ঈদ উৎসবের রূপ-রূপান্তর
ষোলো কোটি মানুষের দেশ বাংলাদেশ। ঈদ নিয়ে এখন নানা ধরনের সাজসাজ রব এবং আয়োজন অনেক বেশি দৃশ্যমান। চাকরি-ব্যবসার সূত্রে লাখ লাখ মানুষ শহরবাসী। ঈদ এলেই যেন সকলে নাড়ির টান অনুভব করেন। ঘর ফেরা মানুষের নানা ঝক্কি রয়েছে। এ জন্য সরকারকেও সতর্ক থাকতে হয়। রাস্তাঘাট সুবিন্যস্ত করার কথা ভাবতে হয়। বাড়তি যানবাহন জোগাড়যন্ত নিয়ে ঘর্মাক্ত হতে হয়। পোশাক ব্যবসায়ীরা ঈদের ছয় মাস আগে থেকেই প্রস্তুতি নিতে থাকেন।
এ দেশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা অনেক বেড়েছে। তাই নানা ধরনের পোশাক কেনার ধুম লেগে যায়। অনেক অবস্থাপন্ন পরিবার ঈদের কেনাকাটা করতে এখন ভারত, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড প্রভৃতি দেশে পাড়ি জমায়। কারো কারো ফ্যাশন হয়েছে দেশের বাইরে ঈদ উদযাপন করার বা নিদেনপক্ষে কুয়াকাটা, কক্সবাজারে। অসাধু ব্যবসায়ীরা রমজান ও ঈদকেন্দ্রিক খাদ্যসামগ্রী নিয়ে নানা কারসাজি করতে থাকে। মূল্যবৃদ্ধি ঘটে প্রায় সবকিছুরই। ঈদকে কেন্দ্র করে প্রতিযোগিতা দিয়ে সংবাদপত্রগুলো ঈদসংখ্যা প্রকাশের বিরাট যজ্ঞে নেমে পড়ে। ইলেকট্রনিক মিডিয়া সাত দিন-দশ দিনব্যাপী নানা অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করতে থাকে। এমনি সব নানা প্রস্তুতিতে ঈদ উৎসব, বিশেষ করে শহরকেন্দ্রিক সমাজে এক ধরনের জটিল রূপ নিয়েছে।
উনিশ শতক থেকে বাঙালির ঈদ উৎসবের যেসব তথ্য পাওয়া যায়, তাতে ঈদ ঘিরে এত সব আয়োজনের সুযোগ ছিল না। সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা খুব সীমিত ছিল। এত আড়ম্বর ছিল না ঠিকই, কিন্তু আনন্দের কমতি ছিল না। ঈদুল ফিতরের সঙ্গে রোজা-কেন্দ্রিকতা ছিল। বড়রা রোজা রাখা, তারাবি পড়া ইত্যাদির মধ্য দিয়ে একটি আবহ তৈরি করতেন। ছোটরা অপেক্ষা করত ঈদের চাঁদের। শহুরে জীবনে ঈদ কিছুটা জাঁকালো হলেও গ্রামীণ জীবনে অনেক বেশি নিরাভরণ হতো। সেখানে ঈদে নতুন পোশাকের ঘনঘটা ছিল না। সামর্থ্য অনুযায়ী সামান্য কেনাকাটা হতো। ছেলেদের জন্য ঈদের নামাজ একটি বড় আকর্ষণ ছিল। সবার সঙ্গে দেখা হওয়া, কোলাকুলি করা একটি অন্য রকম আনন্দের বিষয় ছিল।
ঈদের দিনে সেমাই, পিঠা, খিচুড়ি, মাংস, পোলাও সামর্থ্যভেদে খাওয়ার দিকটি বিশেষ গুরুত্ব পেত। তবে গ্রামগুলোতে ঈদ উপলক্ষে মেলা বসত। এটি ছোটদের জন্য একটি বড় আকর্ষণ ছিল। গত শতকের ষাটের দশকের শেষ ও সত্তরের দশকের শুরুর দিককার ঈদের কথা মনে করতে পারি। ছোটদের মধ্যে ঈদের আনন্দ শুরু হয়ে যেত চাঁদ দেখার পর থেকে। চাঁদ দেখাটা ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। আকাশ মেঘমুক্ত থাকলে খোলা মাঠে বা নদীর তীরে গিয়ে দল বেঁধে চাঁদ দেখা। এটি সওয়াবের কাজও মনে করা হতো। চাঁদ দেখার পর ছোটদের মধ্যে ভিন্ন রকম আনন্দ বয়ে যেত।
