতে বাধ্য। সৃষ্টিশীল মানুষরা সংবেদনশীল হন, তাঁরা সৃষ্টির মাধ্যমে আবেগ, রাগ, ক্ষোভ ও দ্রোহ প্রকাশ করেন। এর কিছু জ্বলন্ত নমুনা আমরা দেখি ১৯৭১ সালে বা অব্যবহিত বছরগুলোতে। এই ভূখণ্ডের জহির রায়হান, আলমগীর কবির, সুভাষ দত্ত, চাষী নজরুল ইসলামসহ আরো অনেকে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। তবে পুরো বঙ্গের একমাত্র অস্কারজয়ী পরিচালক সত্যজিৎ রায়কে অবশ্য সেই চেষ্টা করতে দেখা যায় না।
মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগেই যে শোষণ বঞ্চনার মধ্য দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ দিন গুজরান করছিল, সেটার প্রতিবাদ করেছিলেন জহির রায়হান- তাঁর রূপকধর্মী চলচ্চিত্র ‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবির মাধ্যমে। এই ছবি করার যে সাহস জহির রায়হান দেখিয়েছিলেন, সেটার প্রশংসা করেছিলেন ঋত্বিক ঘটক। ১৯৬৯ সালে মুক্তি পায় ছবিটি। এরপর যুদ্ধ চলাকালে তো তিনি নির্মাণ করলেন ‘স্টপ জেনোসাইড’ নামের এক প্রামাণ্যচিত্র। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি নিহত হন। এরপর মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মাণে এগিয়ে আসেন আলমগীর কবির, চাষী নজরুল ইসলাম, সুভাষ দত্ত, মমতাজ আলী, আনন্দ, খান আতাউর রহমান প্রমুখ। ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে খুন করার পর দীর্ঘদিন মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মাণ হয়নি বাংলাদেশে। পরে অবশ্য এই মেঘ কেটে যায়। এদিকে, পঁচাত্তরের আগে মুক্তি পাওয়া মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক কাহিনীচিত্রের সবই যে মানসম্মত কাজ ছিল তাও কিন্তু নয়। মুক্তিযুদ্ধের ছবির নাম করে ধর্ষণকে সেখানে ব্যবহার করা হয়েছে বাণিজ্যিক কারণে।
আশির দশকে, নির্দিষ্ট করে বললে ১৯৮৪ সালে প্রথম স্বল্পদৈর্ঘ্য কাহিনীচিত্র মুক্তি পায় মুক্তিযুদ্ধের উপর। ‘আগামী’ ছবিটি নির্মাণ করেন মোরশেদুল ইসলাম। এরপর একে একে তানভীর মোকাম্মেল, মোস্তফা কামাল, আবু সায়ীদসহ আরো অনেকে স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন।
যুদ্ধের সময় থেকে শুরু করে স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেছেন জহির রায়হান, আলমগীর কবির, সৈয়দ শামসুল হক, তানভীর মোকাম্মেল, তারেক মাসুদ, ক্যাথরিন মাসুদ, কাওসার চৌধুরী প্রমুখ।
অন্যদিকে, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর নানাভাবে মুক্তিযুদ্ধের বিষয়টি ভারতের হিন্দি ও বাংলা ভাষার চলচ্চিত্রে ধরা দিলেও, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ওপার বাংলার মাস্টার ফিল্মমেকাররা কিন্তু তেমনভাবে সাড়া দেননি। এখানে কবি দাউদ হায়দারের এক স্মৃতিচারণা প্রণিধানযোগ্য, বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকায় তিনি বলেছিলেন এসব কথা। দাউদ হায়দার সত্যজিৎ রায় সম্পর্কে বলছেন,
