কবিতার সহিত অর্থের সম্বন্ধ
একটা বিষয়ে আমি সুব্রত অগাস্টিন গোমেজের সহিত একমত। তিনি এক জায়গায় লিখিয়াছেন, ‘একটা কবিতার থেকে গুটিকয় লাইন তুলে দিলে কবিতাটির কোন পরিচয় দেয়া হয় না। কেননা একটা কবিতা তার অংশবিশেষের চমৎকারিত্বের উপর দাঁড়িয়ে যায় না। তাকে তার সবগুলি পংক্তির, সবগুলি শব্দের উপরে, তাদের পারস্পরিক সম্পর্কের উপরে, দাঁড়িয়ে থাকতে লাগে। এই সম্পর্কসূত্র ছিঁড়ে ফেললে যা থাকে তা একটা মালা থেকে খসিয়ে ফেলা এক বা একাধিক পুঁতি। আলাদাভাবে তাদের সৌন্দর্য কিছু থাকলেও থাকতে পারে কিন্তু তাদের থেকে গোটা মালাটার ধারণা করা অসম্ভব।’ এই উদ্ধৃতিটির ভিতরের কথাগুলি খোদ লেখকের। আমি কিছু কিছু যতিচিহ্ন, দুয়েকটি বানান নিজের ভাষায় অনুবাদ করিয়া লইয়াছি মাত্র। পার্থক্যের মধ্যে এই যাহা। পাঠিকার স্বাধীনতা যাহাকে বলে আমি তাহা একটু লইতে বাধ্য হইয়াছি। আশা করি, লেখক ইহা লইয়া মোকদ্দমা ফাঁদিবেন না।
অগাস্টিন গোমেজ আমাদের অনেক অনুগ্রহ করিয়াছেন। তিনি লিখিয়াছেন, ‘সবচেয়ে রূপসী নারীর দেহকেও খণ্ড খণ্ড করে, তার একটা আঙ্গুল কি চুল চোখ কি নখ প্রদর্শন করলে যা করা হয় তা ঐ রমণীকে এবং তার স্রষ্টাকে অপমান করবার নামান্তর।’ আহা, রমণী! তিনি অধিক গমন করিয়াছেন, ‘উদ্ধৃতিরসের রসিয়াদের এক অর্থে কাটা হাতপা প্রভৃতিতে রতিসুখলাভকারী স্যাডিস্টদের সঙ্গে তুলনা করা যায়।’ আহা, মারকি দো সাদ! এখানেই বিরতি লইব।
কবির উপদেশটি আমার বেশ কাজে লাগিয়াছে। আশা করি, দেশেরও লাগিবে। কবির কবিতা পড়া এক জিনিশ, তাহা লইয়া আলোচনা করিতে যাওয়া সম্পূর্ণ আর। আমাদের দেশে সাহিত্য—বিশেষ কবিতা—সমালোচনার মূলধারায় গোমেজ-কথিত ‘উদ্ধৃতিরসের রসিয়াদের’ রাজত্ব চলিতেছে এখনও। এদিকে অধীনের উপর আদেশ হইয়াছে গোমেজের কবিতা লইয়া দুই পাতা লিখিতে হইবে। কর্তব্যপালনে বিফল-মনোরথ হইতে বসিয়াছি, এমন সময় প্রত্যাদেশের ন্যায় উপরে যে উদ্ধৃতিরসের সঞ্চার করিয়াছি তাহা খাঁড়ার ন্যায় নাজেল হইল। তাই সাহস করিয়াছি। আমরাও কেন স্মরণীয় হইব না?