আমরা শহরতলির মানুষ। মনে পড়ে চাঁদ দেখার পর ছোটরা একটি আনন্দ মিছিল বের করতাম। একটিই স্লোগান ছিল। বলা হতো, ‘আজকে খুশির দিন কালকে ঈদের দিন’। চাঁদ দেখার পর পরস্পরকে সালাম দেওয়ার রেওয়াজ ছিল। আর বাড়ি ফিরে বড়দের পায়ে ধরে সালাম করার মধ্যে এক ধরনের আনন্দ ছিল।
ষাটের দশকে খুব বেশি সংখ্যক সংবাদপত্র ছিল না। আর যা ছিল তাতে ঘটা করে ঈদসংখ্যা বের করার তত আয়োজন ছিল না। সম্ভবত ঈদসংখ্যা করার রেওয়াজটা প্রথম চোখে পড়ার মতো করে চালু করে মহিলাদের জনপ্রিয় পত্রিকা বেগম। এই ঈদসংখ্যা পড়ার জন্য শিক্ষিত পরিবারগুলোতে বিশেষ আগ্রহ ছিল।
তবে উনিশ শতকে ঢাকায় ঈদ উৎসবে একটি ভিন্ন মাত্রিকতা ছিল। মোগল যুগে ঢাকা সুবা বাংলার রাজধানী হওয়ার কারণে এবং ইংরেজ শাসনকালে ঢাকা গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক কেন্দ্র হওয়ায় এখানে জনবসতি বৃদ্ধি পেতে থাকে। বিদেশিদের মধ্যে উত্তর ভারত ও ইরান থেকে অনেক মুসলমান চাকরি এবং ব্যবসা করার সূত্রে ঢাকায় বসবাস করেছেন এ সময়ে। তাই নানা অঞ্চলের মুসলমানদের সংস্কৃতির মিশ্রণ ঘটে ঢাকার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে। এসব কারণে ঢাকায় ঈদ উৎসব একটি ভিন্ন মাত্রা পায়। মোগল যুগের শেষ অধ্যায়ে, অর্থাৎ নবাবি আমলে নায়েব-নাজিমদের পৃষ্ঠপোষকতা ছিল ঈদ উৎসব আয়োজনে। সবচেয়ে বেশি আনন্দঘন ছিল ঈদুল ফিতরের দিনটি।
ঈদের দিন ঢাকা শহরে ঈদের মিছিল বের করা হতো। ধারণা করা হয়, ঈদ মিছিল আয়োজনের পেছনে হিন্দু সম্প্রদায়ের জন্মাষ্টমী মিছিলের প্রভাব থাকতে পারে। কারণ, অনেককাল আগে থেকে ঢাকা শহরে শ্রীকৃষ্ণের জন্মদিনে জাঁকজমকের সঙ্গে মিছিল বের করা হতো।
নবাবি আমলে ঈদের দিনে নগরবাসীর প্রধান আকর্ষণ ছিল ঈদ মিছিল। নায়েব-নাজিমদের তত্ত্বাবধানে এসব মিছিলে বেশ আড়ম্বর ছিল। উনিশ শতকের প্রথমার্ধে চিত্রশিল্পী আলম মুসাওয়ার ঢাকার ঈদ মিছিলের কয়েকটি ছবি এঁকেছিলেন। এই ছবি থেকেই আড়ম্বরের ধারণা পাওয়া যায়। এ সময় মিছিলে নেতৃত্ব দিতেন নায়েব-নাজিম স্বয়ং। সঙ্গী-সাথিসহ তিনি ঈদ মিছিলে অংশ নিতেন। হাতির পিঠে তৈরি কারুকার্য খচিত হাওদায় বসতেন নায়েব-নাজিম। অন্য অভিজাতরা বসতেন পালকিতে। ছাতা বরদাররা ছাতা হাতে এগিয়ে যেত। এসব ছাতাও হতো রঙিন এবং কারুকার্য করা। এ ছাড়া রঙিন কাপড়ের নিশান নিয়ে হাঁটত একেক দল মানুষ। মিছিলের সামনে বা শেষ দিকে ব্যান্ডপার্টি বাদ্য বাজাত। শত শত দর্শক ভিড় জমাত রাস্তার দুই পাশে। আশপাশের বাড়িঘরের ছাদ ও ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে মানুষ এই মিছিল উপভোগ করত।
