বানান বিতর্ক
বাংলা বানানের যম ও নিয়ম (শেষ পর্ব)
বাংলা ও সংস্কৃত
‘খাঁটি গরুর দুধ’ যদি অশুদ্ধ হত আর আমাদের লিখতে হত ‘গরুর খাঁটি দুধ’, তা হলে ‘দুটি পাকা আম’ অশুদ্ধ হত, আমাদের লিখতে হত ‘পাকা দুটি আম’, গোটা ভাষাটা আমাদের বরবাদ হতে বসত।
—হোসাইন রিদওয়ান আলী খান (‘বাংলা শব্দ বর্ণ বানান,’ পৃ. ৪৭ )
‘বাংলা ভাষার প্রয়োগ ও অপপ্রয়োগ’ পুঁথির লেখকগণ বার বার বলিয়াছেন বাংলায় বহুল প্রচলিত ‘ইতিপূর্বে’ অথবা ‘ইতিমধ্যে’ শব্দ দুইটি অশুদ্ধ। কারণ শব্দ দুইটি সংস্কৃত ব্যাকরণসম্মত নহে। শব্দ দুইটিকে তৎসম না ধরিয়া তদ্ভব ধরিলেও তো একটা যুক্তি পাওয়া যাইতেছে। তাঁহারা সেই যুক্তি শুনিবেন না।
বাংলা একাডেমীর লেখক-পঞ্চায়েত এক জায়গায় লিখিয়াছেন, “সমাসবদ্ধ পদে কোন কোন ক্ষেত্রে ‘ক’ ‘খ’ ‘প’ ‘ফ’ পরে থাকলেও অ-আ-ই-উ স্বরের পরবর্তী বিসর্গ অবিকৃত থাকে। যেমন— মনঃকষ্ট, অন্তঃকরণ, অন্তঃপুর, অতঃপর, মনঃপূত, পয়ঃপ্রণালী, বয়ঃপ্রাপ্তি, দুঃখ, ইতঃপূর্বে।” ‘ইতঃপূর্বে’ লেখার সঙ্গে সঙ্গে বন্ধনীযোগে জানাইয়া দেওয়া হইল “বাংলায় বহুল প্রচলিত অশুদ্ধরূপ ‘ইতিপূর্বে’”। (পৃ. ১৯)
আরেক জায়গায় বলা হইতেছে, ‘বর্গের তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম বর্ণ কিংবা স, র, ল, ব, হ পরে থাকলে অ-কারের পরস্থিত বিসর্গ পূর্বস্থিত অ-কারের সঙ্গে মিলিত হয়ে ও-কারে পরিণত হয়। যেমন— মনোগত (মনঃ+গত), মনোমোহন (মনঃ+মোহন), অধোমুখ (অধঃ+মুখ), সদ্যোজাত (সদ্যঃ+জাত), সরোবর (সরঃ+বর), মনোজ (মনঃ+জ), বয়োবৃদ্ধি (বয়ঃ+বৃদ্ধি), ইতোমধ্যে (ইতঃ+মধ্যে) ইত্যাদি।’ (পৃ. ২০)
পঞ্চায়েতের সিদ্ধান্ত আবার এক জায়গায় পাশাপাশি দেখানো হইয়াছে। তাঁহারা বলিতেছেন ‘ইতিপূর্বে’ আর ‘ইতিমধ্যে’ অশুদ্ধ হইলেও প্রচলিত। কিন্তু তাঁহারা অশুদ্ধ শব্দ কেন প্রচলিত তাহা একবারও জিজ্ঞাসা করিলেন না। করিলে তাঁহারা যাহাকে বলে ‘বাংলা ভাষার স্বভাব’ তাহার মুখোমুখি হইতেন। তাহা না করিয়া পঞ্চায়েত লিখিয়া দিলেন শব্দ দুইটির শুদ্ধ বানান যথাক্রমে: ‘ইতঃপূর্বে’ এবং ‘ইতোমধ্যে’। (পৃ. ৬০)
আশ্চর্য হইলাম (ইঁহারা অবশ্য বলিবেন ‘আশ্চর্যান্বিত’ হইলাম, পৃ. ৩৫) যখন দেখিলাম পঞ্চায়েতের পণ্ডিতগণ ভূমিকায় কবুল করিতেছেন, এমন কি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও অনেক দিন হয় কবুল করিয়াছেন ‘ইতিমধ্যে’ শব্দটাই বাংলায় চলিতেছে। তাই উহা শুদ্ধ। শুদ্ধ শব্দ চলিতেও পারে, নাও চলিতে পারে। তবে যাহা মহামারী আকারে চলে তাহাই তো শব্দের শুদ্ধ রূপ। ইহা ধরিয়া লওয়া ছাড়া গত্যন্তর নাই। এই পণ্ডিতদিগকে সেই কথা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও বুঝাইতে পারিলেন না দেখিয়া আপশোস্ হয়।
রবীন্দ্রনাথ ১৯৩৭ সাল নাগাদ লিখিতেছেন, “অনেক পণ্ডিত ‘ইতিমধ্যে’ কথাটা চালিয়ে এসেছেন, ‘ইতোমধ্যে’ কথাটার ওকালতি উপলক্ষে আইনের বই ঘাঁটবার প্রয়োজন দেখি নে— অর্থাৎ এখন ওই ‘ইতিমধ্যে’ শব্দটার ব্যবহার সম্বন্ধে দায়িত্ব-বিচারের দিন আমাদের হাত থেকে চলে গেছে।” (বাংলা শব্দতত্ত্ব, পৃ. ২৭৬) ১৯৮৮ সালে আসিয়া আবার ‘ইতোমধ্যে’ শব্দটার ওকালতি করিবার প্রয়োজন কেন দেখা দিয়াছে— নৃবিজ্ঞানশাস্ত্র যাঁহাদের ব্যবসায় বা অধ্যবসায় তাঁহারা এই সওয়ালের জওয়াব একদিন খুঁজিবেন।