১
সুব্রত অগাস্টিন গোমেজের একটি কবিতা একদিন দৈবক্রমে পড়িয়াছিলাম। স্থির করিয়াছি অদ্য শুদ্ধমাত্র ঐ কবিতাটি লইয়াই আলোচনা করিব। কবিতাটির নাম ‘পথনির্দেশ’। গ্রন্থের নাম ‘ঝালিয়া’। রচনাকাল—লেখকের দয়ায় জানিয়াছি—২০০৩। কবিতাটি পড়িয়া মনে হইল কবি যাহা বলিতে চাহিয়াছেন তাহা কিন্তু বলেন নাই, অর্থাৎ বলিয়াই ক্ষান্ত হয়েন নাই। তাই এই কবিতাকে ‘অপরূপ কথা’ বা অ্যালেগরিও বলা যাইতে পারে। অপরূপ কথা আকারে পড়িলে ইহাকে বলা চলে সকল কবিতার অপরূপ কথা। শুদ্ধ কবিতার কেন, খোদ ভাষার।
আমি আগেভাগে পুরা কবিতাটিই তুলিয়া দিতেছি। তারপরে তাহার অর্থ লইয়া আলোচনা করিব। ‘পথনির্দেশ’ সত্য সত্যই পথনির্দেশের ভাব করিতেছে। ধরা যাইতে পারে পুরানা ঢাকায় যাইতেছেন, কাহিনীকার কহিতেছেন—
ধরো উয়ারিতে আছো, টিপু সুলতান
রোড ধরে চলিতেছ খ্রিস্টান-কবরস্তান পানে
তারপর যেখানে শেষ টিপু সুলতান
সেখানেই ঘুরে গিয়ে ডানে
হাঁটি হাঁটি পা পা যাও নারিন্দা মোড়ের দিকে তুমি,
মোড়ে গিয়ে, বেঁচে থাকলে, ঝুনুর দুয়েক প্লেট মোরগ পোলাও মেরে দিয়ে
ডান দিকে বয়ে যাও ধোলাই খালের তেরাস্তায়,
উঁহুহু ডানে ঘুরো না, নাক বরাবর হাঁটো কুলি আর কামিন খেদিয়ে
হৃষীকেশ দাস রোড ধরে। ডানে বায়ে একে একে
পেরোও পাঁচভাই ঘাট লেন আর বানিয়ানগর,
এবং কদমতলা, সেখানে কদমগাছ তলে
পিংকি এক মন্দির রয়েছে, সেটি এত পিচ্চি যেন রান্নাঘর
প্রণাম ঠুকিতে চাও ঠুকিয়া আগায়ে যাও গজ পঞ্চাশেক,
আবার তেমাথা, যেথা লক্ষ্মীবাজারের রাস্তাখানি
(ওরফে সুভাষ বোস অ্যাভিনিউ, সবারই অজানা সেই নাম)
মিলে গেছে হৃষীকেশে, বাকরখানির
দোকান আছয়ে সেথা...তবু চলে যাও সোজাসুজি
একরামপুর আর কলুটোলা ছাড়িয়ে দু’দিকে
তখন ডানদিকে তুমি দেখিবে হেমেন্দ্র দাস রোড
উক্ত রোডে লহো পা দু’টিকে
রিকশার বেতঝোপ ফুঁড়ে কনুইয়ে জানুতে
কয়েকটা মুদি ও লোহালক্কড়ের চক্করের পরে
কলাপসিবল গেটে পাঁচতলা গারদ
গোলাপি রঙ্গের বাড়িটিতে নক করে
আমাকে পাবে না ॥
আপনারা—যাঁহারা ধরা যায় জীবনানন্দ দাশের কবিতা পড়িয়া ধরাশায়ী—মনে করিতে পারেন কবিটি বেশ নাগরিক। আমরা—যাঁহারা পুরানা ঢাকার অলিন্দে নিলয়ে হাঁটিতে হাঁটিতে একদা পায়ের ধুলা মাথায় ঠুকিয়া লইতেছিলাম—তাহারাও বেশ ‘বাস্তববাদী’। ঢের মজাও পাইয়াছি এই কবিতা পড়িয়া। ঝুনুর দুয়েক প্লেট মোরগ পোলাও আমিও কয়েকবার না মারিয়া পারি নাই। নাক বরাবর কুলি আর কামিন খেদাইয়া আমিও দুই চারিবার হাঁটিয়াছি ধোলাই খালের তেরাস্তায়। একেবারে শেষ বিজোড় পংক্তিতে পৌঁছিয়া আপনার হুঁশ হইবে—আপনি ঠিক জায়গাতেই আসিয়াছেন কিন্তু যাহার সন্ধানে আসিয়াছেন তিনি বাড়ি নাই। এই হইল কবিতাখানি। ইহার সহিত বাকরখানির অর্থাৎ তাহার অর্থের কি সম্বন্ধ? সেই সম্বন্ধই এই কবিতার ‘অপরূপ কথা’।
