সেকালে ঢাকায় মাহে রমজান
উনিশ শতকের শেষ দিকে ঢাকাবাসীর রোজা পালন ও ঈদ উৎসবের কিছু চিত্র পাওয়া যায় সমকালীন বা প্রায়-সমকালীন গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকায়। বর্ণাঢ্য আয়োজন, উৎসব ও পবিত্রতার মধ্য দিয়ে রমজান মাসকে বরণ ও উদযাপন করা হতো। চাঁদ দেখে রোজা রাখার শুরুটা রোজদারদের জন্য ছিল অনেক বেশি আনন্দের। এখন আকাশচুম্বী দালান-কোঠার জন্য ঢাকায় চাঁদ দেখা সহজ নয়। তা ছাড়া বর্তমান প্রজন্মের মধ্যে চাঁদ দেখার কৌতূহল অনেকটাই খুঁজে পাওয়া যায় না। চাঁদ দেখে রোজার শুরু। প্রথম সেহরির আয়োজন করা। অথবা দল বেঁধে ঈদের চাঁদ দেখে ছোটদের মিছিল বের করা। আর কোরাসে ‘আজকে খুশির দিন, কালকে ঈদের দিন’ স্লোগান দেওয়া- এসব এখন শহুরে জীবনের কৈশোর থেকে হারিয়ে গেছে।
সেকালে ঢাকা শহরের উঁচু দালান বলতে ছিল আহসান মঞ্জিল, বড় কাটরা, ছোট কাটরা আর হোসেনি দালান। রমজানের চাঁদ দেখার জন্য ঢাকার উৎসুক নাগরিকরা এসব ইমারতের ছাদে এসে ভিড় করত। এক চিলতে বাঁকা চাঁদ অল্প সময়ে ভাসত আকাশে। একজন দেখলে আরেক জনকে দেখতে সাহায্য করত। অনেকে বুড়িগঙ্গা নদীতে নৌকা ভাসিয়ে চাঁদ দেখত। আহসান মঞ্জিল থেকে চাঁদ দেখার পর সরকারিভাবে চাঁদ দেখা নিশ্চিত করা হতো। চাঁদ দেখতে পেলে চাঁদকে সালাম দেওয়ার একটি রেওয়াজ ছিল। চাঁদ দেখে বয়োজ্যেষ্ঠরা মোনাজাত করতেন। তারপর করতেন কোলাকুলি। আর ছোটরা বড়দের সালাম করত।
সমকালীন সূত্র বলছে উনিশ শতকের শেষ দিকে ঢাকার খুব কম মসজিদেই খতমে তারাবি পড়া হতো। এর বড় কারণ হচ্ছে হাফেজদের সংখ্যা কম থাকা। সেহরি ও ইফতারির আয়োজনের জন্য ঢাকার মুসলিম পরিবারগুলো বেশ ব্যস্ত হয়ে পড়ত দুপুর থেকেই। বাড়িতে ইফতারি তৈরি হলেও পুরনো ঢাকার মানুষ দোকানের বাহারি নামের ইফতারি কিনে আনতে পছন্দ করত। ঢাকার বিশেষ কয়েকটি স্থানে ইফতারির পসরা সাজাত দোকানিরা। তখনো ইফতারির সবচেয়ে বড় বাজার বসত চকবাজারে। মোগল আমল থেকেই চকবাজারের বাদশাহী মসজিদকে ঘিরে ইফতারিসহ হরেক রকম দ্রব্যাদি বেচা কেনা হতো। চকবাজারে নানা ধরনের ইফতারি বানানো হতো। কোনো কোনো খাবার শুধু রোজার সময়ই পাওয়া যেত। এগুলোর মধ্যে চিড়া, উখরা, মোরব্বা, কাবাব, নিমকপাটা, ফালুদা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
বাড়ি ছাড়াও মসজিগুলোতে ইফতারির আয়োজন হতো। মহল্লার প্রায় সব বাড়ি থেকেই ইফতারি পাঠানো হতো মসজিদে। রোজদাররা তা ভাগ করে খেতেন। অনেক ছোট ছেলেমেয়ে ইফতারির আকর্ষণে মসজিদে ভিড় করত। পুরোনো ঢাকার সরদাররা মসজিদের ইফতারির তদারকি করতেন। একটি সূত্র থেকে জানা যায় পুরোনো ঢাকার খ্যাতিমান কাদের সরদার প্রায় ৪০ বছর (১৯৩০-১৯৭৪) ঢাকার অনেক মসজিদে ইফতারি হিসেবে তেহারি পাঠাতেন। পুরোনো ঢাকায় বেয়াই বাড়িতে ইফতারি পাঠানোর একটি সামাজিক রীতি ছিল। আর এসব পাঠানো হতো বেশ জাঁকালোভাবে। কুলির মাথায় নানা রকম ডালা সাজিয়ে। এখনো এসব রীতি কিছুটা টিকে আছে।
রোজার দিনে ভোররাতে সেহরি খাওয়ার সময় নগরবাসীর ডেকে দেওয়ার এক বিশেষ সংস্কৃতি চালু ছিল পুরোনো ঢাকায়। এখনো তা অবলুপ্ত হয়নি। একে বলা হয় কাসিদা। গানের একটি দল কাসিদা নামে পরিচিত এক ধরনের গান গেয়ে মহল্লায় মহল্লায় নগরবাসীর ঘুম ভাঙ্গাত। পাড়ার যুবকরাই সাধারণত এই গানের দল গড়ত। ঈদের দিন শ্রেষ্ঠ কাসিদা দলকে পুরস্কার দেওয়া হতো।