ফিরে এসো অভিভাবক!
এই তো গেল ডিসেম্বরে তিনি যেন আমাদের আশ্বাস দিয়েই বললেন- মহাত্মা লালন বেঁচেছিলেন ১১৬, মতান্তরে, ১১৮ বছর। তাই তিনি এখনই মৃত্যুর কথা ভাবছেন না। অনেক লেখা তাঁর করোটির মধ্যে পরিপুষ্ট হচ্ছে। সেগুলো লিখে শেষ করতে তাঁর আরো অনেক বছর দরকার হবে।
তাঁর ৮১তম জন্ম উৎসবে বাংলা একাডেমির ‘আব্দুল করিম সাহিত্য বিশারদ’ সভাকক্ষে উপচেপড়া ভিড়ের সামনে প্রাণবন্ত অননুকরণীয় বাচনভঙ্গিতে তিনি বললেন- এখনই তিনি যেতে চান না। আগামী ২০২০ সালে জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন তিনি অবশ্যই করবেন। উদযাপন করবেন ২০২১ সালে পৃথিবীর একমাত্র বাঙালি-রাষ্ট্র বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী।
অথচ গত সপ্তাহে তাঁকে লন্ডনে চিকিৎসা নিতে যেতে হয়েছে। আমরা আতঙ্কের সঙ্গে জানতে পেরেছি ফুসফুস তাঁর আক্রান্ত হয়েছে ক্যানসার দ্বারা। আর আমরা, বিশেষ করে আমি, আতঙ্কিত বাংলাসাহিত্যের অভিভাবককে নিয়ে। সমস্ত অন্তর এই কথাটাই বিশ্বাস করতে চাইছে যে ফুসফুসের ক্যানসার যেহেতু প্রাথমিক অবস্থাতেই ধরা পড়েছে, তাই তিনি সুস্থ হয়ে ফিরে আসতে পারবেন। কিন্তু ভয় যাচ্ছে না কিছুতেই। কারণ রোগের নামটি ক্যানসার।
মাস তিনেক আগেও তাঁকে দেখেছি চিরাচরিত ঋজু ভঙ্গিতে হাঁটতে, কথা বলতে, দূরভ্রমণে যেতে। তাঁর সাথে একবার একই গাড়িতে ঢাকা থেকে বেশ দূরে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। দূরের যাত্রায় বারবার গাড়ি থামিয়ে হাত-পায়ের খিল ছাড়ানো, ঘন ঘন বাথরুমে যাওয়া, যাত্রাপথে গরম বা শীতের বাহুল্য নিয়ে অনুযোগ করা- এসব কোনোদিন দেখিনি তাঁর মধ্যে। মনে হতো আমাদের মধ্যে সবচাইতে তারুণ্যদীপ্ত, শারীরিকভাবে সবচাইতে দুরস্ত ব্যক্তিটি হচ্ছেন সৈয়দ শামসুল হক। শারীরিক অভিযোগের মধ্যে একটা কথাই কেবল একবার বলেছিলেন আমাকে- তিনি খেতে পারছেন না। খাবার গ্রহণের পরিমাণ খুব কমে গেছে।
কিন্তু তাই বলে কাজের পরিমাণ তিনি একটুও কমাননি। কারণ লেখার কাজ ছাড়া তাঁর কাছে দিনযাপন অর্থহীন।
০২.
বেশ কয়েক বছর ধরে নিজেকে খুলে দিয়েছেন তিনি আমার জন্য। আমাকে তাঁর কাছে যাওয়ার অবাধ অনুমোদন দিয়েছেন। কিন্তু আমি এখন পর্যন্ত সেই সুযোগ নেওয়ার সাহস করে উঠতে পারিনি।
কীভাবে সাহস করি!
