ঢাকার কথা ৩৭
ঢাকায় নটমঞ্চ ও মঞ্চায়ন
ঔপনিবেশিক শাসন যুগে ঢাকা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে বেশ গতিশীল ছিল। এর মধ্যে নাটক ও নৃত্যনাট্যের অবস্থান ছিল লক্ষণীয়। এ পর্বে স্থায়ী ও অস্থায়ী মঞ্চ গড়ে ওঠে। প্রথাগতভাবে ঢাকায় নাট্যমঞ্চ তৈরির আগে নাটকের বিকল্প ছিল যাত্রাগান। যাত্রাপালা বহুকাল ধরেই গ্রামবাংলার মানুষের প্রধান বিনোদন ছিল।
ঊনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ঢাকাবাসী সাংস্কৃতিক ক্রিয়াকর্মে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ১৮৬০ সালের দিকে ঢাকায় প্রথম নাট্যশালা প্রতিষ্ঠিত হয়। এর নাম দেওয়া হয় ‘পূর্ববঙ্গ রঙ্গভূমি’। এই নাট্যশালাটির অবস্থান ছিল বর্তমান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে। পূর্ববঙ্গ রঙ্গভূমির মঞ্চে প্রথম যে নাটকটি অভিনীত হয়েছিল, তার নাম ‘রামাভিষেক’। ঢাকার স্থানীয় যুবকরা এতে অভিনয় করেন। পরে শৌখিন নাট্য অনুরাগীদের পাশাপাশি পেশাদার শিল্পীগোষ্ঠীও এই মঞ্চে অভিনয় করেছে।
এই নির্দিষ্ট নাট্যমঞ্চ ছাড়াও বর্তমান বলধা গার্ডেনে বলধার জমিদার নগেন্দ্র চৌধুরীর বাড়িতে প্রতি সন্ধ্যায় নাটিকার আয়োজন হতো। কয়েকটি স্কুল-কলেজ চত্বরেও অস্থায়ী মঞ্চ বানিয়ে নাট্যাভিনয়ের চর্চা হতো। এ ছাড়া ঢাকার কয়েকটি প্রেক্ষাগৃহের মঞ্চে মাঝে মাঝে সাজানো হতো নৃত্য বা নাটকের মঞ্চ। প্রথাগত নাটক অনুষ্ঠানের অভিজাত মঞ্চ ছিল ‘পূর্ববঙ্গ রঙ্গভূমি’। পেশাদার নাট্য দলগুলো মেয়েদের দিয়েই নারী চরিত্রে অভিনয় করাত। অভিনেত্রীরা ছিলেন পেশাদার নটী বা বাঈ। এঁদের মধ্যে ঢাকার তিনজন খ্যাতিময়ী বাঈ-এর নাম পাওয়া যায়। এঁরা হচ্ছেন গন্নুবাঈ, আন্নুবাঈ ও নয়াবীন। এরা প্রধানত উর্দু নাটকে অভিনয় করতেন। সেকালের ঢাকায় উর্দু নাটক বেশ জনপ্রিয় ছিল। এ সময় মঞ্চায়ন করা দুটি বিখ্যাত উর্দু নাটক হচ্ছে ‘ইন্দ্রসভা’ ‘জাদুনগর’। তবে অপেশাদার নাট্যদল বা ক্লাব নাটকে নারী চরিত্রে মেয়েদের আগমন ঘটেছে অনেক পরে। তাই এ সময় ছেলেরাই মেয়ে চরিত্রে অভিনয় করত।
হিন্দু ধর্মীয় উৎসবকে ঘিরে পাড়া-মহল্লায় অস্থায়ী মঞ্চে নাটকের আয়োজন হতো। সাধারণত উন্মুক্ত মাঠে বা স্কুল কলেজের প্রাঙ্গণে এই মঞ্চ তৈরি করা হতো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক নাটক মঞ্চস্থ হতো কার্জন হল মঞ্চে। ১৯১৭ সালে ঢাকার ঠাটারী বাজার এলাকায় একটি মিলনায়তন নির্মিত হয়। প্রথমদিকে এর নামকরণ করা হয়েছিল ‘ঠাটারী বাজার মিলনায়তন’। পরে তা ‘মাহবুব আলী ইনস্টিটিউট’ নামে পরিচিত হয়। এই মিলনায়তনের মঞ্চে অনেক নাটক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হতো। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯১৭ সালে যুদ্ধের তহবিল গঠন করার জন্য এই মঞ্চে ম্যাজিক শোর আয়োজন করা হয়েছিল।
বিশ শতকের প্রথমার্ধে ঢাকায় প্রগতি লেখক সংঘ কলকাতার এক নাট্য দলকে আমন্ত্রণ জানায়। এই আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে বিজন ভট্টাচার্য তাঁর দল নিয়ে ঢাকায় এসেছিলেন। সদরঘাটে রূপমহল সিনেমা হলের উল্টোদিকে মেয়েদের স্কুলের মিলনায়তনে এই নাট্যদলের জন্য মঞ্চ সাজানো হয়। তাঁরা মঞ্চস্থ করেন ‘নবান্ন’ নামের নাটক। বিখ্যাত অভিনেতা শম্ভু মিত্র এই নাটকে অভিনয় করেছিলেন।
‘শৌখিন’ নামের একটি নৃত্যগোষ্ঠী ১৯৫০ সালে রূপমহল সিনেমা হলে একটি নৃত্যানুষ্ঠান মঞ্চায়ন করেছিল। এই দলটি ছিল বিখ্যাত নৃত্যশিল্পী বুলবুল চৌধুরীর গড়া। বুলবুল চৌধুরী নিজেও এসেছিলেন এই দলের সঙ্গে। আরমানীটোলায় অবস্থিত ‘পিকচার হাউস’ সিনেমা হলে ১৯৫৬ সালে ‘শাপমোচন’ নামে একটি নৃত্যনাট্য মঞ্চস্থ হয়। এর মঞ্চায়ন করেছিলেন ‘বহুরূপী নাট্যগোষ্ঠী’। নাটকটি তখন নৃত্যরসিক দর্শকদের বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছিল। এর কাছাকাছি সময়ে ঢাকায় একটি চীনা নাট্যদল শুভেচ্ছা সফরে এসেছিল। তাদের অভিনয় প্রদর্শনের জন্য সে সময় ঢাকা স্টেডিয়ামে বিশাল মঞ্চ বানানো হয়। মঞ্চ ছাড়াও দর্শকদের জন্য তৈরি করা হয়েছিল গ্যালারি। ঢাকার দর্শক মুগ্ধ হয়ে চীনাদের অভিনয় ও নৃত্য উপভোগ করে।
বিশ শতকের শেষদিকে ঢাকায় ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠিত হয়। এই অডিটোরিয়ামের মঞ্চ ক্রমে নাট্য ও অন্যান্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য সুপরিচিত হয়ে ওঠে। শুরুর দিকে এই মঞ্চে ইন্দোনেশিয়ার এক শিল্পীদলের নৃত্যানুষ্ঠান মঞ্চস্থ হয়েছিল।