‘সত্যজিৎ রায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে-স্বাধীনতায় অবদান রেখেছেন? কবে? কখন? কোথায়? বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কলকাতায় মিছিল, সভা কম হয়নি। বুদ্ধিজীবী-শিল্পী-সাহিত্যিক-সাংবাদিক-সাংস্কৃতিক কলাকুশলীর উদ্যোগে অন্তত কুড়িটি অনুষ্ঠান হয়েছে। অন্নদাশঙ্কর রায়, প্রেমেন্দ্র মিত্র, সুচিত্রা মিত্র প্রমুখ অনুরোধ জানিয়েছেন ফোনে, অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার জন্য। মৃণাল সেন, চিন্মোহন সেহানবীশ, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, পরিতোষ সেন, দেবেশ রায় জোট বেঁধে সত্যজিতের কাছে গেছেন, মিছিলে সভায় যোগ দেওয়ার জন্য। আইভরি টাওয়ার থেকে কবে নেমেছেন? মানিকদা আমার প্রিয়। আমি ওঁর (সত্যজিৎ রায়) স্নেহভাজন। দুঃসময়ে সাহায্যও করেছেন নানাভাবে। সর্বদাই কৃতজ্ঞ ওঁর প্রতি। কৃতজ্ঞতা মানে এ নয়, কোনো অবদান ছাড়াই সম্মাননা মেনে নেওয়া।’
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও সত্যজিতের অবস্থান প্রসঙ্গে আমার কথা হয় অস্ট্রেলিয়ার চলচ্চিত্র সমালোচক ও লেখক জন ডব্লিউ হুডের সঙ্গে। তিনি পশ্চিমবঙ্গে দীর্ঘদিন থেকেছেন, সেখানকার অনেক চলচ্চিত্র নির্মাতাকে নিয়ে লেখালেখিও করেছেন। সত্যজিতের ওপর লেখা তাঁর বিখ্যাত বইটির নাম ‘বিয়ন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড অব অপু’। তো মুক্তিযুদ্ধের সময় সত্যজিতের নিষ্ক্রিয় ভূমিকা প্রসঙ্গে হুড বলেন, শৈল্পিক সততার কথা। তিনি বলেন, বাংলাদেশ থেকে যে পরিমাণ শরণার্থী পশ্চিমবঙ্গে গেছে এবং এতে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তাতে প্রামাণ্যচিত্র করা যায়, কাহিনীচিত্র নয়। আর এত বড় ঘটনাকে চলচ্চিত্রের মাধ্যমে ধরার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না বলেই কাজ করা হয়ে ওঠেনি সত্যজিতের।
এ ছাড়া সত্যজিতের সমসাময়িক নির্মাতা যেমন মৃণাল সেন, তপন সিংহসহ অনেকেই তখন নকশাল বাড়ির আন্দোলন নিয়ে চিন্তিত। হুড বলতে চান সেই সময়টা তাঁরা নিজেদের সমস্যা নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন, পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের মতো বড় ঘটনাকে চলচ্চিত্রে ধরার ক্ষমতা তাঁদের ছিল না বলেই কাহিনীচিত্র নির্মাণের দিকে পা বাড়াননি মাস্টার ফিল্ম মেকাররা। এটাকে শৈল্পিক সততা হিসেবে আখ্যা দেন জন হুড।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, সত্যজিৎ রায় কি প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করেননি? ১৯৭১ সালেই তো মুক্তি পেল ‘সিকিম’, এ ছাড়া ১৯৭১ সালের আগে ও পরে ‘রবীন্দ্রনাথ’, ‘ইনার আই’, ‘বালা’, ‘সুকুমার রায়’ এসব প্রামাণ্যচিত্রও নির্মাণ করেছেন তিনি। তাহলে লাখ লাখ শরণার্থীর দুর্দশাকে কি ফিল্মে ধরে রাখা যেত না? তখন তো ঠিকই জহির রায়হান ঘুরে ঘুরে ক্যামেরাবন্দি করেছেন শরণার্থীদের করুণ চিত্র। আলমগীর কবিরও কাজ করেছেন জহির রায়হানের সঙ্গে। ঋত্বিক ঘটক নিজে চাঁদা তুলেছিলেন বাংলাদেশ থেকে আসা শরণার্থীদের জন্য। বলছি না, সত্যজিৎকে মুক্তিযুদ্ধের ওপর কিছু করতেই হবে। কিন্তু এত বড় মাপের একজন শিল্পী কি করে এতটা নিশ্চুপ রইলেন? এটাই বড় বিস্ময়ের। একাত্তর সালের ঘটনা নিয়ে যেখানে রবিশঙ্কর ও জর্জ হ্যারিসন মিলে এক বিশাল কনসার্ট করে ফেললেন যুক্তরাষ্ট্রে, সেখানে যুদ্ধের উত্তাপ পেয়েও নিরুত্তাপ কি করে থাকলেন সত্যজিৎ রায়?