বাংলা একাডেমী পঞ্চায়েত এক জায়গায় রবীন্দ্রনাথের দোহাই দিয়াছেন। (পৃ. ১০-১১) আবার আর জায়গায় পৌঁছিয়া তাহা ভুলিয়াছেনও। (পৃ. ৩৫, ৮৩) তাঁহারা পত্রিকার পাতা হইতে একটি বাক্য উদ্ধার করিয়াছেন: ‘রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ইতিমধ্যেই কৃষিঋণ পরিশোধের সময়সীমা বর্ধিত করেছেন।’ (পৃ. ৮৩ মোটা হরফ আমাদের) বলা হইয়াছে ইহার শুদ্ধ রূপ হইবে ‘ইতোমধ্যে’।
এক সময় ‘সৃজন’ শব্দটি অশুদ্ধ এই আওয়াজও উঠিয়াছিল। সেই কোলাহলের স্মৃতি টানিয়া রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর টিপ্পনী কাটিতেছেন, “শুনেছি ‘সৃজন’ শব্দটা ব্যাকরণের বিধি অতিক্রম করেছে, কিন্তু যখন বিদ্যাসাগরের মতো পণ্ডিত কথাটা চালিয়েছেন তখন দায় তারই, আমার কোনো ভাবনা নেই।” (বাংলা শব্দতত্ত্ব, পৃ. ২৭৬) অথচ বশীর আল্হেলালের ‘অধিনায়ক’ ডাক্তার মুহম্মদ এনামুল হকও বলিতেছেন শব্দটি অশুদ্ধ। (বাংলা ভাষার বানান বিবেচনা, পৃ. ১৩)
বাংলা একাডেমী দাবি করিয়া থাকেন তাঁহারা ‘ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ের জাতীয় প্রতিষ্ঠান’। যদি এই দাবি সত্য হইত তবে কি ইহার ঠাঁই প্রাতিষ্ঠানিক দিক হইতে আরও মর্যাদাপূর্ণ হইত না? সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি বিরাজমান দপ্তর আকারে ইহা চলিতেছে। কাজেই আত্মপ্রসাদের অবসর নাই। ‘বাংলা ভাষার প্রয়োগ ও অপ্রয়োগ’জাতীয় পুঁথি প্রকাশ করিতে থাকিলে সেই মর্যাদা রেশম ও তুঁত বোর্ডের সমান হইয়া উঠিবে, সন্দেহ নাই। রেশম ও তুঁতের প্রতি কোন অসম্মান প্রদর্শন আমার সজ্ঞান বিধানে নাই। অজ্ঞানে হইলে নিঃশর্ত ক্ষমা চাহিতে বাধ্য থাকিব।
পাঁচ পণ্ডিত লিখিয়াছেন, ‘অর্থনৈতিক’, ‘রাজনৈতিক’ এবং ‘সমসাময়িক’ এবং ‘প্রশাসনিক’ প্রভৃতি বহুল প্রচলিত শব্দ ‘অসিদ্ধ’। (পৃ. ২৯) এস্থলে তাঁহারা ‘অশুদ্ধ’র বদলা ‘অসিদ্ধ’ ব্যবহার করিয়া আমাদের কারণ হইয়াছেন। তাঁহারা সঙ্গে সঙ্গে আইনের বইও ঘাঁটিয়াছেন। বলিয়াছেন, ‘ইক্ প্রত্যয়ান্ত শব্দে দ্বিতীয় স্বরের বৃদ্ধি হয় না, আদি স্বরের বৃদ্ধি হয়। তাই এ-শব্দগুলির শুদ্ধরূপ হবে আর্থনীতিক, রাজনীতিক, সামসময়িক, প্রাশাসনিক ইত্যাদি।’
এই আলিশান পণ্ডিতেরা সকল জ্ঞানের অধিকারী, শুদ্ধ কাণ্ডজ্ঞানটাই তাঁহারা অধিকার করিতে পারেন নাই। তাঁহারা খেয়াল করেন নাই কোন শব্দ কোন নিয়মে গড়িয়া উঠিয়াছে। সংস্কৃত ব্যাকরণের নিয়ম অনুকরণ করিয়া বাংলায় বিশেষণ পদ গঠিতে ‘ক’ অথবা ‘ইক’ প্রত্যয় যোগ করা চলে। ইহার ফলে সাধারণভাবে মূল শব্দের প্রথম স্বর বাড়িয়া যায়। ইহাকে গুণ বা বৃদ্ধি বলে। এই নিয়মে ‘সংবাদ’ হইতে ‘সাংবাদিক’ শব্দ তৈরি হইয়াছে। ‘শরীর’ হইতে ‘শারীরিক’, ‘প্রদেশ’ হইতে ‘প্রাদেশিক’ এবং ‘সময়’ হইতে ‘সাময়িক’।
