জাকির তালুকদারের গল্প
অলৌকিক বেদনার ভার
ছেলেটার পেটের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠছে কিছুক্ষণ পরপর। টক লালায় মুখ ভরে উঠছে বারবার। সকাল ৮টায় চাউলপট্টিতে এসেছে সে। না খেয়েই এসেছে। মা বলেছিল- চট করে চালটা এনে তারপরে খেয়ে স্কুলে চলে যাস!
স্কুলের কথায় মনে পড়ে, সকালে পড়তে বসা হয়নি। মোহন স্যারের দেওয়া হোমটাস্কের অঙ্কগুলো করা হয়নি। শাজাহান স্যার একপাতা বাংলা হাতের লেখা চান রোজ। সেটা করা হয়নি। আজমল স্যার ইংরেজি হাতের লেখা না নিয়ে গেলে খুব খারাপ ভাষায় গালাগালি করেন। অথচ আজ সেটাও লেখা হয়নি। তখন মনে পড়ে যে ইংরেজি হাতের লেখার খাতাও নাই। গতকাল স্কুল থেকে এসেই আব্বাকে খাতা কেনার কথা বলেছিল সে। আব্বা বলেছিল- আচ্ছা।
মা একটু বিরক্তির সাথে বলেছিল- এই মাসের শেষে এসে খাতা ফুরায় ক্যান?
এই প্রশ্নের কোনো উত্তর হয়?
চালের ব্যাগ আর আব্বার দেওয়া হাতচিঠি নিয়ে বসে আছে সে সকাল ৮টা থেকে। ধারণা ছিল চাল নিয়ে একঘণ্টার মধ্যেই ফিরতে পারবে। কিন্তু রাজ্জাক চাচার দেখা নেই। তার ফরমাশ-খাটা ছেলেটা দোকান চালাচ্ছে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেটাই দেখতে থাকে সে। পকেটে আব্বার দেওয়া হাতচিঠি। হাতে চটের ব্যাগ।
চাউলপট্টি এখনো ততটা সরগরম হয়ে ওঠেনি। আলাদা আলাদা সীমানা আছে, কিন্তু কোনো দোকানের জন্য আলাদা কোনো দেয়াল নেই। লম্বা সারি। গুনতে থাকে সে। সারির সংখ্যা উনিশ। আবার একেক সারিতে গড়ে ১৫টা দোকান। প্রত্যেক দোকানদার বসে একটা চটের আসনে। সেই আসনের নিচেই রাখে টাকা। সামনে সুন্দরভাবে সাজানো চালের বস্তা। কোনোটাতে ইরি আটাত্তর, পারি, আউশ, পাইজাম। বস্তার মাথায় চূড়া করে রাখা চাল। গ্রামের বাড়ির সামনে পোয়ালের পালার মতো। সুচারু হাতে চূড়া করে রাখা চাল। দোকান সাজানো শুরু হয়েছে সে আসার পর থেকেই। সাজানোর পরে প্রায় সবাই একটা বা দুইটা আগরকাঠি জ্বেলে গুঁজে দিয়েছে যেকোনো একটা চালের চূড়ার মধ্যে। পুরো চাউলপট্টিতে আগরবাতির পবিত্র একটা সৌরভ। সে সৌরভ থেকে মনোযোগ সরিয়ে আনে। কারণ গন্ধে পেটের মধ্যে খিধের মোচড় আরো বেড়ে যাচ্ছে। তার বদলে সে চালের চেহারা দেখতে থাকে। পাইজাম চালগুলো দেখতে কী যে সুন্দর! বড়লোকেরা খায়। আজ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পাইজামের সৌন্দর্য দেখতে থাকে সে। তাদের কৃষিবিজ্ঞান বইয়ের সাথে চালের নামের মিল খুঁজে পায় না। বইতে আছে, বাংলাদেশে চাউল উৎপন্ন হয় তিন ধরনের। আউশ, আমন ও বোরো। কিন্তু এখানে দেখা যাচ্ছে চালগুলোর নাম ভিন্ন। বড়লোকদের জন্য পাইজাম, নাজিরশাইল, ঝিঙেশাইল, কাটারিভোগ। আর গরিব মানুষরা সবাই কিনে ইরি। নানা নামের ইরি। নামগুলো সব নম্বর দিয়ে।
ইরি সম্পর্কে কিছুটা শেখানো হয়েছে তাদের ক্লাসে। ইরি ইংরেজি শব্দ। আই আর আর আই। ইন্টারন্যাশনাল রাইস রিসার্চ ইনস্টিটিউট। ওরা এই চাল বানিয়ে পাঠিয়েছে দেশে দেশে। ফলন খুব বেশি। এখন এক বিঘাতে পাওয়া যায় ৩০ মণ পর্যন্ত। সিংড়ার চলনবিল অঞ্চলের মানুষের এখন ইরির গরমে মাটিতে পা পড়ে না। ইরি বিক্রির মৌসুমে বগুড়া রোডে গাড়ি চলাচলই মুশকিল হয়ে উঠেছে। রাস্তায় রাস্তায় ইরিচাল-ইরিধানের হাট। বিল অঞ্চলের মানুষ ইরিধানের মৌসুমে টাউনে আসে। দোকানদারকে গরমও দেখায়। দরদাম নিয়ে কোনো দোকানদার একটু কটাক্ষ করলে বিলের জোতদার চোখ রাঙিয়ে বলে- তোমার পুরো দোকানের দাম কত?
