গপ্পো-তক্ক-যুক্তি
ডেরেক ম্যালকম-সত্যজিৎ রায়ের আলাপ
ডেরেক ম্যালকমের পুরো নাম ডেরেক এলিস্টন মাইকেল ম্যালকম। তিনি একজন বিখ্যাত ব্রিটিশ চলচ্চিত্র সমালোচক এবং ইতিহাসবিদ। ১৯৮৪ সালে লন্ডন চলচ্চিত্র উৎসবে সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে সিনেমা নিয়ে লম্বা আলাপ হয় তাঁর, দর্শকদের উপস্থিতিতেই। সত্যজিৎ রায়ের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে এই সাক্ষাৎকারের অনুবাদটি প্রকাশ করা হচ্ছে।
ডেরেক ম্যালকম : সত্যজিৎ আমি শুনতে পেলাম যে, আপনার নতুন ছবিটি অর্থাৎ ‘ঘরে বাইরে’ নির্মাণে কিছুটা বিলম্ব হচ্ছে, কারণটা কি?
সত্যজিৎ রায় : আর বলবেন না, সব প্রকল্প বাস্তবায়নের মূলে একটিই সমস্যা মুদ্রা সংকট । জানেন তো মুদ্রার জোগান ছাড়া ছবি বানানো মোটেও সহজ নয়। বিবিধ কারণে আমার প্রযোজকের তহবিল সংকট ঘটায় কাজটা থেমে আছে। আদতে এটা কোনো সমস্যা নয়, কেন না আমি শুধুমাত্র একজন প্রযোজকনির্ভর নই। মুদ্রা কেউ না কেউ তো জোগান দেবেই, আর এতে আমার খুব একটা ক্ষতি হয়নি বরং লাভই হয়েছে। এখন আমরা চিত্রনাট্যে যে মৌসুমের উল্লেখ ছিল সেই শীতকালে কাজটা শুরু করব, যদিও সব পরিকল্পনা অনুযায়ী চললে শুটিং শুরু হতো এপ্রিলে। আর এ ছবিটাও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপন্যাস অবলম্বনে।
ম্যালকম : বাংলা চলচ্চিত্রের প্রেক্ষাপটে ‘ঘরে বাইরে’ একটি বিশাল খরচসাপেক্ষ কাজ। ধরে নিচ্ছি, এটি বিগ বাজেট ছবি হচ্ছে?
রায় : হ্যাঁ, তা-তো বটেই। হয়তো এখানে এটি ‘শতরঞ্জ কি খিলাড়ি’র মতো ব্যয়বহল হবে না। “ঘরে বাইরে” ঐতিহাসিক ছবি; ছবিতে অখণ্ডিত বাংলার একটি যুগসন্ধিক্ষণ মুহূর্তের প্রেক্ষিতে এবং ক্ষমতাবান ও নিম্নবর্গীয়দের বাসনার টানাপড়েনের একটা রূপ আখ্যায়িত হয়েছে। স্বভাবতই বিশাল সেট, কস্টিউম ইত্যাদি বাবদ আমাদের একটি বড় অঙ্কের ব্যয় হবে।
ম্যালকম : তুমি এই ছবিটা তিন বছর আগে করতে চেয়েছিলে, তাই না?
রায় : প্রকৃত প্রস্তাবে, এটি আমার প্রথম প্রজেক্ট ছিল। পথের পাঁচালী’র আগে ‘১৯৪৯-৫০’ সনেই আমি “ঘরে বাইরে” বানাবার, পরিকল্পনা করেছিলাম। আমার চিত্রনাট্য তৈরি করাছিল। প্রযোজকও হাজির ছিলেন। আনুষঙ্গিক চুক্তিও হয়েছিল। তারপর প্রযোজক কিছু আব্দার করে বসলেন যে, তাদের দাবিমতো আমার করা চিত্রনাট্যের কিছু পরিবর্তন-পরিমার্জনা করতে হবে। আমি বেঁকে বসলাম। ফলত প্রকল্পটি বাতিল হয়ে গেল। এতে আসলে আমার ভালোই হয়েছিল। ওই স্ক্রিপ্টটা খুবই আনাড়ি ছিল। একদম হলিউডি সব ট্রিটমেন্টে ভরপুর!
ম্যালকম : নতুন ছবি শুরুর পূর্বে কোন বিষয়গুলি তুমি মাথায় রাখো?
রায় : প্রথম, অবশ্যই একটি গল্প খুঁজে পেতে হবে যার সাথে নির্মাতার সংলগ্নতা ঘটার সুযোগ থাকবে। কাহিনীর প্রতি আকর্ষণ বোধ না করলে আমার পক্ষে ছবি বানানো অসম্ভব। আর ছবির কাহিনী এমন হতে হবে যেন সেটি ধীরে ধীরে নির্মাতার অবচেতনকে গ্রাস করে এবং গল্পটির সাথে একাত্ম হয়ে যায়। এবং সে একাত্মতার মূহুর্ত থেকেই সে ছবিটি বানাবার জন্য হন্যে হয়ে উঠবেÑ ছবির গল্প বা প্লট এমন হওয়া উচিত।
গল্প নির্বাচনের পরবর্তী ধাপ হলো চিত্রনাট্য রচনা। যদি গল্পটি হয় ‘ঘরে-বাইরে’র মত চিত্রনাট্য লেখাটা তবে সবসময় অনেক দূরূহ হয়না। তবে মৌলিক চিত্রনাট্য রচনার সময় কিছু কিছু বিষয় হাজির হয় যেগুলো পরিচালক পছন্দ করেন আবার কিছু উপস্থিত হয় যা তিনি পছন্দ করেন না। পরিচালককে সৎসিদ্ধান্ত নিতে হবে কোন বিষয়টি সে রাখবে আর কোনটি বর্জন করবে। এই পর্যায়ে কিছু সময় নিতে হবে। আমার কথা বললে বলতে হয়, আমি প্রায় সবসময়ই আমার রেগুলার ইউনিটের সাথে কাজ করি। যেমন, আমি সুব্রত মিত্রের সাথে কাজ করেছি, উনি অপু ট্রিলজিসহ দশ-বারোটি ছবির ডি.ও.পি. ছিলেন। তারপর সৌমেন্দু রায়কে দায়িত্বে দেওয়া হয় এবং আমি ওর সাথে এখন পর্যন্ত কাজ করছি। শুরু থেকেই দুলাল দত্ত আমার সম্পাদক হিসেবে কাজ করছেন এবং শিল্প নির্দেশক বংশী চন্দ্রগুপ্ত গত পনর বছর আমার সাথে কাজ করার পর বলিউডে চলে যায়; ‘শতরঞ্জ কা খিলাড়ি’র সময় তিনি আবার প্রত্যাবর্তন করেন।