পণ্ডিতেরা জানেন প্রথম স্বর যদি আগে হইতেই বাড়িয়া থাকে তবে তাহার আর বাড়িবার জায়গা হইবে না। তাহার অবস্থা যেমন ছিল তেমনই থাকিবে। যেমন— ‘মানব’ হইতে ‘মানবিক’, ‘দানব’ হইতে ‘দানবিক’, ‘মাস’ হইতে ‘মাসিক’। একই নিয়মে হইতে পারে ‘শাসন’ হইতে ‘শাসনিক’। তবে ইহার আলাদা ব্যবহার নাই।
ইহাতে কি প্রমাণ হয়? প্রমাণ হয় পণ্ডিতেরা নিয়ম জানেন, নিয়মের অতিক্রম (বা যমও) জানেন। কিন্তু নিয়মেরও যে নিয়ম আছে তাহা জানেন না। ‘সময়’ হইতে ‘সাময়িক’ হইয়াছে। নিয়মেই সিদ্ধ হইয়াছে ইহা। ‘সম’ উপসর্গটি আসিয়া বসিয়াছে এই রূপান্তরের পরে। তাই ‘সম-সাময়িক’ হইয়াছে। অথচ পণ্ডিতেরা ভাবিয়াছেন অন্য। তাঁহাদের ভ্রম হইয়াছে আগে শব্দটা গঠিয়া বুঝি ‘সম-সময়’ হইয়াছিল। আসলে তাহা হয় নাইক্কা। বাংলা ভাষার স্বভাব তাঁহারা বুঝিবার চেষ্টা করেন নাই।
একই নিয়ম ‘প্রশাসনিক’ শব্দের ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করিতে পারেন। ‘শাসন’ হইতে ‘শাসনিক’ গঠিবার পর ‘প্র’ উপসর্গ আসিয়া বসিয়াছে। একই কথা ‘রাজনৈতিক,’ ‘অর্থনৈতিক’ প্রভৃতি শব্দের বেলায়ও খাটে। ‘নীতি’ হইতে বৃদ্ধির নিয়মে ‘নৈতিক’, যেমন ‘চীন’ হইতে ‘চৈনিক’ বা ‘ঈশ্বর’ হইতে ‘ঐশ্বরিক’। ‘রাজ’ ও ‘অর্থ’ প্রভৃতি উপসর্গতুল্য শব্দ আগে বসিয়া নতুন শব্দ গঠিয়াছে।
কিন্তু ‘উপন্যাস’ বা ‘উপনিবেশ’ শব্দের গঠন হইয়াছে অব্যয়ীভাবের নিয়মে। ‘ন্যাসের কাছাকাছি’ তাই উপন্যাস। ‘নিবেশের ছোট’ তাই উপনিবেশ। ইহাদের গুণ বা বৃদ্ধির নিয়মে ‘ঔপন্যাসিক’ বা ‘ঔপনিবেশিক’ শব্দ গঠিত হয়। বাংলা একাডেমী ঘুঘু দেখিয়াছে। (পৃ. ২৯)
তাঁহাদিগকে ফাঁদ দেখাইবার কেহ নাই। তাই তাঁহারা একই মুখে দুই কথা বলিতেও দ্বিধা করেন নাই। এক জায়গায় তাঁহারা দেখিয়াছেন কোন কোন ক্ষেত্রে আদি শব্দের মূল হিসাবে দুই পদ থাকে। থাকিলে তাহাদের মিলনে নতুন নতুন শব্দ হয়। এই শ্রেণীর শব্দে ‘ইক’ প্রত্যয় যোগ করিবার সময় আদি শব্দের উভয় পদেই স্বর-বৃদ্ধি ঘটে। যেমন— ‘পরলোক’ হইতে হয় ‘পারলৌকিক,’ ‘অধিদেব’ হইতে ‘আধিদৈবিক,’ এবং ‘অধিভূত’ হইতে ‘আধিভৌতিক’। ইহার সম্ভাবনা লুকাইয়া আছে ‘পর’ ও ‘অধি’ এই উপসর্গ দুইটির গঠনে। ‘পর’ শব্দের প্রথম স্বরে ‘অ’ ধ্বনি পাওয়া যায় তাই তাহা বাড়িয়া ‘আ’ হইতে পারে। একই কথা ‘অধি’ শব্দেও খাটে।
কিন্তু পণ্ডিতেরা ঠাহর করিবার সময় পাইলেন না প্রশাসন শব্দের ‘প্র’ উপসর্গের গঠনে ‘প’ স্বরের শেষে ‘অ’ নাই, ‘প’ সেখানে ‘র’য়ের সহিত একাঙ্গ হইয়াছে। সেই কারণেই ‘প্রাশাসনিক’ বাংলায় খাপ খাইল না।
পাঁচ পণ্ডিত একই কারণে বিলকুল বুঝিতে পারেন নাই কেন বাংলায় ‘সার্বজনীন’ চলিলেও ‘সর্বজনীন’ চলে না। ‘আভ্যন্তরীণ’ চলিলেও ‘অভ্যন্তরীণ’ চলে না। তাঁহারা সংস্কৃত প্রত্যয়ের দোহাই দিয়া দুইটাকেই ছাড়পত্র দিয়াছেন। তাঁহাদের মতে ‘বিশ্বজনীন’ ও ‘বৈশ্বজনীন’ দুইটাই চলিবে। ‘বৈশ্বজনীন’ বাংলায় চলে না, সংস্কৃতে চলিলেও চলিতে পারে।
একই নিয়মে তাঁহারা কি বলিবেন ‘বিদ্যুতিক’ ও ‘বৈদ্যুতিক’ দুইটাই চলিবে? এই স্থলে ‘ইক’ প্রত্যয়ের গুণে ‘বৈদ্যুতিক’ হইতেছে। কিন্তু ‘বিদ্যুতিক’ শব্দ বাংলায় চলিবে না। ‘ঈয়’ প্রত্যয়ের কারণে অন্যস্থলে ‘বৈশ্বজনীন’ বাংলা হইতে চাহে না, হয় ‘বিশ্বজনীন’। (পৃ. ৩০)