শুদ্ধ কবিতা কেন? আমরা ইচ্ছা করিলে অধিকও যাইতে পারি। মানুষ বাকশক্তিসম্পন্ন প্রাণী। সে কথা বলে। তাহার অর্থ আছে। অর্থের মজায় সে পড়ে। কিন্তু সে অর্থ তাহাকে এড়ায়। মানুষের ভাষার সহিত একটা খোসাওয়ালা পিঁয়াজের তুলনা করা যায়। পিঁয়াজের একটা খোসা ছাড়াইলে ভিতরে আর একটা খোসা পাওয়া যায়। সেই খোসা ছাড়াইলে আরও এক খোসা। এইভাবে খোসাক্রমে শেষ খোসা। শেষ খোসার পর আর কি? আর নাই। কিছুই নাই। গোলাপি রঙ্গের বাড়ির মতন বাড়িটি আছে। তাহাকে ‘গারদ’ বলিয়া যতই রঙ্গ করেন না কেন আমি কিন্তু সেখানে নাই। আমি মরীচিকার মত হারাইয়া গিয়াছি ‘আমি নাই’। তারপরও আমিই তো কথা বলিতেছি। তো আমি কোথায় আছি? আমিই না পথনির্দেশ দিতেছি। আমি তোমার ভাষার মধ্যে—এই কবিতার মধ্যেই—আছি বৈকি!
২
আমি আমি নই—এই আমি সেই ‘আমি’ নই—বলিয়াই ‘পথনির্দেশ’ কবিতাটি একপ্রস্ত অপরূপ ভাষার কথা হইয়াছে। বিশেষ করিয়া ভাষার স্বভাব বিষয়ের কাহিনী এইখানে গা ঢাকা দিয়াছে। আপনি তাহা মানিয়া লইয়াছেন কিনা জানি না। আপনার মন পাইবার অভিলাষে আর একটু বয়ান করি। স্মরণ করি কবি কি ইশারা করিয়াছেন। প্রকাশ একই বছরে রচিত আরেক পাতা কবিতায়ও সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ একই অপরূপ কথা জাহির করিয়াছিলেন। ইহাতে যাঁহারা ইচ্ছা কবির কবিতা অপেক্ষা ‘কবিকে জানিতে পারিলে আরও গুরুতর লাভ’ মনে করেন তাঁহারা লাভের জিনিশ একটা পাইলেও পাইতে পারেন। আমার চোখ পুলিশ পুলিশ। আমি এখানেও এই এক অপরূপ কথাই শিকার করিব।
সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ একদা যাহা লিখিয়াছিলেন তাহাতে স্বৈরাচারের যুগে বাংলাদেশের কবিতার ইতিহাস থোড়বড়ি আকারে লেখা হইয়াছে। তাহাতেই প্রকাশ তিনি সেখানে থাকিয়াও নাই। এখানে পিঁয়াজের খোসা নাই, রসুনের কোয়া পাওয়া যাইতেছে। স্বৈরাচারের যুগে বাংলাদেশের কবিতায় যে কলঙ্করেখা তাহার একটা দিগন্ত এখানে ধরা পড়িয়াছে। বাংলাদেশের বর্তমান কবিতা অষ্টাদশ শতকের শেষভাগে মোগল রাজদরবারের কবিতার মতন পবিত্র পতিতা। সুব্রত অগাস্টিন গোমেজকে তাই আমি মির তকি মিরের সহিত তুলিতে চাই।
ঝটপটাপট কবিতা ফাঁদতে হবে
গোটা দুচ্চার- তা না হলে সাজ্জাদ
রাইসু, মাসুদ খানকে কি হুনাতাম?