আর নিউইয়র্কে তার আচানক দেহত্যাগ ঘটলে তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন সহকারী শিল্প নির্দেশক অশোক বোস ১৯৭০ সালে। তবে আমার সহকারীর তালিকা দীর্ঘ এবং এটা সবসময়ই পরিবর্তিত হয়েছে। কেননা, তুমি তো জানো সহকারীদের মধ্যে সবসময়ই পরিচালনা বা ছবি বানানোর খায়েশ থাকে। তো তারা যখন এসে বলে “আমার চলে যেতে হচ্ছে ,কারণ,আমি একটা ছবি বানাবার সুযোগ পেয়েছি ” তখন আমার আর কিই বা বলার থাকে। আমি শুধু বলি “যাও হে ,ভালো একটা ছবি বানাও গিয়ে”। এদের মধ কেউ কেউ ইন্ডাস্ট্রিতে টিকে গেছে আবার কেউ কেউ হয়তো দু-একটি ছবি করে ধরা খেয়ে আমার কাছে ফেরত এসেছে। এমনতর ঘটার কারণ হলো “এক ফিল্ম থেকে অন্য ফিল্ম বানাবার প্রক্রিয়া পদ্ধতিতে রদবদল ঘঠে যায়” । ‘সদগতি’ ছবিটির কথাই ধরা যাক। আমি শুটিং করেছি টানা দশদিন মাত্র, একই লোকেশনে প্রতিদিন এমন একদল পারফর্মারদের সাথে যারা কাজটি করেছে খুবই সঙ্গতিপূর্ণভাবে এবং নিজেদের চরিত্রের মধ্যে ডুবে গিয়ে। আর ছবি তোলার পর সম্পাদনা এবং সংগীত সংযোজনের কাজটা শেষ করতে আমার সময় লেগেছে মাত্র দুইমাস। কিন্তু সদ্গতি যদি টেলিচিত্র না হয়ে পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র হতো তাহলে আমার শুটিংয়ে লেগে যেত কমপক্ষে ৪০-৬০ দিন। আরো বেশি হতে পারে এইটা কম-বেশি নির্ভর করে ছবির জটিলতার উপর। আর জানোতো, আমি প্রত্যেকদিন শুট করি না। আমি একটি সিন শেষ করি, পরদিন সেটা এডিট করি তারপর পরবর্তী সিন করি, এডিট করি। শুট-এডিট এইভাবে এগোলে কাজটা অনেক সহজ হয়ে যায়। এইটাই আমার কাজ করার পদ্ধতি, প্রথম থেকেই আমি এভাবেই কাজ করেছি।
ম্যালকম : তো তুমি তাহলে একনাগাড় অনেক দৃশ্য শুট্ করো না?
রায় : না, কখনোই না। যদি কোন নির্বোধ অভিনেতার সাথে কাজ করতে হয় তাহলে অবশ্য পদ্ধতি পরিবর্তনের প্রয়োজন হতে পারে। তবে, আমার ক্ষেত্রে সচারাচর এমন ব্যতয় ঘটে না। যদিওবা ঘটে তবে আমি হাফডজনের বেশি টেক নিই না। আমি সাধারণতঃ এক টেক-এ কাজ করি। ‘শতরঞ্জ কি খিলাড়ি’র সময় রিচার্ড এটেনবোরো ভয়ানকভাবে মুষড়ে পড়েন আমার একটেক-এ ওকে করা দেখে। তিনি তো বলেই বস্লেন ‘‘আপনি কি সতর্কতার খাতিরেও আরেকটা শট নেবেন না…যদি কোন অঘটনের জন্য আরেকটা টেকের প্রয়োজন পড়ে…” তখন আমি বললাম ‘‘আমাদের আরেকটা টেক নিবার মত অর্থানুকুল্য নেই; সৌভাগ্যবশতঃ কোন অঘটন ঘটেনি ওইবেলা ।
ম্যালকম : আমি জানি তোমার প্রায়ই লগ্নীকারক খুঁজতে বেগ পেতে হয়। এতদিন ছবি করার পর তো মনে হয় সে সমস্যার মাত্রা কিছুটা কমেছে ?
রায় : হ্যাঁ, কিন্তু গত ছয় সাত বছরে আবার ছবি করার খরচ বেড়েছে বহুগুন। এবং দিনকে দিন (যে কোন ধরনের) বাংলা ছবি করা ডিফিকাল্ট হয়ে উঠছে। তুমি কখনোই বাংলা ছবিতে বড় আয়োজন কল্পনা করতে পারবেনা। যেহেতু পূর্বে আমার দুটি রবীন্দ্র রচনার এড্যাপ্টেশন ব্যবসায়িকভাবে সফল হয়েছিল তাই ‘ঘরে-বাইরে’র মত ব্যয়বহুল ছবিতে প্রযোজক টাকা ঢালতে রাজী হয়েছিলেন। আমার মনে হয়, আমরা যদি ক্রমশ মডেস্ট বাংলা ফিল্ম বানানোতে সিদ্ধ হতে না পারি তবে হিন্দী ছবি বানানো ছাড়া গত্যান্তর থাকবে না। আর এটি ঘটতেই পারে কেন না, ছবির খরচ যেভাবে বাড়ছে, সেখানে মান যদি হয় নিম্নগামী তাহলে প্রযোজক আর কেন আকৃষ্ট হবে।
ম্যালকম : কিন্তু, তুমি তো পুরো ভারতের অভিনেতা অভিনেত্রীদের তোমার যেকোন প্রকল্পে আকৃষ্ট করতে সক্ষম, নয় কি? আমি বোম্বের এরকম অনেক অভিনেতা-অভিনেত্রীদের জানি যারা সবসময় এধরনের আর্টফিল্মকে অ্যাডমায়ার করতো তবে অংশগ্রহণের কোন সুযোগ ছিল না। কিন্তু, তোমার একটি ফোওনকলই তাদের যথেষ্ট আগ্রহের কারণ ঘটাবে। ইনফ্যাক্ট, ‘শতরঞ্জ কি খিলড়ি’তে এই ঘটনা ঘটেছে। এই ব্যাপারটাতে তো তোমার কিছুটা উপকার হয়, তাই না?