আগে— মানে যখন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে তালেবেলেম ছিলাম— আমরা একটা শব্দের সমাস ভাঙ্গিতাম। যিনিই পণ্ডিত তিনিই মূর্খ। পণ্ডিতমূর্খ। সেই জীব কোন জীব ডারবিন মহাশয় প্রদর্শন করেন নাই। বাংলা একাডেমীতে আসিলাম। পণ্ডিতমূর্খ কি পদার্থ দেখিবার সাধ পূরণ হইল। এই পণ্ডিতমূর্খদের ফতোয়াযোগে জানিতে পারিয়াছি বাংলা ভাষায় বহুল প্রচলিত ‘আন্তর্জাতিক’ শব্দটিও অশুদ্ধ। উঁহারা মনে করেন এই শব্দের অর্থ নাকি ‘জাতির অন্তর্গত বা জাতির আভ্যন্তরিক বিষয় সম্পর্কিত।’ আর ফতোয়া দিতেছেন ‘বিভিন্ন জাতি-সংক্রান্ত বা সার্বজাতিক’ অর্থে শব্দটির প্রয়োগ কি না অশুদ্ধ। হায়, অশুদ্ধ শব্দটাই ব্যাপক চলে। (পৃ. ৩৫)
ইঁহারা কি কাজী নজরুল ইসলামের নাম কখনও শুনেন নাই? দেখেন নাই ‘ইন্টারন্যাশনাল’ শব্দের তর্জমা আকারেই শব্দটির বাংলায় আমদানি? নজরুল ইসলাম ইহার তর্জমায় প্রথম ‘অন্তর-ন্যাশনাল’ কথাটি প্রয়োগ করেন। পরে লোকে ‘আন্তর্জাতিক’ করিয়াছে। দুই পদের মিলনের ফলে এই ক্ষেত্রে ‘অন্তর’ ও ‘জাতি’ উভয় পদেই বৃদ্ধি হইবার কথা। অন্তরের শবরী বালিকা ‘অ’ বাড়িয়াছে। জাতির আপন স্বর তো বাড়াই ছিল, অধিক বাড়িবার দরকার হয় নাই।
আর অর্থের বিচারে ‘আন্তর্জাতিক’ মানে তো ‘দুই বা ততোধিক জাতির মধ্যে’। এই অর্থে ‘দুই জাতির অন্তরে’ বুঝাইতেছে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এক সময় অভিযোগ করিয়াছিলেন সংস্কৃত পণ্ডিতেরা বাংলা ভাষার ক্ষেত্রেও বাংলা ভাষার আইনকে আমল দেন নাই। কয়েকটি উদাহরণ দেখাইয়া রবীন্দ্রনাথ বলিয়াছিলেন, “পণ্ডিতমশায় যদি সংস্কৃত রীতির উপর ভর দিয়া বাংলা রীতিকে অগ্রাহ্য করিতে পারেন, তবে আমরাই বা কেন বাংলা রীতির উপর ভর দিয়া যথাস্থানে সংস্কৃত রীতিকে লঙ্ঘন করিতে সংকোচ করি? ‘মনোসাধে’ আমাদের লজ্জা কিসের? ‘সাবধানী’ বলিয়া এখনি জিব কাটিতে যাই কেন? এবং ‘আশ্চর্য হইলাম’ বলিলে পণ্ডিতমশায় ‘আশ্চর্যান্বিত হয়েন’ কী কারণে?” (বাংলা শব্দতত্ত্ব, পৃ. ৮-৯)
বাংলা একাডেমীর পাঁচ বিশেষজ্ঞ পণ্ডিতও উপরের খানিক উদ্ধৃতিতে ধৃত দুইটি শব্দ লিখিয়াছেন: একটি ‘আভ্যন্তরিক’, আর একটি ‘সার্বজাতিক’। এইগুলি সংস্কৃত রীতির উপর ভর দিয়া বাংলা রীতি অগ্রাহ্য করা কষ্টগঠিত শব্দ। ইংরেজি ১৯৮৮ নাগাদ ইঁহারাই কিনা রায় দিয়াছেন ‘আশ্চর্য’ শব্দের মূল অর্থ ‘বিস্ময়কর’। ‘বিস্মিত’ অর্থে ব্যবহার প্রচলিত হইলেও নাকি ভুল। তাঁহারা লিখিয়াছেন শব্দটির ‘শুদ্ধরূপ আশ্চর্যান্বিত’। শুনিলে বাংলাদেশের টাট্টু ঘোড়ায়ও আশ্চর্য হইবেন। (পৃ. ৩৫)
পঞ্চপণ্ডিত অন্য এক শব্দ লইয়াও দেখি ঠাট্টা করিতেছেন। তাঁহারা লিখিয়াছেন ‘অপোগণ্ড’ শব্দটির ‘প্রকৃত অর্থ’ ‘নাবালক বা অপ্রাপ্তবয়স্ক বালক’। প্রকৃত অর্থ বলিতে বোধ করি তাঁহার ‘অভিধা’ বুঝাইয়া থাকিবেন। তাঁহাদের ফতোয়া মোতাবেক, শব্দটি ‘অপদার্থ, অকর্মণ্য অর্থে অশুদ্ধ।’ (পৃ. ৩৫) শব্দের অর্থব্যক্তি যে শুদ্ধ অভিধায় সীমিত থাকে না, লক্ষণ ও ব্যঞ্জনাক্রমে ছড়াইয়া যায় তাহার খবর বুঝি ইঁহারা কোনদিন শুনেনই নাই!