আসর করবো মাত অরা- আমি বাদ।
ধরে লওয়া যায়, আইবেন আলতাফ
ভাই, তাঁর যত পালিশ-চিকন কপি
লয়ে- আছে হের্ ফরহাদ মজহার,
সব আড্ডার অদ্বিতীয়ম টপিক!
ইঁহারা ইশারা করবেন-‘সুব্রত
কবিতা বলেন!’ লেকিন আমি যখন
গাইব- ‘ভাই গো, কবিতা নাই তো সঙ্গে-’
কত ভালো, আহা, করবেন তাঁরা মন!
খান হুনাবেন হীনম্মন্য করা
কয়েক দিস্তা, প্রায় নিস্তারহীন-
শক্তি ও জয়ও নাক গলাবেনে এসে,
শাওন খাইয়ে দিবেনে পরে পুড়িং
রাইসুর লগে বার হয়ে রাস্তায়
গাড়ি খুঁজবার ঝক্কির মাঝরাতে
মুখটা এমুন করে রাখমু রে আমি
যাতে মনে হয়, আমিও ছিলাম সাথে...
এই কবিতটির নাম ‘সাজ্জাদ শরিফের বাসায়/ কবিতা পাঠের আশায়’—এ কথা না বলিলেও চলিবে। ১৯৮৫ সালের কিছু আগে বা পরে যাঁহারা ঢাকাদেশে কবিতা লিখিতে বসিয়াছেন তাঁহাদের একাংশের কাহিনী এই পদ্যে ধরা পড়িয়াছে। আমি সেই কাহিনী পড়িবার জন্য সুব্রত অগাস্টিন পড়িব কেন? কবি পরিচয়ে সুব্রত নিঃসন্দেহে হুসাইন মুহম্মদ এরশাদের উপরে বিরাজ করিবেন তাহাতে সন্দেহ কি। স্বৈরাচারের যুগে জন্মিলেই আপনাকেও স্বৈরাচারে মজিতে হইবে—এমন কথা কেহ কখন বলিয়াছে?
মলাটের লিখন ললাটের মতন। না যাইবে খণ্ডন। সুব্রত অগাস্টিন গোমেজের জন্ম ১৯৬৫ সালের ৭ জানুয়ারি তারিখে, দক্ষিণ ঢাকার কলাকোপা-বান্দুরা নামক মোকামে। ঐশীবাণী অনুসারে, কবি হিশেবে সুব্রত অগাস্টিন গোমেজের আত্মপ্রকাশ ১৯৮০ সালের দশকের মাঝামাঝি কোন এক সময়ে। আরও জানা গেল স্ত্রী মিনতি ও কন্যা টায়রাকে লইয়া ১৯৯৫ সাল হইতে তিনি অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে বাস করিতেছেন। তাঁহার কবিতা সংগ্রহ তিনি উৎসর্গ করিয়াছেন একের ভিতর দুই মানুষকে। একজনের নাম মিনতি। আরজনের নাম মুখে লইতে পারিতেছেন না। নিজের নামের আদ্যাক্ষর আর বঁধুয়ার নামের আদ্যাক্ষর—দুই মিলাইয়া সেই অপূর্ণ বাসনা তিনি গাঙ্গুড়ের জলে ভাসাইয়া দিয়াছেন। তাঁহার বাসনার নাম তুমি নও, সুমি॥
দোহাই
১. সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ, ঝালিয়া (ঢাকা : ভাষাচিত্র, ২০০৯)।
২. -- কবিতা সংগ্রহ (ঢাকা : মাওলা ব্রাদার্স, ২০০৬)।
৩. -- ‘কামূত্থান পর্ব : অহেতু গুঞ্জনমালা’, লোক, বর্ষ ১৬, সংখ্যা ১৯ (সেপ্টেম্বর ২০১৫), পৃ. ৭৫-৮০।