রায় : হ্যাঁ, তা বলতে পারো; কেন না আমি সেই রকম একটা জায়গায়ই অধিকার করে আছি। অবশ্যই আমরাও অনেক লাকি এরকম একগুচ্ছ নতুন পারফর্মারদের পেয়ে। এদের মধ্যে কিছু এসেছে পুনে ফিল্ম ইনস্টিটিউট থেকে, কিছু এসেছে দিল্লী অ্যাক্টিং স্কুল থেকে এবং তারা সকলেই সপ্রতিভ, কো-অপারেটিভ এবং কাজের প্রতি খুবই আন্তরিক। তাই ওদের সাথে কাজ করে খুব আরাম ।
ম্যালকম : এরা তো কমার্শিয়াল ফিল্ম করে?
রায় : অর্থের প্রয়োজনে করে। সিরিয়াস ফিল্ম করার প্রশ্নে ওদের আগ্রহ প্রবল।
ম্যালকম : সাম্প্রতিক সময়ে যেসব নতুন পরিচালকের উত্থান ঘটেছে তার পেছনে প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে এসব লিডিং অভিনেতা-অভিনেত্রী এবং সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা। এদের দিকে তাকিয়ে বলা যায়, গতানুগতিক বাণিজ্যিক ছবির বাইরে ডিসেন্ট ভারতীয় ছবির একটি সম্ভাবনা উঁকি দিচ্ছেÑ তোমার কি মনে হয়?
রায় : হুম, অবশ্যই। প্রশ্নাতীত ভাবে বলা যায় এই সম্ভাবনা বাস্তবে পরিণত হবে, তবে সহসাই নয়। কারণ, এই ছবিগুলি কম বাজেটে নির্মিত পরিশীলিত, পরিচ্ছন্ন ছবি হওয়া সত্ত্বেও এগুলো কোথাও দেখানো হয় না যদিও এগুলো বিভিন্ন উৎসবে পুরস্কার পাচ্ছে। আর ছবির সাধারনের সামনে উম্মোচন না হওয়াটা পরিচালকের জন্য বিশাল সংকটের ব্যাপার।
ম্যালকম : ‘শতরঞ্জ কি খিলাড়ি’র পরিবেশন নিয়ে তোমাকেও তো বেশ দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে?
রায় : হ্যাঁ। কিন্তু, এ ব্যাপারে আমার কিছু করার ছিল না। এই ছবিটিতে অংশগ্রহণ করার জন্য বোম্বাইয়ের প্রথম সারির ব্যস্ত অভিনেতা, কলা-কুশলীগণ কলকাতায় এসে হাজির হয়েছিলো। আর এই ছবিটা যদি দর্শকের হৃদয়ে আঁচড় কাটে মানে ভাল ব্যবসা করে তবে ইন্ডাস্ট্রির এতদিনে গড়ে উঠা বাজারী ছবির ভরকেন্দ্র টলে যাবার সমূহ সম্ভাবনা, এই আশংকা থেকে বোম্বাইয়ের ডিস্ট্রিবিউটররা প্রথম থেকেই বাগড়া দিচ্ছিল।
ম্যালকম : অর্থাৎ, পরিবেশকরা এই ছবিটি চালানোর ব্যাপারে আন্তরিক ছিল না।
রায় : না। ছবিটির প্রতিটি শো হাউ্সফুল হওয়ার পরও তিন সপ্তাহের মাথায় তারা কোন কারণ ছাড়াই একরকম জোর করেই নামিয়ে দেয়। কিন্তু আমি জানি কারণটা কি। তারা এধরনের ছবি ক্ষেত্রে ধরেই নেয় যে এসব কোন ভাবেই লাভের মুখ দেখতে পারে না। কিন্তু, তাদের সকল জল্পনা কল্পনা মিথ্যে প্রমাণ করে ছবিটি যখন নিয়মিত রিটার্ন আনতে শুরু করলো তখন তারা জেদ করেই ছবিটি নামিয়ে দিলো।
ম্যালকম : ভারতীয় বাণিজ্যিক ছবিগুলোর কোন উন্নতি হচ্ছে , নাকি অধঃগতিই এর নিয়তি?
রায় : তুমি কি বাণিজ্যিক হিন্দী ছবির কথা বলছো ?
ম্যালকম : হ্যাঁ।
রায় : …কারণ বাণিজ্যিক বাংলা ছবি বলে কোন কিছুর অস্তিত্ত্ব নেই । বোম্বাইয়ের বাণিজ্যিক ছবি গুলি খুবই কুশলীভাবে নির্মিত,তাদের ক্র্যাফটসম্যানসশীপ চোখে পড়ার মতো, এমনকি সমীহ করার মত এই মূহুর্তে। আমি ‘শোলে’ (১৯৭৫)-র কথা বলতে পারি যেখানে পরতে পরতে কারিগরী কুশলতার ছোঁয়া চোখে পড়ে। একজন ফিল্মমেকার হিসেবে ছবিটি আমি পছন্দ ও শ্রদ্ধা করি। তাছাড়া, যেমনটি আমি বললাম প্রায় সব বোম্বাই ফিল্মে শোলের মতে অভিনয়, পেশাদারীত্ব, স্টাইলিস ব্যাপারটা থাকলেও পুরো ছবিতে এসবের কোন সারবস্তু থাকে না, সেখানে কোন বিশ্বাসযোগ্য চরিত্র নেই এবং পুরো পরিশরটা অবাস্তব। হিন্দী ছবির জগৎটা একটা অবাস্তব রূপকথার জগৎ।
ম্যালকম : সম্প্রতি তুমি টি.ভির জন্য পিকু ও সদগতি নামে দুটো ছবি করেছ, তাই না? ফরাসী টিভির জন্য পিকু এবং দূরদর্শনের জন্য সদ্গতি নামের হিন্দী ছবি।
রায় : হ্যাঁ। পিকুর ডায়েরী পনের বছর আগে আমার লেখা একটি গল্প অবলম্বনে নির্মিত। গল্পটা লিখেছিলাম একটি ছোট ছেলের ডায়েরী লেখার ভঙ্গীতে। ছবিতে সেভাবে দেখানো না হলেও,ওই গল্পটির মূল প্লটকে অনুসরণ করা হয়েছে। এটি একটি বালকের জীবনের একদিনের গল্প ।
ম্যালকম : টেলিভিশনের জন্য কাজ করতে গিয়ে তুমি কি তোমার টেকনিকে কোন পরিবর্তন এনেছো?