‘অপোগণ্ড’ শব্দের এক অভিধা ‘পাঁচ বছর বয়সের বালক’। সেইখান হইতে লক্ষণায় বাড়াইয়া ‘শিশু কিশোর বা অল্পবয়স্ক বালক’। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিধানে বঙ্কিমচন্দ্র হইতে উদাহরণ লওয়া হইয়াছে এই অর্থেই। ‘আমিও মরিব— তোমার অনুগমন করিব। কিন্তু ভাবিতেছি— এই অপোগণ্ডগুলির কি হইবে?’ খোদ হরিচরণের অভিধানেই শব্দটির পাঁচ পাঁচটি অর্থ লেখা হইয়াছে। প্রথম অর্থ ‘সে অপকৃষ্ট যায়? অর্থাৎ স্বাভাবিক হীনাঙ্গ বা বিকলাঙ্গ। ইহার দ্বিতীয় অর্থ ‘অতিভীরু’ লোক। ইহা হইতেই ব্যঞ্জনাযোগে ‘অপদার্থ বা অকর্মণ্য’ অর্থ দাঁড়াইয়াছে।
ব্যঞ্জনা না বুঝিবার আরও একটি উদাহরণ ‘পদক্ষেপ’। পণ্ডিতেরা বলিতেছেন ‘ব্যবস্থা গ্রহণ’ অর্থে পদক্ষেপ শব্দটির প্রয়োগ অশুদ্ধ। কারণ ইহার অর্থ ‘পদার্পণ বা পা ফেলা’। তাহা হইলে বলিতে হয় ‘হস্তক্ষেপ’ মানে ‘হাত ফেলা’। সুতরাং বলিতে হয় প্রচলিত অর্থে হস্তক্ষেপও অশুদ্ধ।
একাধিক উদাহরণ লইয়া আমরা দেখিলাম বাংলাদেশের কিছু পণ্ডিতব্যক্তি শব্দের ব্যঞ্জনা শক্তি বুঝিতে অক্ষম। সম্পূর্ণ অক্ষম। একালের ভাষাতত্ত্বে এই অক্ষমতা এক ধরনের স্মৃতিভ্রংশ বা এফাসিয়া রোগের লক্ষণ বলিয়া চিহ্নিত হইয়াছে। সেই বিষয়ে আলাদা নিবন্ধ লিখিবার প্রয়োজন পড়িয়াছে। আমি এইখানে স্থানাভাবে ভুগিতেছি। পুঁথি এমনিতেই বড় হইয়া গিয়াছে। এখানে নিশান মাত্র দিয়া রাখিব। (এয়াকবসন, ‘টু আসপেক্টস্ অব ল্যাঙ্গোয়েজ’, ১৯৫৬)
‘বাংলা ভাষার প্রয়োগ ও অপপ্রয়োগ’ পুঁথিতে আরও অনেক চিত্তাকর্ষক পদার্থ আছে। লেখক পঞ্চায়েত শুদ্ধ বাংলা ভাষা বিষয়েই অনবহিত নহেন, সামান্য অর্থে ভাষা কি পদার্থ তাহাও জানেন বলিয়া প্রমাণ পাইলাম না। আর দুইটা বাড়তি দৃষ্টান্ত দিয়া ছাড়িয়া দিতেছি।
‘অশ্রুজল’শব্দটিও তাহাদের চোখে অসিদ্ধ। কারণ অশ্রু অর্থই ‘চোখের জল’। কিন্তু সে তো সংস্কৃতে, বাংলায় নয়। টমাস স্টার্ন এলিয়ট কহিয়াছিলেন, ‘তুমি ব্যভিচার করিয়াছ? সে তো ভিনদেশে।’ ভিনদেশে করিলেই মাপ। তাই। পাঁউ অর্থ রুটি। নান অর্থও রুটিই। ব্যভিচারী বাংলায় পাঁউরুটি চলে। নানরুটিও অচল নহে। (পৃ. ৩৫)
পণ্ডিতাদির ধারণা ‘কলাকৌশল’ অর্থে ‘আঙ্গিক’ শব্দটি ভুল। (পৃ. ৩৫) কেননা, আঙ্গিক মানে ‘অঙ্গসম্বন্ধীয়’। আমরা বলিব অঙ্গের লক্ষণা হইতে তাহার ব্যঞ্জনা বা ভাবার্থ ‘কলাকৌশল’। আর কে না জানে কলাকৌশলে অঙ্গই মুখ্য!
‘জন্মবার্ষিকী’ প্রসঙ্গে ইঁহাদের স্পর্ধা অতুলনীয়। তাঁহারা মনে করেন ‘জন্মবার্ষিকী’ শব্দের সহিত অকারণেই স্ত্রী প্রত্যয় যোগ হইয়াছে। সুতরাং বহুল প্রচলিত হইবা সত্ত্বেও এই শব্দ অশুদ্ধ বলিয়া তাঁহারা সিদ্ধান্ত করিলেন। এই সিদ্ধান্ত যাঁহারা করেন লোকে তাহাদিগের জন্মবার্ষিকী পালন না করুন, বিধাতার নিকট এই দরখাস্ত পেশ করিবার প্রয়োজন ফুরাইল।
জন্মবার্ষিকীর সহিত স্ত্রী প্রত্যয়যুক্তি অকারণ নহে। ইহা হইতেছে পুনর্বিশেষীভবনের চিহ্ন। কথাটা কঠিন হইয়াছে, জানি। সোজা করিয়া বলিতেছি। ‘বর্ষ’ শব্দটি বিশেষ্য হইলে ‘বার্ষিক’ শব্দটি বিশেষণ, তাহাতে ‘ঈ’ যোগ করিয়া আবার বিশেষ্য— ‘বার্ষিকী’। পণ্ডিতেরা কহিতেছেন ‘জন্মবার্ষিক শব্দই যথেষ্ট’। ষোল আনা ভুল কথা। ‘জন্মবার্ষিক’ কি? ইহাতে ‘আকাঙ্ক্ষা’ থাকিয়াই যায়। ভাষায় বাক্য রচনায় আকাঙ্ক্ষা, যোগ্যতা ও আসত্তি বলিয়া কতক কথা আছে। ‘জন্মবার্ষিক’ অনুষ্ঠান, পত্রিকা বা দিন- যে কোন শব্দ হইতে পারে। ‘জন্মবার্ষিকী’ মানে এই তিন বা ততোধিকের যে কোন একটি বুঝাইতেছে।
কথায় কথায় ভুল ধরা এক ধরনের মানসিক ব্যাধি। কথাটা সাচ্চা হইলেও হইতে পারে। তবে অপোগণ্ড পণ্ডিতের ভুলকে উপহাস না করাও ব্যাধির অতিক্রম কি না কে বলিবে? ইঁহারা খুব জানেন, বাংলায় ‘নায়ক’ শব্দের লগে ‘ইকা’ লাগাইলে নায়িকা হয়, ‘গায়িকা’ বা ‘পাচিকা’ও একই নিয়মেরই সন্ততি। তাই বলিয়া ‘নাটিকা,’ ‘পুস্তিকা,’ ‘মালিকা’ বা ‘চয়নিকা’ও কি স্ত্রী-লিঙ্গ বলিয়া গণ্য হইবে? না, হইবে না। (পৃ. ২৪)
