ঢাকার কথা ৩৪
নতুনভাবে ঢাকায় নাগরিক যাত্রা
বারো ভুঁইয়াদের শেষ প্রতিরোধ ভেঙে যায় ১৬১০ খ্রিস্টাব্দে মুসা খানের পরাজয়ের মাধ্যমে। ১৫৩৮ সালে মোগল সম্রাট হুমায়ুন গৌড় দখলের মধ্য দিয়ে সমগ্র বাংলা মোগল শাসনের আওতায় নিয়ে আসার যে চেষ্টা শুরু করেছিলেন কিন্তু সম্রাট আকবরের জীবদ্দশায়ও তা সম্ভব করে তোলা যায়নি। পশ্চিম ও উত্তর বাংলার অনেকটা অংশ দখল করলেও বারো ভুঁইয়াদের দাপটে পূর্ববাংলা অর্থাৎ বাংলাদেশ দখল করা সম্ভব হয়নি। এভাবে আড়াইশ বছরের বেশি সময় ধরে টিকে থাকে বাংলার বিশেষ করে পূর্ববাংলার স্বাধীনতা। শেষ পর্যন্ত মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের সময় সুবাদার ইসলাম খানের হাতে বাংলা স্বাধীনতা হারায়।
পূর্ববাংলা দখলের আগে মোগল অধিকৃত বাংলার রাজধানী ছিল রাজমহল। রাজমহলের অবস্থান বর্তমান ভারতের ঝাড়খণ্ড রাজ্যে। ঢাকা দখলের পর ইসলাম খান চিশতি ঢাকায় সুবা বাংলার রাজধানী স্থাপন করেন। সম্রাটের নামে ঢাকার নামকরণ করা হয় জাহাঙ্গীরনগর। মোগল নথিতে এই নামকরণ থাকলেও ঢাকার মানুষ জাহাঙ্গীরনগর নামে অভ্যস্ত ছিল না। পরাধীনতার অস্বস্তিই এর কারণ। সাধারণ মানুষ ঢাকা নামটিই ব্যবহার করত। শুধু বাংলার মানুষ নয় এ সময় ঢাকা নামই ব্যবহৃত হতো ঢাকায় অবস্থানকারী ইউরোপীয় ব্যবসায়ীদের কাগজপত্রে। বিদেশি পর্যটকদের বিবরণীতেও ঢাকার বদলে জাহাঙ্গীরনগর নাম ব্যবহার করতে দেখা যায়নি।
ইসলাম খান ঢাকা দখলের পর বারো ভুঁইয়াদের শেষ নৌঘাঁটি নারায়ণগঞ্জে শীতলক্ষ্যা নদীতে আক্রমণ করেছিলেন। এই লক্ষ্যেই শক্তি সুসংহত করার জন্য তাঁকে রাজমহল থেকে ঢাকায় রাজধানী সরিয়ে আনতে হয়।
মোগল অধিকারের আগে ঢাকা শহরের পরিধি সূত্রাপুর থেকে আজকের বাবুবাজার পর্যন্ত সীমায়িত ছিল। যে যুগে বাবু বাজারের নাম ছিল পাকুড়তলী। ঢাকা বাংলা সুবার রাজধানী হওয়ার পর স্বাভাবিকভাবেই শহরের সীমানা বেড়ে যেতে থাকে। একটি রাজধানী শহরে ব্যবসা বাণিজ্য ও চাকরির সুযোগ বৃদ্ধি পায়। ফলে নানা অঞ্চল থেকে সম্প্রসারিত ঢাকায় অনেক মানুষ চলে আসতে থাকে। এভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকে ঢাকার জনসংখ্যা। প্রশাসনিক কাজে শহরের বিভিন্ন অংশে নানা দপ্তর খোলা হয়। কোথাও প্রতিষ্ঠিত হয় সেনানিবাস। বিভিন্ন ধরনের কর্মচারীর বসতি গড়ে ওঠে। নানা পেশাজীবীর অবস্থান লক্ষ করা যায়। এখনো টিকে থাকা স্থানের নামগুলো সে স্মৃতি বহন করছে।
বখশি বাজার বখশি উপাধিধারী উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের উপস্থিতির কথা মনে করিয়ে দেয়। মোগল সৈন্যবাহিনীর হাতির জন্য যে হাতিশালা ছিল তা পিলখানা নামেই বোঝা যায়। একইভাবে হাতি পরিচালনাকারী মাহুতদের বাসস্থানটি মাহুতটুলি নামে পরিচিত হয়। মোগলদের বাসস্থানের জন্যও যে নির্দিষ্ট এলাকা ছিল মোগলটুলি নাম তা মনে করিয়ে দেয়। এ সময়ে বাংলাদেশ সচিবালয়ের উত্তর পাশের রাস্তাটি তোপখানা রোড নামে পরিচিত। নামে বোঝা যায় মোগল ঢাকার এই শহরতলিতে অর্থাৎ মূল শহর থেকে একটু দূরবর্তী এলাকায় কামান এবং গোলাবারুদ রাখার ছাউনি তৈরি করা হয়েছিল।