রায় : না, আমি মনে করি এই ছবিগুলি রেগুলার ফরম্যাটের ছবির হলে অনায়াসে চালানো যাবে। টিভিতে কাজ করতে হলে তোমাকে যেটা করতে হবে, তা হলো কম্পোজিশনের ব্যাপারে অবশ্যই সজাগ থাকতে হবে। টেলিভিশনের পর্দার আকারের কারণে ফ্রেমের অনেক অংশ কাটা পড়ে যায় এবং হয়তো বা, কোনো কোনো ক্ষেত্রে তোমাকে লং শটই নেয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। ছোট পর্দায় দূরের বিষয়কে স্পষ্ট দেখা যায় না। কিন্তু, কাজ করার সময় আমার চিন্তায় এগুলো বাদ দেয়ার ব্যাপারটি আসেনি, আমি আমার মত কাজ করেছি। তারপর, কলকাতায় বসে যখন টিভিতে দেখলাম তখন কিছু শট মার খেয়ে গেছে দেখে রীতিমত উদ্বিগ্ন হলাম। তবে পর্দা যদি বড় হতো এবং তাতে যদি রঙ থাকত তাহলে নিঃসন্দেহে এটি দেখতে আরো সুষমামন্ডিত হতো। আমি এদেশে আসার পর টিভি দেখছিলাম এবং এখানকার টি.ভি.তে আমার টেলিচিত্রগুলোর প্রায় কিছুই মার খাবে না।
ম্যালকম : তোমাকে যদি প্রস্তাব দেওয়া হয় অন্যান্য দেশের টিভির জন্য ছবি করতে তুমি রাজী হবে?
রায় : তারা যদি আমাকে বাংলা গল্প নিয়ে করতে দেয় তবেই রাজী হব। যেমন পিকু একটি বাংলা সংলাপ সমন্বিত বাংলা ছবি এবং ফরাসী টেলিভিশনে সেটি সাবটাইটেল সহ দেখানো হচ্ছে। আমার মনে হয়না অন্য অনেক দেশ এই শর্তে রাজী হবে। যদি রাজী থাকে তবে আমিও তাদের জন্য হাজির থাকব।
ম্যালকম : কিন্তু, তুমি কি তোমার ছবি প্যারা ডাবিং করবে?
রায় : না, আমি ডাবিং বিষয়টা পছন্দ করি না।
ম্যালকম : আমরা এবার একটু পেছন ফিরে তাকাই। তোমার শুরুও দিককার কাজে প্রায়ই দেখা যেত অনেক অপূর্ব আউটডোর দৃশ্য যা প্রকৃত প্রস্তাবে তোলা হয়েছে সেটে। এটি আমাকে ভীষণভাবে মুগ্ধ করে।
রায় : আমরা এই ব্যাপারটা নিয়ে খুব গর্বিত এবং এর পুরো কৃতিত্বের দাবীদার আমাদের বংশী চন্দ্রগুপ্ত (শিল্প নির্দেশক) এবং সুব্রত মিত্র (চিত্রগ্রাহক)। সুব্রত মিত্র সেটে দিনের দৃশ্য তোলার জন্য খুবই অসাধারণ একধরনের লাইট ডিজাইন উদ্ভাবন করেন যা দৃশ্যকে আরো মাধুর্য দান করে। পথের পাঁচালীর প্রায় ৮০ ভাগ কাজ হয়েছে লোকেশনে শুধু রাতের সিকোয়েন্সগুলি সেটে করা হয়েছে। কিন্তু, অপরাজিত (অপু ট্রিলজির ২য় পর্ব) এর ক্ষেত্রে ঠিক উল্টোটা ঘটেছে। বেনারসে যে বাড়িটা দেখানো হয়েছে সেটা আসলে সেটের মধ্যে বানানো। আমাদের করা লাইটের সাথে লোকশনের লাইট চমৎকার ভাবে ম্যাচ করে যায় ফলে সেটে যেসব দৃশ্য করা হয়েছে, যেমন: অনেক লোক রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে, ঘরে ঢুকছে-বেরোচ্ছে বাড়ির উঠোনের দৃশ্য, এসব চোখে একটুও খচখচ করেনি। কাজটি শুরুর আগে আমার ক্যামেরাম্যান, আর্ট ডিরেক্টর এবং আমি, আমরা মিলে বিশেষ ধরনের আলো ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিই। আর এই লাইটের ধারণা আমাদের মাথায় আসে আঁরি কার্র্টিয়ে ব্রেসোর ছবি দেখে আমরা সবাই তখন তাঁর চরম ভক্ত ছিলাম। তাঁর কাছে আমরা এভেইলেবল লাইট ব্যবহারের শিক্ষাটা নেই এবং সফলভাবে প্রয়োগ করতে সক্ষম হই।
ম্যালকম : অভিনেতা-অভিনেত্রীদের কিভাবে সামলাও? তুমি কি তাদের স্পষ্ট করে বলে দাও তোমার চাহিদার কথা নাকি তারা তাদের মত করে গল্পটি আত্মস্থ করে এবং তুমি তখন তোমার সাজেশন দাও?
রায় : ওয়েল, চিত্রনাট্য লেখা ও কাস্টিং সম্পূর্ণ হলে, প্রধান চরিত্রগুলোকে একে একে আমি ডাকি ও তাদের সাথে পুরো স্ক্রিপ্টটা পড়ি এবং মনোযোগ দিয়ে এই পঠনে অংশগ্রহণের ফলে তারা তখনই জেনে যায় তাদের কি ধরনের পারফরম্যান্স করতে হবে। যখন পড়ি তখন আমি প্রচুর আ্যক্ট করে দেখাই। এটি একটি পর্ব। তারপর কিছু অভিনেতা আছেন যাদের গাইড করতে হয়। দুই একজন কখনো কখনো এসে চরিত্র সম্পর্কে এটা ওটা জিজ্ঞেস করে, ব্যাকগ্রাউন্ড জানতে চায় ,আমি তাদের সব প্রশ্নের উত্তর দেই। কিন্তু অধিকাংশ সময় স্ক্রিপ্ট পড়ার পর অভিনেতা অভিনেত্রীদের প্রথম প্রশ্ন হয়, শুটিং শুরু কবে থেকে?