সেই আশির দশকের শুরুতে যাঁর নাটক ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’, আর পরে ‘নুরল দীনের সারাজীবন’ দেখে মনে হয়েছিল লেখক আমাদের এই সাধারণ গ্রহের মানুষ নন, সেই লেখক অনুমতি দিলেই কি তাঁর কাছে যাওয়ার সাহস অর্জন করা সম্ভব হয়? মন্ত্রের মতো উচ্চারণ করি যাঁর কবিতা ‘আসলে ভাষাই আপন করে আর সেই ভাষা করে পর’- সেই কবির খুব কাছাকাছি যাওয়া, নিজের নির্বোধিতা জেনেও কীভাবে সম্ভব? আশির দশকে দৈনিক সংবাদের সুবর্ণসময়ে ‘হৃৎকলমের টানে’ বছরের পর বছর মুগ্ধতা নিয়ে পাঠ করেছি। ‘কথা সামান্যই’ তো এখন প্রায় হ্যান্ডবুকের মতো সর্বক্ষণের সঙ্গী। গত বছরেও ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’ নাটক দেখে চোখে বাষ্প নিয়ে হল থেকে বেরিয়ে তাঁকে ফোন করতে গিয়েও করা হয়নি। মনে হচ্ছিল, ফোন করাটা খুব মোটাদাগের কাজ হবে, আমার আবেগটা বোঝানোর একমাত্র পথ হচ্ছে তাঁর পায়ে হাত দিয়ে সালাম করা। সেই ব্যক্তিত্ব যতই উদার অনুমতি দিয়ে রাখুন না কেন, আমি নিজে থেকে আমার প্রথম তারুণ্যে তৈরি করা গণ্ডি ভেঙে তাঁর খুব কাছে যেতে পারিনি। যখনই দেখা হয়েছে, তিনি আমাকে হাত ধরে কাছে টেনেছেন, চা খেতে যাওয়ার সময় ডেকে নিয়েছেন, মঞ্চের আনুষ্ঠানিকতার সময়টুকু বাদ দিয়ে বাকি ঘণ্টাগুলো বরাদ্দ দিয়েছেন আমাকে। তাঁর সাথে দেখা হয়েছে ঢাকায়, রাজশাহীতে, নাটোরে, পাবনায়। সব জায়গাতেই তিনি বুকের কাছে টেনে বসিয়েছেন, আর আমি একটু দূরত্ব রেখে বসে বুভুক্ষু ছাত্রের মতো তাঁর কথা ধর্মপুস্তক পাঠের মনোযোগ নিয়ে শুনেছি।
২০১২ সালে পাবনায় মঞ্চে বক্তৃতার সময় তিনি বলে ফেললেন- এই সময় বাংলাদেশে উপন্যাস নিয়ে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছে জাকির তালুকদার। আমি তখন নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। এত দিন যে সৈয়দ হক সম্পর্কে শুনে এসেছি, তিনি ভীষণ আত্মকেন্দ্রিক, দাম্ভিক, কখনো অন্যকে তিনি স্বীকৃতি দেন না! অথচ আজ এই হলভর্তি মানুষের সামনে এমন কথা তিনি উচ্চারণ করলেন! আর ওই দিনের পর থেকে তাঁর সাথে প্রত্যক্ষ সাক্ষাৎ আরো কমিয়ে দিয়েছিলাম।
আবার একটি কথা শুনলে অনেকে অবাক হবেন যে, সৈয়দ শামসুল হকের সাথে আমার যোগাযোগ কোনো সময়ই বিচ্ছিন্ন হয়নি। এখনো নয়। এখানে মাধ্যম হচ্ছেন আনোয়ারা সৈয়দ হক। আসলে আপা হচ্ছেন আমার ঢাকার অভিভাবক। এই দায়িত্ব তিনি নিয়ে নিয়েছেন নিজে নিজে। এত স্নেহ মানুষটার বুকে! আর তা বিলানোর জন্য এত তড়িঘড়ি! ঢাকায় যে কদিন থাকি, প্রায় প্রত্যেকদিনই তাঁর সাথে দেখা করতে হয়, তাঁর সাথে খেতে হয়, সব খবর জানাতে হয়, লেখার কথা বলতে হয়, কার কার সাথে কী কী কাজ করছি- তা জানাতে হয়। ঢাকার বাইরে থাকলে, প্রতিদিন না হলেও একদিন অন্তর অন্তর অবশ্যই ফোনে কথা হবে। তিনি লন্ডনে গেলেও ফোন করেন, চীনে গেলেও করেন। আমি নাটোরে থাকলেও ফোন করি, কানাডা গেলেও ফোন করি। আপার কাছ থেকেই হক ভাইয়ের সব কথা আমি শুনি। আমার সব খবরও হক ভাই জানতে পারেন আপার কাছ থেকেই।
০৩.
হক ভাই দিন-রাতের কোন সময়টি লেখালেখির জন্য বেছে নেন, জানতে চেয়েছিলাম একদিন। উত্তরে বলেছিলেন, প্রায় ৩০ বছর তিনি লিখেছেন বিকেল ৪টা থেকে ভোর ৪টা অব্দি। আর এখনো সকাল থেকেই লিখতে বসেন। যত রাতেই ঘুমাতে যান না কেন, ভোরে উঠে পড়েন বিছানা ছেড়ে। ধ্যান-শেভ-শাওয়ার-নাস্তা সেরে, বাইরে যাওয়ার মতো ফিটফাট কাপড় পরে লিখতে বসেন। যদি বাইরে যেতে না হয়, তাহলে এখনো সারা দিনই লেখেন; বা লেখালেখি-সংক্রান্ত কাজ নিয়ে থাকেন। যারা তাঁর প্রাপ্তি দেখে ঈর্ষা করেন, তাঁরা কি একই সঙ্গে সৈয়দ হকের প্রতিভা এবং পরিশ্রমের কথাটি কখনো ভাবেন?
