আব্বাস কিয়ারোস্তামির আলোচিত ১০ চলচ্চিত্র
প্রখ্যাত ইরানি চলচ্চিত্রকার আব্বাস কিয়ারোস্তামি আর নেই। ৭৬ বছর বয়সে গতকাল সোমবার (৪ জুলাই) ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে মারা যান তিনি। এ খবর জানিয়েছে ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসি ও দ্য গার্ডিয়ান।
ক্যানসার চিকিৎসার জন্য তিনি প্যারিসে চিকিৎসাধীন ছিলেন। গত মার্চে কিয়ারোস্তামির শরীরে ক্যানসার ধরা পড়ে। ১৯৭০ সাল থেকে চলচ্চিত্র নির্মাণের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন কিয়ারোস্তামি। তিনি ৪০টির মতো চলচ্চিত্র ও প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেছেন। ১৯৯৭ সালে ‘টেস্ট অব চেরি’ ছবির জন্য কান চলচ্চিত্র উৎসবে ‘পাম দ’ওর’ পুরস্কার জিতেছিলেন। তিনি একমাত্র ইরানি, যিনি চলচ্চিত্রের এই সম্মানজনক পুরস্কার লাভ করেছিলেন।
আব্বাস কিয়ারোস্তামির অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছে—কোকের ট্রিলোজি (১৯৮৭-৯৪), ক্লোজ-আপ (১৯৯০), উইন্ড উইল কেরি আস (১৯৯৯), সার্টিফাইড কপি (২০১০), লাইক সামওয়ান ইন লাভ (২০১২)।
ইরানি নির্মাতা হলেও কিয়ারোস্তামি বিশ্ব চলচ্চিত্র দ্বারা যেমন প্রভাবিত ছিলেন, তেমনি তাঁর নির্মিত চলচ্চিত্রও বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নির্মাতাদের প্রভাবিত করেছে। প্রখ্যাত ফ্রেঞ্চ-সুইস চলচ্চিত্র নির্মাতা জ্যঁ লুক গদার বলেছিলেন, ‘চলচ্চিত্র শুরু হয়েছে ডি ডব্লিউ গ্রিফিতকে দিয়ে আর শেষ হয়েছে আব্বাস কিয়ারোস্তামিকে দিয়ে।’
১৯৪০ সালের ২২ জুন ইরানের রাজধানী তেহরানে জন্মেছিলেন আব্বাস কিয়ারোস্তামি। ১৯৬৯ সালে পারভিন আমির-গোহলির সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি। ১৯৮২ সালে তাঁদের বিচ্ছেদ হয়ে যায়। আহমাদ ও বাহমান নামের তাঁদের দুই ছেলে রয়েছে।
চলচ্চিত্রবিষয়ক ওয়েবসাইট টেস্ট অব সিনেমা জানিয়েছে আব্বাস কিয়ারোস্তামির গুরুত্বপূর্ণ ১০টি চলচ্চিত্রের কথা
১. দ্য ট্রাভেলার (১৯৭৪)
কিয়ারোস্তামির প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবি ‘দ্য ট্রাভেলার’। ছবির কাহিনী আবর্তিত হয়েছে কাসেম জুলায়ি নামের এক কিশোরকে নিয়ে, যে ফুটবল খেলতে খুব পছন্দ করে। কাসেমের স্বপ্ন, সে তেহরানের আমজাদি স্টেডিয়ামে বসে একটি ফুটবল ম্যাচ দেখবে। অর্থ চুরি করে, একটি পুরোনো ক্যামেরা বিক্রি করে সে তার স্বপ্নপূরণের চেষ্টা চালিয়ে যায়। তার পরও অনেক কষ্টে টাকা জোগাড় করে সে আমজাদি স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে গিয়ে পৌঁছায় এবং খেলা দেখা শুরু করে। কিন্তু ক্লান্তির কারণে কিছুক্ষণ পরেই সে ঘুমিয়ে পড়ে। যখন তার ঘুম ভাঙে সে দেখে পুরো স্টেডিয়াম ফাঁকা, শুধু সে একাই পড়ে আছে গ্যালারিতে।