ম্যালকম : ছবির মিউজিকও তো তুমি নিজেই করো। এটা কি তোমার জন্য সহজাত ও সহজ একটা ব্যাপার?
রায় : শুরুর দিকে সঙ্গীত রচনা মোটেও সহজ ছিল না।
ম্যালকম : তুমি মিউজিক ব্যবহারের ক্ষেত্রে বেশ মিতব্যয়ীও বটে।
রায় : অন্য যেকোন সময়ের থেকে এখন বোধহয় একটু বেশিই পরিমিতভাবে সঙ্গীত ব্যবহার করছি।
ম্যালকম : এই সময়ে হলিউডে বা বলিউডের সঙ্গীতের ব্যবহার থেকে তোমার মিউজিক একদম আলাদা ।
রায় : আমার ধারণা ছবির সঙ্গে সঙ্গে তাদের ছবির মিউজিকের খচ বিক্রির ব্যাপারটাও ভাবতে হয়…।
ম্যালকম : তুমি কি সবসময় তোমার মিউজিক করে থাকো?
রায় : হ্যাঁ…তবে সবসময় নয়, ‘তিন কন্যা’র (১৯৬২) পর থেকে, নিজেই মিউজিক করছি।
ম্যালকম : অন্য কাউকে দায়িত্ব দেওয়ার চাইতে নিজে করে ফেলাটা অনেক সহজ বলে মনে হয়?
রায় : সত্যি বলতে, ভারতে কোন ফিল্ম কম্পোজার নেই। রবি শঙ্কর, আলী আকবর খান এবং বিলায়েৎ খান-এর মত মানুষের সাথে কাজ করার উদ্দেশ্য একটাই-তাঁরা সকলেই গুণী এবং খুব ভাল বাজিয়ে ও আমি তারা যে যন্ত্রগুলো বাজান সে যন্ত্রগুলি ছবিতে ব্যবহার করতে চাইছিলাম। আমি রবি শঙ্করকে দিয়ে প্রচুর সিতার বাজিয়ে নিতাম এবং ছবিতে যতখানি সম্ভব সে বাজনা ব্যবহার করেছি। রবি শঙ্কর ছাড়া কেউই কম্পোজার নয়। রবি শঙ্করের শুধুমাত্র ব্যালে স্কোর লেখার অভিজ্ঞতা আছে। তাছাড়া এদের কেউই এমন কোন মিউজিক লিখতে প্রস্তুত বা সুখী ছিলেন না যার দৈর্ঘ্য ৩মিনিট ৭ সেকেন্ড। এধরনের ফরমায়েশে এঁরা বিরক্ত হতেন, এই ভারতীয় ঘরানার শিল্পীরা বাজানোর পুরো স্বাধীনতা চাইতেন। কিন্তু,সিনেমার সাউন্ডট্র্যাকে এমন স্বাধীনতা ছিল না।
সিনেমার মিউজিকের বিশেষ রীতি আছে,শৈলী আছে; তোমাকে একটা একটা নির্দিষ্ট দৈর্ঘ্য,সার্টেইন লেংথ,সার্টেইন মুড ,সার্টেইন টোনকালারস মেনে সঙ্গীত রচনা করতে হবে। ওদের সাথে কাজ করা ক্রমে অত্যন্ত কঠিন হয়ে উঠছিল। কেননা আমি আমার আইডিয়া মত মিউজিক করতে চাইতাম; তাদের কাছে ব্যাপারটা আরোপিত মনে হতো, কখনো কখনো তারা আমার চাহিদার ধার দিয়ে না গিয়ে অন্য কিছু একটা সাজেস্ট করতো…এসব মনোমালিন্যের প্রভাব আমাদের পারস্পারিক সম্পর্কেও পড়েছিলো… আমি রবি শঙ্করকে প্রেফার করতাম কিন্তু তিনি তো ইন্টারন্যাশনাল ফিগার আমার প্রয়োজনের সময় তাঁকে পাওয়াই দায় হতো ।
রবি শঙ্করের পর আমি আলী আকবর খানের সাথে কাজ করি, উনি আমার জন্য খুব ভালো সরোদ বাজান। এভাবে কাজ করে বেশি মজা পেয়েছি বিলায়েৎ খান সাহেবের সাথে ‘জলসাঘর’-এ। শেষের দিকে আমি শুধু ওনাদের বিভিন্ন লয়ের এবং বিভিন্ন মুডের তিন মিনিট, তিন মিনিট দৈর্ঘ্যের মিউজিক রেকর্ড করতে বলতাম; এতে আমি একক বাদনের, বিভিন্ন মুডের বাজনার একটা মোটামোটি চয়েস পেতাম হাতে এবং পরে সঙ্গীত সংযোজনের সময় আসল নির্বাচনের কাজটা করতে হতো। কিন্তু, এটা কাজ করার সঠিক পদ্ধতি নয় আমি আগে যা বলেছি এঁরা কেউ-ই কি করতে হবে এই নির্দেশনা শুনতে পছন্দ করতেন না। এঁদের সাথে যখন কাজ করা হয়ে উঠল না। তখন দেখলাম আমার জন্য মিউজিক রচনা করতে পারে এরকম মানুষ আশেপাশে আমি নিজে ছাড়া আর কেউ নেই। ফিল্মে আসার অনেক আগে থেকেই সঙ্গীত যে আমার প্রথম প্রেম এই ব্যাপারটি সাব্যস্ত ছিল; পাশ্চাত্য সঙ্গীতে আমার একধরনের দখল ছিল কারণ আমি পাশ্চাত্য উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত, স্কোর দেখে দেখে, শোনার অভ্যাস তৈরি করেছিলাম। কলেজ জীবনে আমি রাতে শোবার আগেও শুয়ে শুয়ে বিভিন্ন স্কোর পড়তাম, তো, নিজের সিনেমার জন্য কম্পোজ করা প্রথম দিকে খুব কঠিন ছিল আমার জন্য, অত্যন্ত কঠিন, কিন্তু আমি লেগে ছিলাম আর, এখন ব্যাপারটা সড়গড় হয়ে গেছে।
ম্যালকম : তুমি কি কোন পাশ্চাত্য সঙ্গীত রচনা করেছো ?
