লন্ডন ১৯৭১
আলোকচিত্রে মুক্তিযুদ্ধের অদেখা অধ্যায়
১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ শুধু রণাঙ্গনেই হয়নি, দেশের পাশাপাশি বিদেশের মাটিতেও বাঙালির স্বাধীনতার সমর্থনে হয়েছে নানা প্রতিবাদ ও সভা-সমাবেশ। দেশের আনাচে-কানাচে মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র হাতে যখন যুদ্ধ করছিলেন, তখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রবাসী বাঙালিরা সোচ্চার ছিলেন স্বাধীনতার দাবিতে। এসব কথা এত দিন আমরা জেনেছি বিভিন্ন ইতিহাস ঘেঁটে।
তবে এবার বিদেশে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য লড়াইয়ের সেইসব দিন উঠে এসেছে ‘লন্ডন ১৯৭১ : ভিন দেশে বাঙালির আগুনঝরা দিনের গল্প’ শিরোনামে আলোকচিত্র প্রদর্শনীতে।
গতকাল বৃহস্পতিবার শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় চিত্রশালার গ্যালারি-৫-এ শুরু হয়েছে ‘প্রজেক্ট লন্ডন ১৯৭১’-এর আয়োজনে তিন দিনের এ আলোকচিত্র প্রদর্শনী।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় প্রধান অতিথি হিসেবে এ প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। বিশেষ অতিথি ছিলেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম। আলোচনায় অংশ নেন সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ও ১৯৭১ সালে লন্ডনে স্থাপিত বাংলাদেশ কূটনৈতিক মিশনের দ্বিতীয় সচিব মহিউদ্দিন আহমদ এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শহীদ সন্তান নুজহাত চৌধুরী।
প্রদর্শনীতে স্থান পাওয়া বেশির ভাগ ছবি ব্রিটিশ আলোকচিত্রী রজার গোয়েন ও বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ইউসুফ চৌধুরীর তোলা। এ ছাড়া রয়েছে বেশ কিছু সংগৃহীত ছবি। আট বছর ধরে লন্ডনে বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে ঘুরে ঘুরে এসব ছবি সংগ্রহ করেছেন এ প্রদর্শনীর উদ্যোক্তা ও সমন্বয়কারী উজ্জ্বল দাশ।
এ ছাড়া লন্ডন থেকে প্রকাশিত বাংলা ও ইংরেজি সংবাদপত্রের মূল কপি, পোস্টার, ডাকটিকেট ও প্রচারপত্র স্থান পেয়েছে এ প্রদর্শনীতে। বাঙালিদের পাশাপাশি একাত্তরে স্বাধীন বাংলাদেশের সমর্থনে বিশ্ব জনমত গঠনে ব্রিটিশ এমপি, রাজনীতিক, সাংবাদিক, সমাজকর্মী, প্রগতিশীল শিক্ষার্থীসহ নানা শ্রেণির মানুষ রেখেছেন অনন্য ভূমিকা। প্রদর্শনীতে উঠে এসেছে সেসব ভিনদেশি বন্ধুরও ছবি।
আর এসব ছবি আমাদের সামনে হাজির করল মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের নতুন এক অদেখা অধ্যায়। যেসব ছবি না দেখলে বিশ্বাসই হবে না, বিলেতের রাজপথ যেন বাংলাদেশেরই একটি অংশ হয়ে উঠেছিল সে সময়। স্বাধীন বাংলাদেশের দাবিতে, বঙ্গবন্ধুকে মুক্তির দাবিতে হাজার হাজার বাঙালির সঙ্গে রাজপথে নেমে এসেছিল লন্ডনবাসীও।
প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছে ভিনদেশে বাংলার মুক্তিসংগ্রামের সমর্থনে গড়ে ওঠা প্রবাসী ও লন্ডনবাসীর সভা-সমাবেশ, মিছিল কিংবা বিক্ষোভের ছবি। ১৯৭১ সালের ১২ ডিসেম্বর বাংলাদেশের সংবিধানের প্রথম লিপিকার এ কে এম আবদুর রউফের হাতে আঁকা ঐতিহাসিক পোস্টারটি স্থান পেয়েছে প্রদর্শনীতে।
এসব ছবির মধ্যে আছে একাত্তরের লন্ডনের হাইড পার্ক স্পিকার্স কর্নারে মুক্তিকামী জনতার সমাবেশ। সেই সমাবেশে বঙ্গবন্ধুর মুক্তি দাবিতে বিভিন্ন পোস্টার ও তাঁর ছবি প্রদর্শন করছেন বিক্ষোভকারীরা। এসব সমাবেশে বাঙালিদের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছিলেন বিদেশিরাও।
দেখা মেলে একাত্তরের ৪ জুন তারিখে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটের দিকে এগিয়ে চলেছে যুক্তরাজ্যের মহিলা সমিতির দুর্বার মিছিল। একাত্তরের ১ আগস্ট লন্ডনের ট্রাফালগার স্কয়ারে অনুষ্ঠিত মহাসমাবেশে সাংস্কৃতিক পরিবেশনার দেখা মেলে একটি ছবিতে। আছে ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারির একটি ঐতিহাসিক মুহূর্তের ছবি।
পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে বঙ্গবন্ধু সরাসরি পৌঁছে যান লন্ডনে। সেখানের ক্লারিজ হোটেলে সংবাদ সম্মেলনে অংশ নিচ্ছেন তিনি। অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ব্রিটেনের প্রবাসী বাঙালিদের কাছে সাহায্য-সহযোগিতা চেয়ে চিঠি পাঠিয়েছিলেন। সেই চিঠিও রয়েছে প্রদর্শনীতে।
প্রদর্শনী প্রসঙ্গে উজ্জ্বল দাশ বলেন, ‘এ উদ্যোগের মধ্য দিয়ে দেশ-বিদেশের তরুণ বাঙালি প্রজন্মকে একাত্তরে ভিন দেশে অবস্থানরত প্রবাসীদের স্বাধীনতা-সংগ্রামের ভূমিকাটি উপস্থাপনের চেষ্টা করেছি। এটাই আমাদের প্রথম প্রদর্শনী এবং এই ছবিগুলো এর আগে কোথাও প্রদর্শিত হয়নি। অদূর ভবিষ্যতে সিলেট, লন্ডন ও বার্মিংহামে এই ছবিগুলোর প্রদর্শনীর আয়োজন করা হবে।’
প্রদর্শনীটি চলবে আগামী শনিবার পর্যন্ত। প্রতিদিন বিকেল ৩টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত প্রদর্শনীটি সবার জন্য উন্মুক্ত।