২. দ্য রিপোর্ট (১৯৭৭)
একজন মানুষকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করার পর ধীরে ধীরে তার জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। স্ত্রীর সঙ্গে তার প্রতিদিনই ঝগড়া হয়। চাকরি হারানোর ফলে একজন মানুষের ব্যক্তিগত ও সামগ্রিক জীবনে কী ধরনের প্রভাব ফেলে, সেটাই ছবিটিতে ফুটিয়ে তুলেছেন কিয়ারোস্তামি। শেষমেশ স্ত্রী-সন্তানকে ফেলে অজানার উদ্দেশে পাড়ি জমায় সে। কারণ তার ধারণা হয়, তার অনুপস্থিতিই স্ত্রী ও সন্তানের ভবিষ্যৎকে সুখকর করে তুলতে পারে।
৩. হোয়্যার ইজ দ্য ফ্রেন্ডস হোম? (১৯৮৭)
কোকের ট্রিলোজির প্রথম ছবি এটি। একই সঙ্গে চলচ্চিত্রটি কাব্যিক ও বাস্তববাদী। চলচ্চিত্রটির ইরানি নামটি নেওয়া হয় ইরানি কবি সোহরাব সেফেরির একটি কবিতা থেকে। এই চলচ্চিত্রে শিশুদের সরলতা ও গ্রামবাসীর নৈতিকতার বিষয়গুলো তুলে ধরেছেন কিয়ারোস্তামি।
৪. ক্লোজ-আপ (১৯৯০)
বিখ্যাত ইরানি চলচ্চিত্র নির্মাতা মোহসেন মাখমালবাফ সেজে জালিয়াতি করা এক লোকের গল্প এই ছবিতে তুলে এনেছেন কিয়ারোস্তামি। তবে সেটা অর্থনৈতিক কারণে নয়, বরং সে একজন চলচ্চিত্রপ্রেমী এবং নিজেকে মাখমালবাফ হিসেবে পরিচয় দিতে সে খুবই গর্ববোধ করে।
৫. লাইফ, অ্যান্ড নাথিং মোর...(১৯৯১)
কিয়ারোস্তামির বিখ্যাত কোকের ট্রিলোজি ছবির দ্বিতীয় ছবি এটি। একজন চলচ্চিত্র পরিচালক ১৯৯০ সালের কোকের ভূমিকম্পের পর তার চলচ্চিত্রের জন্য অভিনেতা খুঁজতে থাকেন। এটি মূলত প্রামাণ্যচিত্রের মতো করে তৈরি করেছেন কিয়ারোস্তামি। সত্যি ঘটনা, চরিত্র ও স্থানের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কিছু নাটকীয়তা তৈরি করেছেন তিনি। আব্বাস কিয়ারোস্তামির ভক্তদের এই ছবি অবশ্যই দেখা উচিত। কারণ এই ছবিতেই প্রথমবারের মতো ‘দ্য ড্যাশবোর্ড ক্যামেরা’ পদ্ধতি প্রয়োগ করেন কিয়ারোস্তামি। এই ছবি নিয়েই প্রথম কান চলচ্চিত্র উৎসবে হাজির হন কিয়ারোস্তামি।
৬. থ্রু দ্য অলিভার ট্রিস (১৯৯৪)
কোকের ট্রিলোজির শেষ ছবি এটি। খুবই সাধারণ এবং সরল প্রেমের ছবি এটি। হোসেইন একজন স্থানীয় অভিনেতা। তাহিরিকে ভালোবাসে সে, কিন্তু তাহিরি তাকে ফিরিয়ে দেয়। তারপরও মঞ্চে অভিনয়ের সময় তাহিরিকে বিয়ের প্রস্তাব দেয় হোসেইন এবং বলে যে সে একজন ভালো স্বামী হবে। শেষমেশ হোসেইনকেই বিয়ে করে তাহিরি।
৭. টেস্ট অব চেরি (১৯৯৭)