ক্ষুদ্রার্থে ‘ইকা’র প্রয়োগ আমিও কখনো করি ব্যঞ্জনার জন্য। আমি ছোটলোকের লেখক বলিয়া নিজের পরিচয় দিই ‘লেখিকা’। আর ক্ষুদ্র আমার পাঠকগোষ্ঠী। তাঁহাদের আদর করিয়া কখনো বা ‘পাঠিকা’ বলি। পণ্ডিতমূর্খদের হাত হইতে ভগবান আমার ভগিনী পাঠক ও পাঠিকা বেরাদরদের শান্তিতে রাখেন। আমেন।
বাংলা একাডেমীর পণ্ডিত ক্ষমার অযোগ্য যে অপরাধ করিয়াছেন তাহার শ্রেষ্ঠ উদাহরণ ‘খাঁটি গরুর দুধ’। তাঁহারা ভাবেন কথাটি ‘অর্থহীন’। তাঁহাদের ধারণা ইহার ‘শুদ্ধরূপ’ ‘গরুর খাঁটি দুধ’। (পৃ. ৩৬, ৭৮) আমরা বলি ইঁহারা বাংলা শব্দের অন্বয়শক্তি কি তাঁহার কোন খবরই রাখেন না। খাতির তো দূরের কথা।
পণ্ডিতেরা ‘খাঁটি গব্যঘৃত’ কথাটা শুনিয়া ‘গব্য খাঁটি ঘৃত’ বলিতেন কি? ‘খাঁটি গো-দুগ্ধ’ বলাই বাংলা রীতি। ‘গো-দুগ্ধ’ হইতে ‘গরুর দুধ’ হইয়াছে। এক যুগ আগে হোসাইন রিদওয়ান আলী খান রাষ্ট্র করিয়াছিলেন, “খাঁটি গরুর দুধ যদি অশুদ্ধ হত আর আমাদের লিখতে হত ‘গরুর খাঁটি দুধ’, তা হলে ‘দুটি পাকা আম’ অশুদ্ধ হত, আমাদের লিখতে হত পাকা দুটি আম, গোটা ভাষাটা আমাদের বরবাদ হতে বসত।” (বাংলা শব্দ বর্ণ বানান, পৃ. ৪৭)
বাংলা ও মুণ্ডা
‘অস্ট্রিক গোষ্ঠীর বিভিন্ন ভাষার ব্যাকরণ ও অভিধানের অভাবে পুরাপুরি বৈজ্ঞানিক আলোচনা করা আমার পক্ষে সম্ভব হয় নাই।’
—মুহম্মদ শহীদুল্লাহ (বাংলা ভাষার ইতিবৃত্ত, পৃ. ৫৮)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথা শিরোধার্য করিয়া এই নিবন্ধ শুরু করিয়াছিলাম। তাঁহার বাক্য দিয়াই শেষ করিতে হইবে। গঙ্গাজলেই গঙ্গাপূজা সারিতে হয়। নহিলে এই রোদন অরণ্যে রোদন হইবে। পণ্ডিতেরা ব্যঞ্জনার কি বুঝিবেন? তাহারা আমার চোখের জল মাত্র দেখিবেন। আর বলিবেন, এক্ষণে অরণ্য কোথায় পাইলেন?
ঠাকুর কোন এক ঠাঁই লিখিয়াছেন: “বাংলায় আমরা যেটাকে বলি অন্ত্যস্থ য, চ বর্গের জ’ এর সঙ্গে তার উচ্চারণের ভেদ নেই। য’ এর নীচে ফোঁটা দিয়ে আমরা আর একটা অক্ষর বানিয়েছি তাকে বলি ইয়। সেটাই সংস্কৃত অন্ত্যস্থ য। সংস্কৃত উচ্চারণ মতে ‘যম’ শব্দ ‘য়ম’। কিন্তু ওটাতে ‘জম’ উচ্চারণের অজুহাতে য়’র ফোঁটা দিয়েছি সরিয়ে। ‘নিয়ম’ শব্দের বেলায় য়’র ফোঁটা রক্ষে করেছি, তার উচ্চারণেও সংস্কৃত বজায় আছে।” (বাংলাভাষা-পরিচয়, পৃ. ৭২)
এই নিবন্ধের নাম কোথা হইতে পাইলাম, পাঠিকা দেখিতেছেন। একটা জিনিস দেখিতে আর জিনিসটা চোখে না পড়িয়া যায় না। ঠাকুর লিখিয়াছেন বাংলায় ‘যম’ লিখিলে লোকে পড়িবে ‘জম’। কারণ বাংলায় অন্ত্যস্থ ‘য’য়ের সঙ্গে উচ্চারণে চ বর্গের তিন নম্বর অক্ষর অর্থাৎ বর্গীয় ‘জ’য়ের ভেদ নাই। সংস্কৃত বাঁচাইতে ‘য’য়ে ফোটা দিয়া ইয়(য়) বানাইতে হইল।
কিন্তু ঠাকুরও ঠাহর করেন নাই কেন এমন হইয়াছে। বাংলা ভাষা সংস্কৃত হইতে অনেক শব্দ কর্জ করিয়াছে বটে কিন্তু তাঁহাদের গড়িয়া পিটিয়া আপন করিতে তাহার অনেক বেগও পাইতে হইয়াছে। বাংলা যে সংস্কৃত হইতে স্বতন্ত্র, স্বাধীন, ইতর ভাষা তাহা জানিতে হইলে আমাদের মুখ অন্যদিকে ফিরাইতে হয়। দুঃখের মধ্যে, সেই কাজ এখনও শুরুই হয় নাই। সুখের বিষয়, না করিয়া উপায়ও নাই।
বাংলা ভাষার ‘পুরুষ’ সংস্কৃত হইলেও হইতে পারে, সংস্কৃত-প্রাকৃতও হইতে পারে। কিন্তু তাহার ‘প্রকৃতি’ কি? বিজয়চন্দ্র মজুমদার একদা সেই প্রকৃতির সন্ধানে ‘দ্রাবিড়’ বলিয়া একটা খাসমহাল খাড়া করিয়াছিলেন। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় তাঁহার মহাগ্রন্থ ‘বাংলা ভাষার উৎপত্তি ও উন্নতি’ লিখিবার সময় বিজয়চন্দ্রের মতামতও কিছুদূর মানিয়া লইলেন। মুণ্ডা প্রভাব বা প্রকৃতি তিনি বড় ধরিতে চাহেন নাই।
