প্রিয় মানিক, শ্রদ্ধেয় সত্যজিৎ
দ্য বাইসাইকেল থিফ দেখে বিশেষভাবে মুগ্ধ হন এবং বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস ‘পথের পাঁচালী’ অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মাণ করার সিদ্ধান্ত নেন। ১১৫ মিনিটের সাদাকালো এই চলচ্চিত্র প্রচণ্ড গর্জনে সম্মান অর্জন করতে সক্ষম হয়। ‘পথের পাঁচালী’র দুর্গা প্রতিবেশীর গলার অলংকার না বলে নিয়ে এসেছিল। দুর্গার মৃত্যুর পর একটি দৃশ্যে অপু তার বোনের কলঙ্ক চিরতরে পানিতে ছুড়ে ফেলে। এই অসাধারণ একটি মাত্র দৃশ্য যে কত কিছু বুঝিয়ে দিতে পারবে একজন দর্শককে, এমন দৃশ্য তৈরি করতে শুধু সত্যজিৎ পারেন।
কাছের মানুষের কাছে সত্যজিতের ডাকনাম ছিল ‘মানিক’। কাছের মানুষরা আগেই বুঝতে পেরে গিয়েছিল, তিনি মহামূল্যবান মানিক হয়েই থাকবেন বাংলায়। মানিক, কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ ও শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে ধীরে ধীরে বাংলার প্রত্যেক মানুষের হৃদয়ের মানিক হওয়ার পথে পা বাড়ান।
বাংলা সাহিত্যে ‘ননসেন্স রাইমের’ প্রবর্তক ছিলেন সত্যজিৎ রায়ের বাবা সুকুমার রায়। সুকুমার ছিলেন একাধারে ছড়াকার, শিশুসাহিত্যিক, রম্যরচনাকার ও নাট্যকার। ১৯২৩ সালে সত্যজিতের বাবা সুকুমার রায় মৃত্যুবরণ করেন। তখন সত্যজিতের বয়স মাত্র তিন বছর। তাঁদের প্রিন্টিংয়ের ব্যবসা হাতছাড়া হয়ে যায় এবং সত্যজিৎ ও তাঁর মাকে নিজস্ব বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হয়। তাঁরা সত্যজিতের মামাবাড়িতে বাস করতে চলে যান। বাবার মৃত্যু মানেই যেকোনো সন্তানের জন্য কঠিন এক সময়।
তিনি সাধারণ কাজ করে অসাধারণ ভাবনা করতেন। চলচ্চিত্র নিয়ে স্বপ্ন দেখতেন। এর মাঝেই ১৯৪৯ সালে সত্যজিৎ তাঁর বহুদিনের বান্ধবী বিজয়া দাসকে বিয়ে করেন। একসময় কিন্তু তাঁর স্ত্রী ও ছেলে দুজনেই তাঁর কাজের সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন। বেশির ভাগ চিত্রনাট্য বিজয়াই প্রথমে পড়তেন।
সত্যজিতের অসাধারণত্ব লিখে প্রকাশ করা কঠিন। কিন্তু এই দৃশ্য যদি সত্যজিৎ বাবু ধারণ করেন, মনে হবে অমায়িক কিছুর দিকে তাকিয়ে আছি। হয়তো গাছের ডালে মলিন একটি ঘুড্ডি ঝুলে থাকার দৃশ্য তিনি এমনভাবে ধারণ করবেন, দর্শক ওই ঘুড্ডির দিকে তাকিয়ে চিন্তা করবে মহাজাগতিক কোনো গল্প।
রবীন্দ্রনাথের পর বাংলার সাংস্কৃতিক জগতের কেউই বিশ্বের দরবারে এতটা সম্মান পাননি, যতটা পেয়েছেন সত্যজিৎ রায়। তাঁর ছবিগুলো আপাতদৃষ্টিতে সরল, কিন্তু এই সরলতার গভীরে লুকিয়ে আছে জটিলতা। তাঁর চলচ্চিত্রের বর্ণনাভঙ্গি ও চরিত্রায়ণ নিখুঁত বলে অনেকবার প্রশংসিত হয়েছে। এক বছরে এক ছবি, এই ছিল তাঁর রহস্য। ডকুমেন্টারি ফিল্ম, শর্ট ফিল্ম, ফিচার ফিল্মসহ তিনি পরিচালনা করেছেন মোট ৩৭টি ছবি। গম্ভীর বিষয়বস্তু নিয়ে ছবি পরিচালনা করতে করতেই হুট করে তিনি সৃষ্টি করলেন ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’। ছোটদের জন্য নির্মিত হলেও ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ সব বয়সের দর্শকেরই উপভোগ্য। ছেলে সন্দীপ রায়ের অনুরোধে তিনি এই ছবি নির্মাণ করেন। ১৩২ মিনিটের এই চলচিত্রের সমতুল্য শিশুতোষ ছবি নির্মাণ প্রায় অসম্ভব হয়ে গেছে পরবর্তী পরিচালকদের জন্য।
সত্যজিতের চলচ্চিত্র কৌশল পরবর্তী সময়ে অপর্ণা সেন, ঋতুপর্ণ ঘোষ, গৌতম ঘোষ এবং বাংলাদেশের তারেক মাসুদকে অনুপ্রাণিত করেছে। জাপানি চলচ্চিত্রকার আকিরা কুরোসাওয়ার বলেছিলেন, ‘এই পৃথিবীতে বাস করে সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্র না দেখা চন্দ্র-সূর্য না দেখার মতোই অদ্ভুত ঘটনা।’
‘আগন্তুক’ ১৯৯১ সালে মুক্তি পায়। এটি সত্যজিতের শেষ চলচ্চিত্র। এর পর সত্যজিতের শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটে। ভর্তি হন কলকাতার বেলভিউ নার্সিং হোমে। সেখানেই অস্কার কমিটির দুজন সদস্য এসে উনার হাতে পুরস্কার তুলে দেন। ১৯৯২ সালের ২৩ এপ্রিল সত্যজিৎ মৃত্যুবরণ করেন। তিনি বিভিন্ন প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে বাংলা চলচ্চিত্রের সাধনা করেছেন। ‘পরিচালক’ সত্যজিৎ রায়কে নিয়ে লিখলে মহাকাব্য হয়ে যেতে পারে। এমনই বৈচিত্র্যময় তাঁর কর্মকাব্য।
সত্যজিতের সাহিত্যও কিন্তু শক্তিশালী। লেখাগুলো ছিল প্রধানত কিশোর রচনা। বাংলা সাহিত্যের সেরা গোয়েন্দা চরিত্র ‘ফেলুদা’ সত্যজিতের এক আশ্চর্য সৃষ্টি। তিনি নিজেই ১১২ মিনিটের ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ নির্মাণ করেন। সত্যজিতের অধিকাংশ রচনাই ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছে এবং বর্তমানে তাঁর বইগুলোর দ্বিতীয় প্রজন্মের পাঠকসমাজ গড়ে উঠেছে।