আব্বাস কিয়ারোস্তামির অন্যতম সেরা কাজ হিসেবে বিবেচনা করা হয় ছবিটিকে। বাদি নামের এক লোকের কাহিনী এই ছবিতে তুলে এনেছেন কিয়ারোস্তামি। আত্মহত্যার পর তাঁকে দাফন করবে এমন একজন মানুষকে খুঁজে বেড়ায় সে। এই ছবির কারণে কান চলচ্চিত্র উৎসবে ‘পাম দ’ওর’ পুরস্কার জিতেছিলেন কিয়ারোস্তামি। অবশ্য ছবির বিষয়বস্তুর কারণে নিজ দেশ ইরানে নিষেধাজ্ঞা ও সমালোচনার শিকার হন তিনি। এই ছবির শেষ দৃশ্য ছাড়া আর কোথাও কোনো সংগীত ব্যবহার করেননি ইরানের এই বিশ্বখ্যাত পরিচালক।
৮. দ্য উইন্ড উইল ক্যারি আস (১৯৯৯)
এই ছবিটির বিষয়বস্তুও জীবনমৃত্যু নিয়ে। ৫৯ বছর বয়সের পর থেকেই মৃত্যু নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে শুরু করেন কিয়ারোস্তামি, যা তার কাজের মধ্যে উঠে এসেছে। ইরানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কবি ফরুঘ ফাররোখাজদেলের কবিতা থেকে চলচ্চিত্রটির নামকরণ করা হয়। ছবিটিতে ওমর খৈয়ামের কবিতাও ব্যবহার করা হয়েছে। বিভিন্ন চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত ও প্রশংসিত হয় ছবিটি। ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে ‘সিলভার লায়ন’ পুরস্কার জিতেছিল ছবিটি।
৯. টেন (২০০২)
২০০০ সালের পর থেকেই নিরীক্ষামূলক চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু করেন কিয়ারোস্তামি। সেই সময়কার ছবি ‘টেন’। এটি একটি নারীকেন্দ্রিক ছবি। পুরো ছবির দৃশ্যধারণ করা হয় ড্যাশবোর্ড ক্যামেরায়। ছবিটিতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই চরিত্রগুলোর ‘পয়েন্ট অব ভিউ শট’ নেন কিয়ারোস্তামি। ছবির চরিত্র একজন তালাকপ্রাপ্ত নারী, যিনি গাড়ি চালান এবং তার গাড়ির যাত্রীদের সঙ্গে তার কথোপকথনের বেশকিছু দৃশ্য রয়েছে। কিয়ারোস্তামির অন্যতম সফল ছবি হিসেবে বিবেচনা করা হয় এই ছবিটিকে। ২০০২ সালে কান চলচ্চিত্র উৎসবে ‘পাম দ’ওর’ পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিল ছবিটি।
১০. সার্টিফায়েড কপি (২০১০)
এটাই কিয়ারোস্তামির প্রথম ছবি, যেটি সম্পূর্ণ ইরানের বাইরে দৃশ্যধারণ করা হয়। এই ছবির প্রিমিয়ারও হয় ইরানের বাইরে। কিয়ারোস্তামির দীর্ঘদিনের বান্ধবী ফরাসি অভিনেত্রী জুলিয়েট্টে বিনোচে ছবিটিতে অভিনয় করেন। এর আগে কিয়ারোস্তামির শিরিন (২০০৮) ছবিতে স্বল্প সময়ের জন্য দেখা গিয়েছিল তাঁকে। ফার্সি ভাষার পাশাপাশি ফরাসি, ইতালীয় ও ইংরেজি ভাষাতেও ছবিটির ডাবিং করা হয়। ভালোবাসা কীভাবে আসল ও নকল হতে পারে, সেটা নিজস্ব ভঙ্গিতে ছবিতে তুলে এনেছেন কিয়ারোস্তামি। একটি দিনের গল্প নিয়ে ছবিটি সাজানো হয়েছে।