সিলবাঁ লেবি, জঁ প্সিলুস্কি প্রভৃতি কতকগুলি বিদেশি পণ্ডিতের দোহাইক্রমে মুহম্মদ শহীদুল্লাহ একদিন খানিক ভিন্নকথা বলিবার কোশেশ করিয়াছিলেন। তাঁহার মতে বাংলার গর্ভে সংস্কৃতের টনটন বীর্য পড়িলেও এই ভাষার পেটে কিন্তু মুণ্ডা মহাজাতির আণ্ডাবাচ্চা। এই গবেষণা বেশিদূর চলে নাই। (শহীদুল্লাহ, ‘মুণ্ডা এফিনিটিস্,’) ১৯৬৫ সালে প্রকাশিত ‘বাংলা ভাষার ইতিবৃত্ত’ বইয়ে মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলিয়াছেন, ‘আলোচনা শেষ করিবার পুর্বে একটি কথা বলা দরকার। অস্ট্রিক গোষ্ঠীর বিভিন্ন ভাষার ব্যাকরণ ও অভিধানের অভাবে পুরাপুরি বৈজ্ঞানিক আলোচনা করা আমার পক্ষে সম্ভব হয় নাই।’ (পৃ. ৫৮)
মুণ্ডা ভাষার আলোচনা বাদ দিয়া বাংলা বানানের নিয়ম বাহির করা আর ডিম্ব ছাড়া মুরগি বানান একই কথা। বাংলা কেন সংস্কৃত নহে— এই প্রশ্নের উত্তর মুণ্ডা ভাষাগোষ্ঠীর ব্যবহার হইতেই পাওয়া যাইবে। শুদ্ধ তাহাই নহে, বাংলা কেন হিন্দি নহে তাহার জওয়াবও সেখানেই পাওয়ার কথা। ক্লারেন্স মেলোনির লেখায়ও এই ধারণা দেখিলাম। (ট্রাইবস্ অব বাংলাদেশ অ্যান্ড সিনথেসিস অব বেঙ্গলি কালচার)।
খ্রিস্টান ধর্মপ্রচারকেরা সাঁওতালি ভাষার গবেষণায় আগাইয়া আছেন। পশ্চিম বাঙালি হিন্দুরাও পিছাইয়া নাই। (ক্যাম্বেল, সান্তালি-ইংলিশ ডিকশনারি; বোডিং, এ সান্তাল ডিকশনারি; সুধীভূষণ ভট্টাচার্য, স্টাডিজ ইন কক্সারেটিব মুণ্ডা লিঙ্গুয়িস্টিক্স্; ক্ষুদিরাম দাস, সাঁওতালি বাংলা সমশব্দ অভিধান)।
অন্য কোন নিবন্ধে এই বিষয় বিশদ করিব। আমেন ।
দোহাই
১। আনিসুজ্জামান গয়রহ, প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম, ২য় সংস্করণ (ঢাকা: বাংলা একাডেমী, ১৯৯৪)।
২। আনিসুজ্জামান গয়রহ, প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম, ৩য় সংস্করণ, (পৃ. ১২১৯-১২২৪) পরিশিষ্ট, ব্যবহারিক বাংলা অভিধান: মুহম্মদ এনামুল হক ও শিবপ্রসন্ন লাহিড়ী সম্পাদিত, পরিমার্জিত সংস্করণ (ঢাকা: বাংলা একাডেমী, ২০০০)।
৩। আনিসুজ্জামান, পাঠ্য বইয়ের বানান, পরিমার্জিত সংস্করণ (ঢাকা: জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড, ২০০৫)।
৪। জগদ্বন্ধু মোদক, বাঙ্গালা ব্যাকরণ ও রচনা-শিক্ষা, ১৯ সংস্করণ (কলিকাতা: সংস্কৃত প্রেস ডিপোজিটারি, ১৯১৮)।
৫। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, আত্মজীবনী, সতীশচন্দ্র চক্রবর্ত্তী সম্পাদিত, ৪র্থ সংস্করণ (কলিকাতা: বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ, ১৯৬২)।
৬। নেপাল মজুমদার সম্পাদিত, বানান বিতর্ক, ৩য় সংস্করণ (কলিকাতা: পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, ২০০৭)।
৭। পার্বতীচরণ ভট্টাচার্য, বাংলাভাষা, ৩য় সংস্করণ (কলিকাতা: জিজ্ঞাসা এজেন্সিস, ১৯৯৮)।
৮। প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ, ‘চ’ল্তি ভাষার বানান,’ (পৃ. ৩০১-১০), বানান বিতর্ক, নেপাল মজুমদার সম্পাদিত, ৩য় সংস্করণ (কলিকাতা: পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, ২০০৭)।
৯। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বঙ্কিম রচনাবলী, ২য় খণ্ড, যোগেশচন্দ্র বাগল সম্পাদিত, ১৪শ মুদ্রণ (কলিকাতা: সাহিত্য সংসদ, ১৪০৯)।
১০। বশীর আল্হেলাল, বাংলাভাষার নানান বিবেচনা (ঢাকা: আগামী প্রকাশন, ২০০১)।
১১। বিজনবিহারী ভট্টাচার্য, বঙ্গভাষা ও বঙ্গসংস্কৃতি, ২য় মুদ্রণ (কলকাতা: আনন্দ পাবলিশার্স, ১৯৯৪)।
১২। মণীন্দ্রকুমার ঘোষ, ‘বানান সংস্কারের চিন্তা অবান্তর নয়’ (পৃ. ৩৫৯-৬৩), পুনর্মুদ্রণ, ভাষাভাবনা (বাংলা ভাষা নিয়ে সাম্প্রতিক বির্তক), তুষারকান্তি মহাপাত্র সম্পাদিত (কলকাতা: অবভাস, ২০০৫)।
১৩। মণীন্দ্রকুমার ঘোষ, বাংলা বানান, ৪র্থ সংস্করণ (কলকাতা: দে’জ পাবলিশিং, ১৪০৯)।