রায় : না, যদিও আমার সমকালীন নাগরিক ছবিতে, ইদানীং বানানো কিছু নাগরিক ছবিতে প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের ঢং-এর মিশ্রণে কিছু মিউজিক করেছি। কারণ, বিশুদ্ধ ভারতীয় মার্গ সঙ্গীত নাগরিক জীবনের সাথে ঠিক যায় না। আমি প্রতিনিয়তই প্রাচ্য-প্রতীচ্যের বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রের কম্বিনেশন ব্যবহার করিÑ ট্রাম্পেট, সেতার ,তবলা, ওয়ের্স্টান ফ্লুট, ক্লারিনেটসহ এটা ওটা অনেক কিছুর মিশেল দেই একটা নতুন টোনকালার নির্মাণের জন্য যা প্রাচ্য-প্রাতীচ্যের বিভিন্ন রীতি/রুচি ইত্যাদির মিশ্রণে তৈরি শহরের মানুষের যে আধুনিকজীবন, সেই জীবনের ও যাপনের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হয়।
ম্যালকম : তোমার প্রিয় ওয়েস্টার্ন কম্পোজার কারা?
রায় : আমার মনে হয়, আমার বাকি জীবন আমি বাখ্, মোৎজার্ট এবং বেটোফেন শুনে কাটিয়ে দিতে পারবো তবে আমি বরোক মিউজিকের খুব ভক্ত। আমি স্কালেট্টি, রামেউদের সময় বা তার কিছু আগেকার মিউজিক শুনতে পছন্দ করি। আমি অপেরা, জর্জিয়ান চ্যান্ট শুনতে ভালোবাসি;আমির্ রামস ও শ্যুবার্ট খুব শুনি। একটা সময় ছিল যখন আমি শুধু সিবেলিয়াস শুনেছি। আমি বার্টোক বিশেষতঃ তাঁর চেম্বার মিউজিক খুব শুনি… এইটা তো ইতিমধ্যেই বেশ লম্বা একটা নামের ফর্দ, তাই না !
ম্যালকম : প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের সংগীতের সাদৃশ্য সম্পর্কে আমরা যা জানি মিলটা কি তার চাইতেও বেশি বলে তুমি মনে কর?
রায় : উভয় ক্ষেত্রে একই সিকেয়েন্সে নোট ব্যবহার করা হয়। তবে নোটটা ব্যবহার করার ধরণ আলাদা। প্রতীচ্যের সঙ্গীত কাউন্টারপয়েন্ট ও হারমোনির অভিমুখে অগ্রসর হয়েছে এবং প্রাচ্যের সঙ্গীত মেলোডিতে নিবিষ্ট পাশ্চাত্যের মত উল্লম্ব মেলোডীতে না, সমস্ত আনুভূমিক মেলোডি। সবই এক, তবে ভারতীয় সঙ্গীতের ধারা সরলরৈখিক কিন্তু, শুনে বুঝার উপায় নেই যে এই সঙ্গীত এত সরল, মূলতঃ মেলেডি ও রিদমের কম্বিনেশন ভারতীয় মার্গ সঙ্গীত কে জটিল করে তোলে। আসলে, এই কম্বিনেশটাই ভারতীয় সঙ্গীতে খানিকটা কাউন্টারপয়েন্টের অভাব ঘুচিয়ে দেয়। ওয়েস্টার্নের ক্ষেত্রে তা পার্কাসিভ ভারতীয়র ক্ষেত্রে তা মেলোডিক।
ম্যালকম : তোমার সাঙ্গিতিক প্রভাবের কথা শুনলাম। তোমার উপর ফিল্মি প্রভাব কি?
রায় : ভারতীয় ফিল্মের কোন প্রভাব নাই আমার ওপর!
ম্যালকম : একেবারেই না? খালি বিদেশী সিনেমার?
রায় : হ্যাঁ।
ম্যালকম : পার্র্টিকুলারলি কোন কোন পরিচালক?
রায় : ওহ, অসংখ্য, অসংখ্যজন। কারণ কলেজ লাইফে আমি সিনেমার পোকা ছিলাম, যদিও সিনেমার সিরিয়াস ছাত্র ছিলাম না, ফিল্ম বাফও ছিলামনা, শুধু ফিল্ম ফ্যান-ই ছিলাম, সিনেমা দেখতে পছন্দ করতাম। আমি ১৯৩০-৪০ দশকের আমেরিকান ছবির ভক্ত। এটা সিনেমার জন্য একটা দুর্দান্ত সময়, তাই না?
আমি মনে করি ফোর্ড, ওয়াইল্ডার, কাপরা এবং জর্জ স্টিভেন্স আমাকে ফিল্ম বানানোর শৈলীটা শিখিয়েছে। এরপরের ধাপে আমি রেনোয়া, দুভিভিয়ের, ক্লেয়ারের কাজ দেখি। ততদিনে ফিল্ম নিয়ে মোটামুটি সিরিয়াস এমন সময় আমি শান্তিনিকেতন লাইব্রেরিতে, যেখানে আমি পেইটিং পড়তাম, রেমন্ড স্পটিসউড, পল রোথা, পুদোভকিন-র অনুবাদ পড়ে ফেলি এবং আমার নতুন চোখ তৈরি হয়। আমি এসময়েই বুঝি ফিল্মের প্রাণ তারকারা নয় পরিচালক! ইনফ্যাক্ট পরিচালক সত্তাটির সাথে প্রথম পরিচিত হলাম বইগুলা পড়ার পর।
তুমি যদি ইনফ্লুয়েন্সের কথা বলো তবে আমি বলবো আমি প্রথমতঃ ডি সিকা ও রেনোয়া এবং তারপরে আমেরিকানদের দ্বারা প্রভাবিত। আমি চল্লিশের দশকের হলিউডি পরিচালকদের পছন্দ করি কিন্তু আমার কাজের সাথে তাদের কোন মিল দেখিনা কিন্তু তারপরও প্রভাব আছে হয়তো…। অন্যান্য মাধ্যমের যেমন সাহিত্যের প্রভাব আছে আমার উপর। আমি বিভূতি ব্যানার্জীর (পথের পাঁচালী) চরম ভক্ত। তাঁর লেখার শৈলী, ডিটেইলড সংলাপ, চরিত্রচিত্রণ, সম্পর্কের ট্রিটমেন্ট এই বিষয়গুলি আমাকে, আমার কাজকে, অসমম্ভবভাবে প্রভাবিত করেছে।
ম্যালকম : এবং অবশ্যই জাপানী সিনেমা তোমাকে প্রভাবিত করেছে।
রায় : ওটা অনেক পরের কথা। একচুয়ালি ‘রশোমন’ যখন কলকাতায় প্রথম আসে ততদিনে আমার পথের পাঁচালীর স্ক্রিপ্ট লেখা শেষ, সময়টা সম্ভবত ১৯৫১ বা ১৯৫২।
ম্যালকম : মিজোগুচি এবং ওজু আমাদের কাছে একটা সারপ্রাইজ ছিল। তোমার কাছেও নিশ্চয়ই?