যদিও অনেক পরে, প্রায় চার বছর পর, বাংলাদেশি কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের উপন্যাস ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ নিয়ে চলচ্চিত্র করার আগ্রহের কথা জানিয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়, ১৯৭৫ সালে। উপন্যাসটি খসড়া আকারে, গল্প হিসেবে আগে ছাপা হয় কলকাতার তরুণ সাহিত্যিকদের পত্রিকা টেরোড্যাকটিলে। সেখানেই প্রথম সত্যজিৎ গল্পটি পড়েন। এই গল্পের উপর চলচ্চিত্র নির্মাণের কথাও ভাবেন তিনি। চিঠিতে সত্যজিৎ লিখেছেন,
“প্রিয় সেলিনা হোসেন
মাননীয়াসু,
আপনার চিঠি কিছুদিন হলো পেয়েছি। আমার নতুন ছবির কাজ এবং পুঁজোর লেখা নিয়ে একান্ত ব্যস্ত থাকায় উত্তর দিতে দেরি হয়ে গেল।
'ট্যারোড্যাকটিল' পত্রিকায় প্রকাশিত আপনার ছোটগল্পটি পড়ে আমার যে খুব ভালো লেগেছিল তা আমি অনেককেই বলেছিলাম। গল্পটি থেকে ভালো চলচ্চিত্র হয় এ বিশ্বাসও আমার ছিল। কিন্তু তখন আমার হাতে অন্য ছবি থাকায় ওটার কথা চিন্তা করতে পারিনি। পরে বাংলাদেশে গিয়ে ছবি করার প্রশ্নে ওঠে আরেকবার; তখন শুনেছিলাম ওখানকার অবস্থা ভালো নয়, কাজে নানারকম অন্তরায়ের সম্ভাবনা আছে। সুতরাং,পরিকল্পনাটি স্থগিত থাকে।
এখন আমি আমার অন্য ছবির কাজে জড়িয়ে পড়েছি। কবে মুক্ত হব জানি না। এ অবস্থায় আপনাকেই বা কীভাবে গল্পটা ধরে রাখতে বলি তাও বুঝতে পারছি না। সংশয় হয় অন্য কারো হাতে পড়লে এমন চমৎকার গল্পটি হয়তো যথাযথভাবে চিত্রায়িত হবে না। সে বিষয় যদি (অপর পৃষ্ঠায় এরপর) আপনি নিজে পছন্দ করে কাউকে গল্পটা দিতে পারেন তাহলে আমার কিছু বলার থাকে না। এ ব্যাপারে আপনি যা ভালো বোঝেন তাই করুন- এ আমার অনুরোধ।
আপনার সম্পাদিত পত্রিকার জন্য এর পর কোনো লেখা দিতে পারব বলে মনে হয় না। সন্দেশের লেখা এখনো লিখে উঠতে পারিনি।
আপনার গল্পটি উপন্যাসাকারে প্রকাশিত হলে পড়ার ইচ্ছে রইল।
নমস্কারান্তে ভবদীয়
সত্যজিৎ রায়
১৩/০৮/৭৫
(চিঠিটি নেওয়া হয়েছে ‘আলোকিত বাংলাদেশ’ পত্রিকার ৩০ মে ২০১৪ তারিখের সংখ্যা থেকে।)
এই চিঠিতে জানানোর পরও আশির দশকে এক সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ওপর চলচ্চিত্র করার কথা জানিয়েছিলেন সত্যজিৎ। রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় তিনি আর সেই ছবির কাজে হাত দেননি। তবে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে তাঁর ভাবনার দেখা পাওয়া যায়নি সেখানেও।
পঁচাত্তর সালের আগে সত্যজিতের স্ত্রী বিজয়া রায়ের দিনলিপি থেকে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে কথা পাওয়া গেলেও এ সম্পর্কে সত্যজিতের কোনো অনুভূতি বা মন্তব্য জানা যায় না। অন্তত আমি পাইনি। যেমন পশ্চিমারা পাকিস্তানকে মদদ দিচ্ছে, এমনকি চীনও, শুধু রাশিয়া মদদ দিচ্ছে না। তারপর পূর্ব পাকিস্তান একটি ছোট দেশ, যুদ্ধ বেধে গেছে, তারা সামলে উঠতে পারবে তো? এই যুদ্ধের সঙ্গে ভারত জড়িয়ে পড়েছে, এখন পশ্চিমবঙ্গের কী হবে? বিজয়া রায় এখানে চিন্তিত নিজেদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে নিয়ে, তারা কোনো বিপদের মুখে পড়বে কি না! একজন মা হিসেবে বিজয়া রায়ের এই অনুভূতি স্বাভাবিক। আরেক জায়গায় তিনি চিত্রগ্রাহক রঘুবীর সিংয়ের কথা বলেছেন। রঘু বাংলাদেশের শরণার্থীদের ছবি দেখাতে আসতেন সত্যজিৎকে এবং সেটা নিয়ম করে। কিন্তু এসব ছবি দেখে সত্যজিৎ কী বলতেন বা তাঁর অনুভূতি কী হতো তা আর জানা যায় না বিজয়ার লেখা থেকে। আপনারা যাঁরা বিজয়া রায়ের স্মৃতিকথা ‘আমাদের কথা’ পড়েছেন তাঁরা এগুলো জানেন। ১৯৭১ সালে যুদ্ধচলাকালে সত্যজিৎ ‘সীমাবদ্ধ’ ছবির কাজ করছিলেন। এর পাশাপাশি সত্যজিৎ ও বিজয়ার জেমস বন্ড চলচ্চিত্র ‘ডক্টর নো’ কিংবা হিচককের ‘সাইকো’ দেখতে যাওয়ার খবরও মেলে। কিন্তু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে বিজয়ার মানিকের কোনো প্রতিক্রিয়া চোখে পড়ে না।