যতবার তাঁর সঙ্গে মুখোমুখি সাক্ষাৎ হয়েছে, কখনোই ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় সময় নষ্ট করতে চাইনি আমি। জানতে চেয়েছি সাহিত্যের কথা। তাঁর লেখার গুপ্ত টেকনিকের কথা। সব শিল্পগুরুই নাকি তাঁর আস্তিনের গোপন ভাঁজে লুকিয়ে রাখেন থাঁর বিদ্যার ব্রহ্মাস্ত্রটি। শিষ্যের প্রতি পূর্ণ সন্তুষ্টির আগে কখনোই ফাঁস করেন না সেই ব্রহ্মাস্ত্রর চেহারা। কিন্তু হক ভাইকে দেখেছি সানন্দে বলে যাচ্ছেন নিজের বিভিন্ন রচনার টেকনিকের কথা। এত সহজে কেন তিনি দান করছেন সেই অমূল্য আবিষ্কার? উত্তরে বলেছিলেন- ৬০ বছর ধরে কষ্ট করে যা যা শিখতে পেরেছেন, সেগুলো সঙ্গে নিয়ে কবরে চলে যাওয়ার চাইতে আমাদের দিয়ে যেতেই তাঁর ভালো লাগবে।
তাঁর ‘রক্তগোলাপ’ গ্রন্থিত হয়েছে উপন্যাসসমগ্রের মধ্যে। আমি সেটাকে ছোটগল্প বলি। তিনি কিছুক্ষণ চিন্তা করে মেনে নিয়েছিলেন আমার মতটি। সেই ১৯৬২ সালে লেখা গল্পটি, যখন পৃথিবীর মানুষ জাদুবাস্তবতার নামও শোনেনি, সেই সময় তিনি কীভাবে লিখলেন এমন একটি গল্প? উত্তরে বলেছিলেন যে, মাটির ওপর দিয়ে চলতে চলতে প্লেন একসময় টেক-অফ করে যেভাবে, সেভাবেই তিনি চিন্তার টেক-অফ ঘটিয়েছিলেন ‘রক্তগোলাপ’ গল্পটিতে।
নাটক লিখতে চাই শুনে সঙ্গে সঙ্গে বলতে শুরু করেছেন নাট্যরচনার কলাকৌশলের কথা। শিল্প কীভাবে অবয়ব পাল্টায় সেখানে, গল্প বা উপন্যাসের নাট্যবিন্যাস কোন কোন পদ্ধতিতে করা যেতে পারে- সেসব বিদ্যা তিনি তাৎক্ষণিকভাবে গেঁথে দিয়েছেন আমার মস্তিষ্কে। এমন ব্যাগ্র-আন্তরিকতা তাঁর শিক্ষাদানের মধ্যে, যেন আমি একটা ভালো নাটক লিখতে পারলে তাঁর চেয়ে খুশি আর কেউ হবেন না। রবীন্দ্রনাথের সার্ধশত জন্মবৎসরে তিনি লিখেছিলেন ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’ নাটকটি। প্রক্রিয়া জানতে চাইলে মৃদু হেসে বলেছিলেন যে নাটকটি নির্মাণের জন্য প্রাথমিক উপাদান হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন দুই কপি ‘ছিন্ন পত্রাবলী’ আর একটি কাঁচি।
০৪.
সৈয়দ শামসুল হকের আওয়ামী লীগ প্রীতি প্রায় অন্ধ। এ নিয়ে অনেকেই তীর্যক মন্তব্য করেন। কেউ কেউ বিরূপ। আমি কোনোদিন তাঁর সাথে এ বিষয়ে কথা বলিনি। তবে জানতাম, যেসব কারণে মানুষ কোনো দলের অন্ধ সমর্থকে পরিণত হয়, সেগুলো তাঁর ক্ষেত্রে কখনোই প্রযোজ্য ছিল না, এখনো নেই। তিনি কোনোদিন সরকারি দলের কোনো ধরনের আনুকূল্য গ্রহণ করেননি। কোনোদিন প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হয়ে, কিংবা রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধি হয়ে বিদেশ যাননি। কারো জন্য চাকরি বা ঠিকেদারির সুপারিশ করেননি। টাকা-পয়সা তো দূরের কথা!
একবার শুধু জিগ্যেস করেছিলাম- আওয়ামী লীগের শীর্ষনেতৃত্ব কি সাহিত্যের গুরুত্ব বোঝে? সাহিত্যিকের সম্মান বোঝে?
সৈয়দ হক একটু হেসে বলেছিলেন- লেখক-কবিদের সত্যিকারের সম্মান দিয়েছে কেবল একটি রাজনৈতিক দল। সেটি হচ্ছে কমিউনিস্ট পার্টি। এখন অবশ্য তারাও দেয় না। হয়তো তারা দেওয়ার মতো সাংগঠনিক এবং মানসিক যোগ্যতা হারিয়েছে।
০৫.
এসব নিয়ে ভবিষ্যতে অনেক লেখা হবে। অনেকে লিখবেন।
আজ আমি শুধু চাই সেয়দ হকের সুস্থতা। আমি হাঁটু গেড়ে বসেছি চিকিৎসাবিজ্ঞানের সামনে, সময়ের অনিঃশেষ বিস্তারের সামনে, কোটি মানুষের শুভকামনার সামনে। তোমরা আশ্বাস দাও- আমাদের অভিভাবক ফিরে আসবেন!