মোগল ঢাকায় নানা ধরনের পেশাজীবীর অবস্থানের কথা এখনো টিকে থাকা স্থানের নাম থেকে অনুমান করা যায়। অবশ্য মোগলপূর্ব যুগ থেকেই ঢাকায় এসব পেশাজীবীর অবস্থান ছিল। প্রশাসনে নিযুক্ত হিন্দু কর্মকর্তারা সাধারণত কায়স্থ নামে পরিচিত ছিলেন। সাধারণ মানুষদের মুখে কায়স্থ উচ্চারিত হতো কায়েত বলে। এ কারণে কায়স্থদের বাসস্থান অঞ্চল কায়েতটুলি নামে পরিচিত হলো। একইভাবে প্রাচীনকালে তাঁতীদের অবস্থানের এবং তাঁতবোনা বা কাপড়ের ব্যবসা কেন্দ্রের নাম হয়ে গেল তাঁতীবাজার। একই ধারায় শাঁখারি বাজার, বানিয়ানগর ইত্যাদি নামকরণ হয়। এ থেকে বোঝা যায় প্রাচীন ঢাকার এ সকল পেশা মোগল যুগেও অব্যাহত ছিল এবং পেশাজীবীরা ঢাকায় অবস্থান করতেন।
১৫ শতকে প্রথম ঢাকায় প্রাদেশিক রাজধানী গড়ে ওঠার কথা আমরা শিলালিপির সাক্ষ্য থেকে জানতে পারি। তখন স্বাধীন সুলতানি বাংলার অন্যতম ইকলিম বা প্রদেশ মুবারকাবাদের রাজধানী ছিল ঢাকা। স্বাধীনতা হারানোর পর দ্বিতীয়বারের মতো ঢাকা প্রায় ৪০০ বছর আগে আবার দিল্লি নিয়ন্ত্রিত বাংলা সুবার রাজধানী হয়। তবে মানতেই হবে ঢাকা শহরের জমে ওঠার পথ প্রদর্শন ঢাকা জয় করা ইসলাম খান চিশতির হাত ধরেই শুরু হয়েছিল। ভৌগোলিক বিবেচনাতেই তিনি ঢাকাকে রাজধানী করার স্থান হিসেবে চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন। এর তিনটি প্রধান কারণ ছিল। এক. শীতলক্ষ্যা নদীতে বারো ভুঁইয়াদের নৌবহরে আঘাত করার জন্য মোগল ঘাঁটি স্থাপনে ঢাকা ছিল উপযুক্ত স্থান, দুই. ঢাকা শহরের নাগরিক ঐতিহ্য এবং তিন. সে সময় বাংলা সুবার অনেকটা কেন্দ্রে ছিল ঢাকা শহরের অবস্থান। ঢাকায় ইসলাম খান দখলদার শক্তি হিসেবে এলেও অল্পদিনের মধ্যে তিনি ঢাকাবাসীর শ্রদ্ধা অর্জন করতে পেরেছিলেন। এর অবশ্য বিশেষ কারণ ছিল। তিনি ছিলেন ফতেহপুর সিক্রির বিখ্যাত সুফি সম্রাট আকবরের পীর সেলিম চিশতির ভাস্তে। এ কারণে সাধারণ মানুষ তাঁকেও সুফি মনে করতেন। ইসলাম খান চিশতি ১৬১৩ সালে ঢাকার কাছে ভাওয়ালে মৃত্যুবরণ করেন। প্রথমে তাঁকে হাইকোর্টের অভ্যন্তরে যেখানে এখন একটি মাজার রয়েছে এই জায়গাটিতে সমাধিস্থ করা হয়। সাধারণ মানুষের বিশ্বাস ছিল যে পরকালে ইসলাম খান চিশতি বেহেস্তে যাবেন। তাই ঢাকাবাসী এই কবরটি দেখিয়ে বলতেন চিশতি বেহিস্তির মাজার। মৃত্যু সংবাদ জানার পর সম্রাট জাহাঙ্গীর আদেশ দেন ইসলাম খানের শবাধার তুলে আনতে। শেষ পর্যন্ত ইসলাম খানকে ফহেপুর সিক্রিতে সেলিম চিশতির সমাধির পাশে কবর দেওয়া হয়।