‘ক্রান্তিকালে রবীন্দ্রনাথ আমাদের পথ দেখিয়েছেন’
বাঙালির মন ও মননের কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সারা জীবন ধরে সৃষ্টি করেছেন অজস্র অনবদ্য সব গান, গল্প, কবিতা, উপন্যাস, নাটকসহ নানা ধরনের রচনা। তাঁর এসব লেখনীতে উঠে এসেছে বাঙালির যত আবেগ-অনুভূতি, সুখ-দুঃখ-আনন্দ-বেদনা, হাসি-কান্না, প্রেম-ভালোবসা। আর এসব নানা কারণে আমরা বারবার ফিরে যাই রবীন্দ্রনাথের কাছে। তাই হয়তো বাংলাদেশে ও ভারতে বারবার প্রকাশিত হয়েছে তাঁর রচনাবলি।
বাংলাদেশে এর আগেও রবীন্দ্র-রচনাবলি প্রকাশিত হয়েছে, কিন্তু দেশের অন্যতম সৃজনশীল প্রকাশনা সংস্থা ‘ঐতিহ্য’ এই প্রথমবারের মতো ৩০ খণ্ডে কিছুটা ভিন্ন আঙ্গিকে প্রকাশ করল রবীন্দ্র-রচনাবলি।
২২ হাজার ৫০০ পৃষ্ঠার এই রচনাবলি নতুনভাবে বিন্যাস করা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের লেখার প্রকাশক্রম অনুসারে সাজানো হয়েছে এই রচনাবলি। ৩০ খণ্ডে এই রচনাবলির সম্পাদনা করেছেন এপার বাংলা-ওপার বাংলার অন্যতম রবীন্দ্র-গবেষক অধ্যাপক সৈয়দ আকরম হোসেন।
গতকাল বুধবার বিকেলে আনন্দমুখর আয়োজনে এই ৩০ খণ্ডে ‘ঐতিহ্য’ প্রকাশিত রবীন্দ্র-রচনাবলি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশিত হলো। এ উপলক্ষে এদিন জাতীয় জাদুঘরের প্রধান মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয় ‘ঐতিহ্য রবীন্দ্র-রচনাবলি’ প্রকাশনা উৎসব।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ প্রকাশনা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ভারতের রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক পবিত্র সরকার, বর্তমান উপাচার্য সব্যসাচী বসু রায় চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, প্রখ্যাত রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা ও জাতীয় জাদুঘর বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সভাপতি আজিজুর রহমান আজিজ।
অনুষ্ঠানে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন রবীন্দ্র-রচনাবলির সম্পাদক সৈয়দ আকরম হোসেন। স্বাগত বক্তব্য রাখেন প্রকাশনী প্রতিষ্ঠান ঐতিহ্যর প্রকাশক আরিফুর রহমান নাঈম।
৩০ খণ্ডে এই প্রথম রবীন্দ্রনাথের সমগ্র চিঠিপত্র ‘ছিন্নপত্র’, ‘ছিন্নপত্রাবলী’, ‘চিঠিপত্র’ (১-১৯ খণ্ড), ‘প্রমথনাথ বিশীকে লিখিত পত্র’, ‘ভানুসিংহের পত্রাবলী’ ও ‘পথে ও পথের প্রান্তে’ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া অখণ্ড ‘গীতবিতান’ও ভিন্ন রূপে ও প্রকরণে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সাহিত্য-ছবি-গান ও সুরের দিকে লক্ষ রেখে রবীন্দ্রনাথ-অঙ্কিত ‘রূপ-বিরূপে’র দুই শতাধিকের বেশি রঙিন ছবি ও প্রাসঙ্গিক চার শতাধিক সাদা-কালো ছবিও রচনাবলির অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
প্রকাশনা উৎসবে সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, ‘রবীন্দ্র রচনার বিপুল সম্ভার এত বিস্তৃত, যা একসঙ্গে প্রকাশ করা কঠিন। এমন সব লেখা রয়েছে, যা বিশ্ব ভারতীর রচনাবলিতে নেই। আশা করি, সৈয়দ আকরম হোসেনের সম্পাদিত রচনাবলিতে রবীন্দ্রনাথের সব লেখা একসঙ্গে তুলে দিচ্ছে পাঠকের হাতে।’
রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য, লেখক ও গবেষক অধ্যাপক পবিত্র সরকার বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথকে কেন আলাদা করে প্রকাশ করা হচ্ছে। কেন তাঁকে আলাদা করে প্রয়োজন?’ এ প্রশ্ন রেখে রবীন্দ্রনাথ থেকেই উত্তর দিলেন তিনি। বললেন, ‘সকলের সঙ্গে মিলিত হয়ে বাঁচো, প্রেমের মধ্যে বাঁচো, মানুষকে ভালোবেসে বাঁচো। শুধু মানুষের মাঝে নয়, প্রাণিজগৎও তোমার ভালোবাসার বিষয় হোক। নিসর্গের সঙ্গে যুক্ত হও। বর্ষার সঙ্গে, বসন্তের সঙ্গে যুক্ত হও।’
উপাচার্য সব্যসাচী বসু রায় চৌধুরী বলেন, ‘এমন বেশ কিছু বিষয় এ রচনাবলিতে যুক্ত করা হয়েছে, যা অন্য রচনাবলিতে মেলে না। রবীন্দ্রনাথ বাঙালি জীবনযাপন, সংস্কৃতিকে তুলে ধরেছেন। বাংলাভাষী মানুষের চিন্তাকে যেভাবে তুলে ধরেছেন, তা আর কারো পক্ষে সম্ভব ছিল না। তাঁর লেখার মধ্য দিয়েই বাঙালি তার আত্মপরিচয় খুঁজে পেয়েছে।’
অধ্যাপক ও কথাসাহিত্যিক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের জাতীয় জীবনের ক্রান্তিকালে রবীন্দ্রনাথ প্রত্যেকবার আমাদের পথ দেখিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের কাছে বারবার ফিরে ফিরে যাওয়া আমাদের অভ্যাস। ৩০ খণ্ডের রবীন্দ্র-রচনাবলি হাতে পেলে তাঁর লেখা পড়া সহজ হবে।’