১৪। মাইকেল মধুসূদন দত্ত, ‘মেঘনাদবধ কাব্য’, ৫ম মুদ্রণ, মধুসূদন-গ্রন্থাবলী (কাব্য), ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায় ও সজনীকান্ত দাস সম্পাদিত (কলিকাতা: বঙ্গীয়-সাহিত্য পরিষদ, ১৩৬৫)।
১৫। মিতালী ভট্টাচার্য, বাংলা বানানচিন্তার বিবর্তন (কলিকাতা: পারুল প্রকাশনী, ২০০৭)।
১৬। মুহম্মদ এনামুল হক, ব্যাকরণ মঞ্জরী, পুনর্মুদ্রণ (ঢাকা, মাওলা ব্রাদার্স, ১৪১০)।
১৭। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, বাঙ্গালা ব্যাকরণ, পুনর্মুদ্রণ (ঢাকা: মাওলা ব্রাদার্স, ২০০৩)।
১৮। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, বাংলা ভাষার ইতিবৃত্ত, পুনর্মুদ্রণ (ঢাকা: মাওলা ব্রাদার্স, ১৯৯৮)।
১৯। যোগেশচন্দ্র রায়, বাঙ্গালা ভাষা, প্রথম ভাগ (ব্যাকরণ) (কলিকাতা: বঙ্গীয় সাহিত্য-পরিষৎ, ১৩১৯)।
২০। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বাংলাভাষা-পরিচয়, পুনর্মুদ্রণ (কলকাতা: বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ, ১৯৬৯)।
২১। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বাংলা শব্দতত্ত্ব, ৩য় সংস্করণ (কলকাতা: বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ, ১৩৯১)।
২২। রামমোহন রায়, ‘গৌড়ীয় ব্যাকরণ,’ (পৃ. ১-৬৮), রামমোহন গ্রন্থাবলী, ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও সজনীকান্ত দাস সম্পাদিত, ৩য় সংস্করণ (কলিকাতা: বঙ্গীয় সাহিত্য-পরিষৎ, ১৩৮০)।
২৩। রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, ‘বাঙ্গলা ব্যাকরণ,’ (পৃ. ১৪-৪২), প্রসঙ্গ: বাংলা ব্যাকরণ, পবিত্র সরকার সম্পাদিত (কলকাতা : পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, ২০০৫)।
২৪। পণ্ডিত হরনাথ ঘোষ ও ডা. শ্রীসুকুমার সেন, বাঙ্লা ভাষার ব্যাকরণ, ৬ষ্ঠ সংস্করণ (কলিকাতা: ভিক্টোরিয়া বুক ডিপো, ১৩৫৬।
২৫। হোসাইন রিদওয়ান আলী খান, ‘বাংলা শব্দ বর্ণ বানান’, (পৃ. ৪১-৫৩), উত্থানপর্ব, আহমদ ছফা সম্পাদিত (ঢাকা, ১৯৯৭)।
২৬। শিবপ্রসন্ন লাহিড়ী গয়রহ, বাংলা ভাষার প্রয়োগ ও অপপ্রয়োগ (ঢাকা: বাংলা একাডেমী, ১৯৮৮)।
২৭। ক্ষুদিরাম দাস, ‘বাঙলা ভাষায় সাঁওতালী উপাদান,’ দেশ কাল সাহিত্য (কলকাতা: পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, তারিখবিহীন)।
২৮। ক্ষুদিরাম দাস, সাঁওতালি বাংলা সমশব্দ অভিধান (কলিকাতা: পশ্চিবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, ১৯৯৮)।
২৯| P.P. Bodding, A Santali Dictionary, 5 vols. (Oslo: University of Oslo Press, no date).
৩০| Campbell’s Santali English Dictionary, R.M. Macphail, ed., reprint (Calcutta: Firma KLM, 1984).
৩১| Roman Jakobson, ‘Two aspects of language and two types of aphasic disturbances’, in Roman Jakobson and Morris Halle, Fundamentals of Language (The Hague: Muton & Co., 1956).
৩২| Clarence Maloney, ‘Tribes of Bangladesh and Sznthesis of Bengali Culture (pp.5-52), Tribal Cultures in Bangladesh, Mahmud Shah Qureshi, ed. (Rajshahi: Institute of Bangladesh Studies, 1984).
৩৩| Muhammad Shahidullah, ‘Munda Affinities in Bengali,’ (pp. 715-721), Proceedings of All India Oriental Conference (Patna, 1931).
৩৪| Sudhibhusan Bhattacharya, Studies in Comparative Munda Linguistics (Simla: Indian Institute of Advanced Studz, 1975).
(শেষ)
(লেখাটি প্রথম প্রকাশ হয় ২০১০ সালের ১৫ মে, নাঈমুল ইসলাম খান সম্পাদিত ‘নতুনধারা’ সাময়িকী পত্রিকার সপ্তম সংখ্যায়। এখানে ওইসময়কার বানানই অবিকৃত রাখা হয়েছে।—ফিচার সম্পাদক)