ঢাকার কথা ৪৩
লালকুঠির কথা
পুরান ঢাকায় ওয়াইজ ঘাট এলাকায় বুড়িগঙ্গার তীরে লালরঙা একটি সুদৃশ্য ইমারত রয়েছে। এখন বাহাদুর শাহ পার্কের পাশ দিয়ে নর্থব্রুক রোড ধরে সূত্রাপুরের দিকে এগিয়ে গেলে শ্যামবাজার পার হতেই রাস্তার পাশে হাতের ডান দিকে এই প্রত্ন ইমারতটি বর্তমানে ব্যবহারযোগ্য অবস্থায় দেখা যাবে। ঔপনিবেশিক যুগে মোগল ও ইউরোপীয় স্থাপত্য রীতির সমন্বয়ে দৃষ্টি নন্দন ইমারতটি নির্মিত হয়েছিল। ইংরেজ সাহেবদের ব্যবহারের জন্য দেশের নানা অঞ্চলে ছোট ছোট ইমারত তৈরি হয়। সাধারণ মানুষের মুখে তা কুঠিবাড়ী নামে পরিচিত। ঢাকার এই ইমারতটি নির্মাণের বিশেষ উদ্দেশ্য ছিল। এটি মিলনায়তন হিসেবে ব্যবহারের জন্য প্রধানত নির্মিত হয়।
দেয়ালের রং লাল হওয়ায় সাধারণ মানুষের মুখে মুখে তা লালকুঠি নামে পরিচিতি পেয়ে যায়। অবশ্য এর একটি সরকারি নামও আছে। সরকারি নথিতে এর নাম নর্থব্রুক হল। যে কারণে সড়কটির নামও হয়েছে নর্থব্রুক হল রোড। লর্ড নর্থব্রুক উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ্বে ভারতের গভর্নর জেনারেল ও ভাইসরয় হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর নামেই এই হলের নামকরণ করা হয়।
লালকুঠি প্রথম নগর মিলনায়তন হিসেবে যাত্রা শুরু করলেও পরে তার কার্যপরিধি সম্প্রসারিত হয়। একসময় লালকুঠি হয়ে যায় ঢাকার সাধারণ মানুষের জন্য উন্মুক্ত একটি গণগ্রন্থাগার। একপর্যায়ে একটি ক্লাবঘরও এর সাথে যুক্ত হয়। ক্লাবটির নাম দেওয়া হয় জনসন হল। ইংরেজ শাসন আমলে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে লালকুঠিতে। এরমধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দুবার ঢাকায় আগমন ও অবস্থানকালে এখানে তিনি বক্তৃতা করেছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৯৮ সালের মে মাসের শেষ লগ্নে প্রথম ঢাকায় আসেন। ঢাকায় অনুষ্ঠিত বঙ্গীয় প্রাদেশিক সমিতির সভায় যোগ দেওয়া ছিল তাঁর ঢাকা আগমনের উদ্দেশ্য। ১ জুন লালকুঠিতে তাঁর সম্মানে একটি ‘ইভিনিং পার্টি’র আয়োজন করা হয়। এই অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথ স্বকণ্ঠে গান গেয়ে শোনান।
রবীন্দ্রনাথ দ্বিতীয়বার ঢাকায় আসেন ১৯২৬ সালে। এবার তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দুটো বক্তৃতা দেওয়ার অনুরোধে এসেছিলেন। এ পর্বে কবি বেশ কয়েকদিন ঢাকায় অবস্থান করেন। ৭ ফেব্রুয়ারি বিকেলে ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটির পক্ষ থেকে লালকুঠিতে কবিকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়।
স্থাপত্যকলার নান্দনিকতা বিচারে লালকুঠি ঢাকায় তৈরি ঔপনিবেশিক ইমারতের মধ্যে বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। নির্মাণ শৈলীর দিক থেকে ইউরোপীয় রীতির সাথে মোগল রীতির এক অনুপম সম্মিলন লক্ষ করা যায়। খিলান ও সুউচ্চ চূড়া মুসলিম স্থাপত্য রীতিকে ধারণ করছে। অর্ধবৃত্তাকার খিলানে রয়েছে অশ্বক্ষুরাকৃতির খাঁজকাটা। লালকুঠিতে প্রবেশের জন্য উত্তর দিকে আছে বিশাল ফটক। ইমারতের চারকোণে রয়েছে চারটি মিনার। এগুলো অষ্টভুজাকৃতির। সীমানা প্রাচীর অপেক্ষাকৃত নিচু। তাই বাইরে থেকে ইমারতটি স্পষ্টতই দৃষ্টিগোচর হয়। প্রাচীরে আলঙ্কারিক নকশা কাটা আছে। ইমারতের মাঝ ছাদে রয়েছে একধাপ বিশিষ্ট বিশাল আকারের গম্বুজ।
এ যুগে ঢাকার জনসংখ্যা বৃদ্ধি, বাণিজ্য সম্প্রসারণ, জমিজমার মূল্য বৃদ্ধি, ঐতিহ্য সচেতনতার অভাব এবং রাষ্ট্রীয় নীতি নির্ধারণের দুর্বলতা অনেক প্রত্ন ইমারতকে ধ্বংস বা ধ্বংসোন্মুখ করে তুলেছে। সে তুলনায় লালকুঠির স্থাপত্যিক অবয়ব ধরে রাখতে পারলেও নান্দনিকতা অনেকটা হারিয়েছে। বর্তমানে চারদিকে কমিউনিটি সেন্টারসহ নানা আধুনিক ইমারত লালকুঠিকে অনেকটা ঘিরে ফেলেছে।