রায় : ওহ,অসম্ভব,অসম্ভব এক চমক !
ম্যালকম : ফরাসি নিউওয়েভ তোমাকে আদৌ ছুঁয়েছিলো?
রায় : আমি ত্রুফোর প্রথমদিকের বাছাই কিছু কাজের সাথে তীব্র ঘনিষ্ঠতা অনুভব করি। তাই বলে আবার আমি এটাও মনে করি না যে সে বা আর কেউই সবসময় মাস্টারপিস বানায়। তোমাকে সবসময়ই কোন পরিচালকের সেরা কাজটা দিয়ে তাকে বিচার করতে হবে আর ক্রফোর ব্যাপারে আমার মনে হত আমি বুঝতে পারছি ও কোন কোন কাজ কেন ওভাবে করছে। কিন্তু, আমি নিজে কখনোই আভাঁগার্দ নই। আমার গল্প বলার ধরনটা খুবই সাদামাটা থেকেছে। এ ধরনের গল্প বলার কারণে ফ্রিজ শট, জাম্প কাট বা এ ধরনের কিছু ব্যবহারের প্রশ্নই আসে না, যদি না এসব ব্যবহার করার বিশেষ কোন কারণ না থাকে। যেমন, চারুলতার শেষ দৃশ্যে আমি ফ্রিজশট ব্যবহার করেছি, কারণ, এখানে ফ্রিজশটের ব্যবহারটা সুপ্রযুক্ত। যদি ‘ফোর হান্ড্রেড ব্লোজ’ আগেই নির্মিত না হয়ে থাকতো তাহলে হয়তো এই শটটা চারুলতায় থাকত না, সেই অর্থে আমার উপর নিউওয়েভের কিছুটা প্রভাব আছে। একজন এই ভাবে ফ্রিজশটটা ব্যবহার করেছে, আমিও তা ব্যবহার করেছি সম্পূর্ণ অন্যরকম পরিস্থিতিতে, অর্থাৎ, এই শট এভাবে ব্যবহার করা এখন চলচ্চিত্রের একটা ভাষার অঙ্গীভূত হয়ে গেছে, এই ভাষা যে ব্যবহার করবে, সে এইধরনের শটও ব্যবহার করতে পারবে, যদি সে চায়।
ম্যালকম : ‘চারুলতা’র শুরুতে একটা দৃশ্যে যেখানে চারুলতা দাঁড়িয়ে জানালা দিয়ে তার স্বামীকে দেখছে, ঐ সিনে খুবই শার্প অবট্রোসিভ একটা জুম আউট ব্যবহার করেছ, নাকি?
রায় : ঐ জুম আউট সিনটার সমাপ্তি ঘটায়।এই জুম আউটটা আমি ক্যালিগ্রাফি শেষে তুলির টানের সঞ্চালনের যে সপাট একরকম তীব্র অলঙ্করণ থাকে,তার কথা মনে করে করেছিলাম।
ম্যালকম : তো তুমি তাহলে অনেক দেশী ছবি দেখতে যেতে না? কোনো ভারতীয় পরিচালক তোমাকে কোন ভাবেই প্রভাবিত করে নি?
রায় : না। এমনকি আমার প্রথম চিত্রনাট্য ‘ঘরে-বাইরে’ লেখার আগেও একটা সময় ছিল,যখন আমি ফিল্ম বানাবার কথা চিন্তা করছিলাম, আমি তখন করতাম কি যেসব গল্প নিয়ে ছবি করার কথা চলছে সেসব গল্প নিয়ে আমার মত করে স্ক্রিপ্ট করতাম এবং পরে হলে গিয়ে ছবির সাথে মিলিয়ে দেখতাম আর এসব স্ক্রিপ্টে মাঝে মাঝে আমি রেগুলার ট্রিটমেন্ট অনুমান করতে চাইতাম। সিনেমাজগতে আমাদের আত্মীয়রা ছিল, একজন ছিলেন বাংলাছবির একজন পাইওনিয়ার, আরেকজন আত্মীয় প্রখ্যাত সাউন্ড রেকর্ডিস্ট ছিলেন। ফলতঃ আমাদের তাদের ছবি দেখতে যেতেই হতো। কোন সিনেমার ব্যাপাওে ভাল কোন কথা শুনলেই দেখতে যাওয়া হত,কিন্তু আমি কখনোই কোনো মানসম্মত বাংলা সিনেমার দেখার সৌভাগ্য অর্জন করতে পারিনি।
ম্যালকম : তুমি কি কখনো তোমার কাজে এমন কোন ঝুঁকি নিয়েছো যা তোমার জন্য একটা নতুন প্রস্থানবিন্দু তৈরি করেছে বলে তুমি ভাব?