অথচ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ঋত্বিক ঘটককে নাকি পাগল করে দিয়েছিল। ‘চলচ্চিত্র মানুষ এবং আরো কিছু’ গ্রন্থের ৩২৩ পৃষ্ঠায় দেখুন, দেখবেন এক সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশ নিয়ে কথা বলছেন ঋত্বিক। মুক্তিযুদ্ধের সময় উদ্দীপনা ও উদ্দামতা নিয়ে কাজ করার কথা বলেছেন সেখানে। বলছেন, সেই সময় ‘দুর্বার গতি পদ্মা’ নামের এক স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণের কথা। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধই ছিল সেই ছবির উপজীব্য। তিনি বলছেন, ‘হ্যাঁ ছবিতে অবশ্য কিছুই তুলতে পারিনি, তোলা যায়নি, সম্ভবপর ছিল না, শুধু চোখে দেখে এসেছি।’ মানে মুক্তিযুদ্ধের বিশালতাকে না ধরতে পারার আকুতির কথা আছে, আবার চেষ্টাটাও আছে। এটাই প্রকৃত শিল্পীর সততা। শিল্পী ঘটনাকে ধরার চেষ্টা করবেন এবং সেই ধরাতে অতৃপ্ত থাকবেন, সেটা স্বীকার করবেন, এখানেই শিল্পী ও শিল্পের সৌন্দর্য।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার কয়েক মাস পর, মানে ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন হলো বাংলাদেশ, আর পরের বছর ১৯৭২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার পল্টন ময়দানে এক জনসভায় ভাষণ দেন সত্যজিৎ রায়। সদ্য প্রকাশিত সত্যজিৎ রায়ের ‘প্রবন্ধ সংগ্রহ’ বইতে দেখুন, পুরো ভাষণটিই পাবেন। দুই মাস আগে স্বাধীন হওয়া দেশে এসে সত্যজিৎ মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে একটি কথাও বলেননি। শুধু বলেছেন, ‘হঠাৎ কিছুদিন আগে ইতিহাসের চাকা ঘুরে গেল, আমার কাছে আমার দেশের দরজা খুলে গেল’- মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা শুধুই ‘ইতিহাসের চাকা ঘুরে যাওয়া’ সত্যজিতের কাছে!
শুধু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গেই নয়, খোদ রাজনীতি নিয়েও বিশেষ আগ্রহ বোধহয় ছিল না সত্যজিতের, আর থাকলেও সেটা প্রকাশ্যে বলতে চাইতেন না বলেই প্রতীয়মান হয়। ‘নিজের আয়নায় সত্যজিৎ : দীর্ঘতম ও শেষ সাক্ষাৎকার’ বইতে সত্যজিৎকে রাজনীতি নিয়ে প্রশ্ন করা হয়েছিল। দেখা গেল উনি এড়িয়ে যাচ্ছেন। প্রশ্ন করা হচ্ছে শিল্পীর রাজনৈতিক চেতনা আদৌ থাকা দরকার আছে কি না? এর জবাবে সত্যজিৎ সমকালের রাজনীতিবিদদের ব্যর্থতার কথা উল্লেখ করেন। আরেক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলছেন, ‘এখন তো রাজনীতি (নিয়ে) প্রায় আলোচনা বন্ধ করে দিয়েছি।... পলিটিশিয়ানস অ্যান্ড হোল গেম অব পলিটিকস খুব ডিজনেস্ট- খুব ছেলেমানুষি (মনে হয়)’। নিজের সময়ের রাজনীতি নিয়ে তিনি বেশ বিরক্ত বোঝা যায়, কিন্তু তিনি কি তখন ভুলে গিয়েছিলেন তৎকালীন বাম সরকারের সহায়তা নিয়েই জীবনের প্রথম মাইলফলক ‘পথের পাঁচালী’ নির্মাণ করেছিলেন তিনি?
শিল্পী হিসেবে সত্যজিতের রাজনৈতিক চেতনা ছিল না, তা কিন্তু নয়, ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’, ‘শতরঞ্জ কি খিলাড়ি’ কিংবা ‘ঘরে বাইরে’ দেখলে কিন্তু সেটা মনে হয় না। সেখানে রাজনীতি নিয়ে শিল্পী সত্যজিতের মনোভাব ধরা পড়ে। তাঁর সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক ছবি আমি মনে করি ‘হীরক রাজার দেশে’। এখনকার বাস্তবতায় প্রায়ই এই ছবির নাম শোনা যায় রাজনীতিবিদদের মুখে। কিন্তু এমন সব রাজনৈতিক চলচ্চিত্রের নির্মাতা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কোনো প্রামাণ্যচিত্র দূরে থাক সে রকম কোনো কথা বা অনুভূতিও প্রকাশ করেননি- এটা সত্যি অবাক করে!