ভঙ্গিটা এমন যে সে দোকানটাই কিনে নিতে পারে যখন-তখন।
৯টা বেজে যায়। রাজ্জাক চাচা আসেনি। আব্বার দেওয়া হাতচিঠিটা আবার বের করে পড়তে থাকে সে। আসলে পড়ার কোনো দরকার নেই। কারণ আব্বা মুখে বলেছে, আর সে নিজেই লিখেছে চিঠিটা। তবু সে পড়ে-
‘প্রিয় রাজ্জাক ভাই,
আসসালামু আলাইকুম!
পর সমাচার এই যে, আমার বড় ছেলেকে পাঠাইলাম। তাহাকে পাঁচ সের চাউল দিয়া বাধিত করিবেন। এখন মাসের শেষ। তাই টাকা দিতে পারিলাম না। খোদা চাহে তো সামনের মাসের পহেলা বা দোসরা তারিখের মধ্যেই আমি আপনার পাওনা পরিশোধ করিব।
আরজ গুজার
সালেক মিয়া
তাং- ইং ২২/৮/১৯৭৮
নিজের হাতে লেখা চিঠি নিজেই সে মনোযোগ দিয়ে পড়ে বার বার। কোনো বানান ভুল আছে কি না পরীক্ষা করে। আরো বিনয়ের সাথে লেখা উচিত ছিল কি না ভাবে।
রাজ্জাক চাচাকে আসতে দেখা যায়। চালের খুচরা ব্যবসায়ী হলেও মানুষটার আচরণের মধ্যে এক ধরনের আভিজাত্য আছে। সাদা পাঞ্জাবি থাকে গায়ে। সুন্দর লুঙ্গি। এসব দোকান যারা চালায় তাদের জামাকাপড় সবসময় ময়লা না হলেও আধাময়লাই থাকে। রাজ্জাক চাচা ব্যতিক্রম।
রাজ্জাক চাচাকে চালের গদিতে বসার সময়টুকু দেয় সে। তারপর কাছে এগিয়ে যায়। সে তাকে একবার দেখেই চোখ ঘুরিয়ে নেয়। আয়েশ করে বসে কাজের ছেলেটাকে বলে বিজনের দোকান থেকে এককাপ চা নিয়ে আসতে।
ছেলেটি এবার পকেট থেকে চিঠিটা বের করে। এগিয়ে দেয়। চিঠি দেখেই ভুঁরু কুঁচকে ওঠে তার। হাত বাড়িয়ে নেওয়ার তেমন আগ্রহ দেখা যায় না। অভিজ্ঞতা থেকে রাজ্জাক চাচারা বোঝে যে এই রকম হাতচিঠি মানেই বাকিতে চাল দেওয়ার অনুরোধ। হাত বাড়িয়ে চিঠিটা নেয় বটে। কিন্তু সেটা খুলে পড়ার কোনো আগ্রহ দেখা যায় না তার মধ্যে।
সে আরো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে চুপচাপ। তারপর খুব কুণ্ঠার সাথে বলে- চাচা আব্বা চিঠিটা পাঠাইছে।
রাজ্জাক চাচা তার মুখের দিকে তাকায় কি তাকায় না বোঝা যায় না। বামহাত দিয়ে চিঠিটা বাড়িয়ে ধরে তার দিকে। পড়তে চায় না। চিঠিতে কী লেখা আছে তা সে জানে।
সে হাত বাড়িয়ে চিঠিটা নেয়। বুঝতে পারে যে সে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। তবু কুণ্ঠায় মাটির সাথে মিশে যেতে যেতে আরেকবার প্রায় বুঁজে যাওয়া কণ্ঠে বলে- চাচা, পাঁচ সের চালের কথা বলিছে আব্বা...
নিদারুণ বিরক্তি চেপে রাখতে যেন কষ্ট হচ্ছে, এই রকম ভঙ্গিতে রাজ্জাক চাচা বলে- তোর বাপ গেল মাসের বাকি টাকাই তো এখনো শোধ করেনি।
আর কথা বলার মতো অবস্থা তার নেই। তবু বলে- মাসের শেষ তো!
মাসের শেষ তো আমারও। আমার তো সকাল বেলা রাইসমিলের মহাজনের হাতে টাকা দিয়া মাল আনতে হয়। কয়জনারে আমি বাকি দিতে পারি?
তাহলে?