বিশ শতকে ইংরেজ শাসন যুগেও ঢাকা শহরে ঈদ উৎসবে ভাটা পড়েনি। এ সময় ঈদ উৎসবের প্রধান আয়োজক ছিলেন ঢাকার নবাবরা। তখন বাণিজ্য ও চাকরির সূত্রে অনেক ধনী অভিজাত শ্রেণির মানুষের বাস ছিল ঢাকায়। নানা অঞ্চলের জমিদারদের অনেকে ঢাকা নগরীতে বাগানবাড়ী কিনে বসবাস করতেন। সাধারণ মানুষের ভাষায় এরা ছিলেন ‘বাবু’। এই বাবুরা তাঁদের যাপিত জীবনে যে সংস্কৃতি ধারণ করতেন, তা ‘বাবু সংস্কৃতি’ নামে পরিচিত ছিল। বাবুরা ঈদ উৎসবে বাড়তি কিছু আয়োজন যুক্ত করেছিলেন। যে কারণে বাংলার আটপৌরে ঈদ উৎসবের চেয়ে ঢাকার ঈদ উৎসব ভিন্ন মাত্রা পেয়ে যায়।
বিশ শতকের প্রথমার্ধে ঈদের দিনে রমনা, আরমানিটোলাসহ ঢাকার বড় বড় মাঠে মঞ্চ বানানো হতো। এসব মঞ্চে আয়োজিত হতো কত্থক নাচের। শহর ও শহরতলি থেকে অনেক মানুষ এসে এসব অনুষ্ঠান উপভোগ করত। এ ছাড়া ঈদ উপলক্ষে ঢাকায় আয়োজিত হতো নৌকাবাইচ ও ঘুড়ি ওড়ানো প্রতিযোগিতা। এসব আয়োজনে সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিল। তবে বাবুদের তত্ত্বাবধানে ঈদের দিন দুটো অনুষ্ঠানের আয়োজন হতো ঢাকায়। এর একটি হিজরা নাচ আর অন্যটি ঘোড়দৌড়। হিজড়া নাচের আয়োজন তখন আভিজাত্যের প্রতীক ছিল। এ কারণে ঈদ এগিয়ে এলে হিজড়া সম্প্রদায়ের মানুষের কদর বেড়ে যেত। যার যার মহল্লায় বাবুরা হিজড়া নাচের আয়োজন করতেন। তাই আগেভাগেই এক এক হিজড়া গ্রুপকে বায়না করা হতো। একইভাবে রমনার রেসকোর্স ময়দানে (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ঘোড়দৌড়ের আয়োজন হতো। ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতায় বাবুরা অংশগ্রহণ করতেন।
বিশ শতকের প্রথম দিকে ঢাকায় সিনেমা হল প্রতিষ্ঠিত হয়। সম্ভবত ১৯১৯ থেকে ১৯২২ সালে আরমানিটোলায় প্রতিষ্ঠিত ‘পিকচার প্যালেস’ হলটি ছিল ঢাকার প্রথম সিনেমা হল। পরে যার নাম হয় ‘শাবিস্তান’। ঈদের দিনে নগরবাসীর কাছে অন্যতম প্রধান আকর্ষণ ছিল সিনেমা হলে ‘ফুল সিরিয়াল’ দেখা। এতে এক টিকেটে রাতভর সিনেমা দেখার সুযোগ ছিল।
এমনি নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে আঠারো, উনিশ ও বিশ শতকে ঢাকাবাসী ঈদ উদযাপন করত আর গ্রামগুলোতে এক ধরনের ছকে বাঁধা হলেও ঈদ উৎসব একটি আনন্দময় পরিবেশের সৃষ্টি করতো।