রায় : ওহ্,আমি এমন বার-বার করেছি। আমি মনে করি চারুলতা আমার জন্য একটা প্রস্থানবিন্দু, পরশপাথর আরেকটি… জলসাঘর একটা প্রস্থানবিন্দু। জলসাঘর আমি বানিয়ে ছিলাম কারণ অপরাজিত বক্স অফিসে মার খেয়েছিলো… আমি এমন একটা ছবি বানাতে চেয়েছিলাম যা জনপ্রিয়তা পাবে, ফলে আমি এমন একটা গল্প খুঁজে বের করলাম যেখানে নাচ-গান ব্যবহার করা যায় যা আমি ভেবেছিলাম বাণিজ্যিকভাবে সফল হবার পূর্বশর্ত। কিন্তু, গল্পটা চিত্রনাট্যে পরিণত করার প্রক্রিয়ায় এক মূমূর্ষ ক্ষয়িষ্ণু সামন্তবাদের পতন দেখাতে গিয়ে আমি পপুলার মিউজিকের স্থলে মার্গ সঙ্গীতের সেরা ভারতীয় উদাহরণ ব্যবহার করলাম। ফলে,জলসাঘরও হয়ে উঠল একটা প্রস্থানবিন্দু।
আমার প্রথম মৌলিক চিত্রনাট্য ‘কাঞ্চনজঙঘা’। এই ছবিটাও, প্রচলিত নর্ম থেকে একরকম প্রস্থান। কারণ পুরা স্ট্রাকচারটাই নতুন ছিল। আমি, নিজেও এই নবীনত্ব সম্পর্কে সজাগ ছিলাম না। আমি স্রেফ আমার মাথায় যে গল্পটি ছিল সেটি বলে গেছি। এই হলো গল্পের পরিবেশ-পরিস্থিতিটি, এই হলো কাহিনির পরিবার, এই তাদের পারস্পারিক সম্পর্ক তাহলে এদের ঘিরে ঘনায় ওঠা গল্পটা বয়ানের সবচেয়ে ভালো পদ্ধতি কি হতে পারে? আমি যখন দর্শকের সাথে প্রথম ছবিটি দেখতে বসলাম তখন আমি রীতিমত বুঝতে পারি এই প্রস্থানটি কতটা আনকোরা ছিল, হয়তো একটু বেশিই ছিল। আমার এমন কাজ করাটা ভুল ছিল এধরনের ছবির তখন কোন দর্শক ছিল না,এখন হয়তো আছে। অর্থাৎ, আমি বলতে চাচ্ছি, ঝুঁকি নেবার জন্য, বা নতুন কথা বলবার জন্য অনেক গিমিক বা জাম্প কাটের দরকার নেই।
ম্যালকম : আমি জানি, দর্শকদের মধ্যে প্রশ্ন করার জন্য অনেকে উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করছেন।
দর্শক : আপনি কি কখনো আপনার ছবিকে রাজনৈতিক হাতিয়ার বা ফোরাম হিসেবে কখনো ব্যবহার করেছেন?
রায় : ভগবান, একেবারেই না! রাজনৈতিক ফোরাম হিসেবে না। যদিও আমার সাম্প্রতিক সময়ের ছবিতে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এসেছে। আসলে ‘রাজনৈতিক ছবি’র সংজ্ঞা আমি জানি না। যা আমি জানি তা হচ্ছে, একটি নির্দিষ্ট সীমা লংঘনের পর ভারতে বসে সেন্সরশিপ নামক খড়গের কারণে আপনার পক্ষে পলিটিক্যাল ফিল্ম করা সম্ভব হবে না। প্রতিষ্ঠানকে বা ক্ষমতাবান দলকে আক্রমণ করে বা সমালোচনা করে কোন র্যাডিকাল ছবি আপনি ভারতে করে উঠতে পারবেন না। ইট সিম্পলি ক্যান্ নট বি ডান। কিন্তু, আপনি আবার পলিটিক্যাল চরিত্রদের নিয়ে ছবি বানাতে পারবেন এবং ব্যাকড্রপে রাজনীতিকে তুলে ধরতে পারবেন। এদিক থেকে আমি ‘সদগতি’কে বলি পলিটিক্যাল ফিল্ম, তোমার কি মনে হয়?
ম্যালকম : হ্যা, অবশ্যই।
রায় : তবে আমি ফিল্মকে ফোরাম হিসেবে ব্যবহার করি না। আমি পলিটিক্যাল ফিল্ম করেছি।
দর্শক : ‘অশনি সংকেত’ কি পলিটিক্যাল ফিল্ম নয়?
রায় : আপনি যদি তাই মনে করেন তবে আপনি তা বলার পূর্ণ স্বাধীনতা রাখেন।
দর্শক : আপনি বলেছেন আপনি বেশিমাত্রায় পশ্চিমা সংস্কৃতির দ্বারা প্রভাবিত…
রায় : আমি মনে করি আমার সত্তার মধ্যে পঞ্চাশভাগ ভারতীর আর পঞ্চাশভাগ পশ্চিমী সাংস্কৃতিক স্বত্তার মিশেল আছে…
দর্শক : আপনার কি মনে হয় আপনার জীবনে এই দুই সংস্কৃতির কোন সংঘাত আছে?
রায় : আমি তা মনে করি না। আমার ভেতরের সাংস্কৃতিক মিশ্রণটাকে বলা যেতে পারে ফিউশন। যখন আমি ঠিক করলাম আমি ফিল্মমেকার হব, তখন অবশ্যই আমার ভারতীয় সত্ত্বাকে তুলে ধরা শিখতে হয়েছে। কারণ, এখানেই আমার শেকড় এবং আমাকে আমার শেকড় সম্পর্কে সচেতন হতেই হবে। বছরের পর বছর কাজ করার পর আমি একজন সৎশিল্পী হিসেবে আমার স্বদেশ এবং জনমানুষ এবং আমাদের সমস্যাগুলোকে স্পষ্টভাবে উপলদ্ধি করেছি। যেহেতু আমি পশ্চিমবঙ্গে কাজ করি তাই এখানকার সাংস্কৃতিক অতীত-ঐতিহ্য সম্পর্কে সচেতন থাকা একজন সক্রিয় চলচ্চিত্রকর্মীর জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এক্ষেত্রে পশ্চিমা শিক্ষা ও সংস্কৃতির অধ্যয়ন প্রতিবন্ধক হতে পারে না।
দর্শক : আপনার সাদা কালো এবং রঙ্গীন স্টক ব্যবহারের ক্ষেত্রে নিজস্ব একটি মুন্সিয়ানা লক্ষ্য করা যায় এ ব্যাপারে একটু বলেন…
রায় : আমি এখন মনে করি, সাদা-কালো সবচেয়ে এফেক্টিভ মিডিয়াম কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য ভারতে এখন ভাল সাদা-কালো স্টক পাওয়া যায় না। এখন যে স্টকগুলি এভেইলেবল সেগুলোতে চাহিদামত গ্রেডেশন করা যায় না, যা আমরা আগে কোডাক স্টকে করতে সক্ষম হতাম। অন্যদিকে সময়ের সাথে সাথে রঙ্গীন স্টক অনেক উন্নতি করেছে এবং ল্যাবরেটরিওয়ার্ক এরও অনেক উন্নতি হয়েছে।