চাল সে দেবে না এ কথা মুখে উচ্চারণ করে না। তার আভিজাত্যে বাধে। সে চিঠি আর ব্যাগহাতে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটির দিকে একবারও তাকায় না। যা বলার বলে দিয়েছে। ছেলেটাও বুঝতে পেরেছে। ছেলেটাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করার জন্য সে চা আসার আগেই পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে।
অপমানে কালো হওয়া মুখ আর খালি ব্যাগ নিয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে সে ভাবে, পুরো বর্ণনা শুনলে আব্বার মুখ কতখানি কালো হবে! নিজেকে নিয়ে তখন ভাবছে না সে। ভাবছে আব্বার অপমানিত মুখটাকে ঢেকে দেওয়ার কোনো উপায় যদি সে জানত!
বাড়ির পথ ধরার সময় হঠাৎ-ই মনে পড়ে, সকাল থেকে বাড়ির কারোই পেটে কিছু পড়েনি। আব্বা বেরিয়ে গেছে সকালে একগ্লাস পানি খেয়ে। নিজের পেটের মোচড় থেকে বুঝতে পারে শানুর কত কষ্ট হচ্ছে। ল্যাগবেগে দুর্বল শীর্ণ বোনটা আমার! দুই মাস ধরে জন্ডিসে ভুগে ভুগে কেবল সেরে এসেছে। এই দুই মাস রোজ সকালে তাকে যেতে হতো অড়লের(অড়হর) পাতা আনতে। সেই পাতা ছেঁচে রস করে দিত দাদি। এই অড়লের পাতার রসই ছিল শানুর একমাত্র চিকিৎসা। পুরনো খাতা সেরদরে বেচে এক পোয়া মিছরি কিনতে পেরেছিল সে। কী আনন্দের সাথে সেই মিছরি যে খেত শানু! এখন জন্ডিস থেকে সেরে ওঠার পর খালি খাই খাই করে বোনটা। সে পরিষ্কার দেখতে পায় খিধের কষ্টে কাঁদছে শানু। খুব দুর্বল। গলায় জোর নেই। কান্নার সময় যতটা হা হয়ে যায় মুখ, ততটা শব্দ বের হয় না। চিৎকার নয়, ফ্যাঁস ফ্যাঁস শব্দ বের হয়। বেশিক্ষণ এভাবে কাঁদলে খিঁচুনি শুরু হয়। বোনের কথা ভেবে এবার বুকটাও মোচড়াতে থাকে তার। চোখটা জ্বালা করে ওঠে। সামনের রাস্তা ঝাপসা হয়ে উঠতে চায়।
তখন রাস্তা পরিবর্তন করে সে। বশির ভাইয়ের কাছে যাবে। পচু মিয়ার মিষ্টির দোকানে কাজ করে বশির ভাই। তার কাছে গেলে অন্তত শানুর এই বেলার খাওয়ার মতো কিছু পাওয়া যাবে।
জ্যৈষ্ঠ মাসের রোদ এই সকালেই বাঘের মতো হামলে পড়েছে। রাস্তার দুইপাশে পশরা বিছিয়ে বসা লোকগুলোর চোখে-মুখে সহ্যহীনতার ছাপ। তালা-চাবি সারাইয়ের দোকান, মেয়েদের চুড়ি-দুল-ফিতের দোকান, মাথার ওপর ছেঁড়া ছাতা ফুটিয়ে বসা মুচির দোকান, গাঁ থেকে মাথায় ঝুড়িতে বয়ে নিয়ে আসা কদবেল-সফেদার দোকান পেরিয়ে আসতেই তার নাকে ঝাপটা দেয় পরোটা ভাজার গন্ধ। বীরেশ্বরের দোকানের সামনে চুলায় বিরাট কড়াইতে পরোটা ভাজা হচ্ছে। আহ! বীরেশ্বরের দোকানের পরোটা-বুটের ডাল আর বুন্দিয়ার নাম গোটা টাউনজুড়ে। বাড়ির বউ-ঝিরা পর্যন্ত বছরে একবার হলেও খেতে চায় এই জিনিস।
পরোটার গন্ধে একটু থমকে যায় পা তার অজান্তেই। অনিবার্যভাবেই চোখ যায় ভেতরে চেয়ার- টেবিলে বসে আয়েশ করে নাস্তা-খাওয়া মানুষদের দিকে। তখনই চোখে পড়ে আব্বাকে।
আব্বা! হ্যাঁ আব্বাই তো!
একটা পা চেয়ারের ওপর তুলে দিয়ে খুব মনোযোগের সাথে পরোটা চিবাচ্ছে। তার সারা শরীর ঝিম ঝিম করে ওঠে। এ কীভাবে সম্ভব!
আবার ভালো করে তাকায়। হ্যাঁ আব্বাই তো!
মনের ভেতর তখন আরেকটা সতর্কবাণী বেজে ওঠে। সে যে আব্বাকে দেখতে পেয়েছে, আব্বা যেন সেটা টের না পায়!