শহীদ মিনারে তিনি শুয়ে, আমি কিছুটা তফাতে দাঁড়িয়ে
মনে হচ্ছিল আনুষ্ঠানিকতার পর্বটি কোনোরকমে শেষ করেই তিনি এসে আমার হাত ধরবেন। বলবেন- চলো, আশপাশে কোথাও গিয়ে চা খাই! লেখালেখির কথা বলি।
গত পাঁচ-ছয় বছর এমনটাই ঘটছিল নিয়মিত। বড় কোনো সাহিত্যের অনুষ্ঠান, আলোচনা অনুষ্ঠান, সংবর্ধনাসভা- এসবের মাঝপথে তিনি উঠে আসতেন আলগোছে। আমি যে ক্যামেরা দেখলেই মুণ্ডু ঢুকিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ি না, এটা তিনি জানতেন। পছন্দও করতেন। অনুষ্ঠানে নিজের করণীয়টুকু সেরে আমি সরে যাই এককোণে। তিনি মঞ্চে বসে থেকেও খেয়াল করতেন আমার অবস্থান। টুক করে নেমে আসতেন একসময়। আনোয়ারা আপাকেও ইঙ্গিত দেওয়াই থাকত। কখনো কখনো পিয়াস মজিদকেও। হক ভাই এসে আমার কব্জি চেপে ধরে বলতেন- চলো!
আমার কব্জিটাই ধরতেন তিনি। বলতেন- চওড়া কব্জির লেখক। কাঁধেও হাত রাখতেন কদাচিৎ। অনুষ্ঠানস্থল বাংলা একাডেমি হলে আমরা চলে যেতাম টিএসসির দিকে। কখনো পুষ্টিভবনের গেটের কোণে গাছতলার চায়ের দোকানের বেঞ্চিতে বসা হতো। তারপর শুরু হতো তাঁর কথা। আমি তাঁর কোনো একটি রচনার করণ-কৌশল নিয়ে কথা তুলতাম। বিনাদ্বিধায় নির্মাণকৌশলের সবটাই জানাতেন তিনি আমাকে। আপা কখনো হেসে বলতেন- জাকির তো সব গোমড় জেনে নিচ্ছে তোমার লেখার।
সৈয়দ হক একইভাবে অনুচ্চকণ্ঠে বলতেন- নিজে নিজে শিখেছি বছরের পর বছরের পথচলার মধ্য দিয়ে। সব নিয়ে কবরে চলে যাব! তারচেয়ে কাউকে দিতে পারলে তো ভালোই হয়।
‘বাংলা মাটি বাংলার জল’ নাটক দেখে বেরিয়ে ফোন করেছিলাম তাঁকে। জানতে চাইলাম, তিনি কোথায় আছেন। তিনি কারণ জানতে চাইলে বলেছিলাম- নাটকটা দেখে বেরুলাম। আপনার পা ছুঁয়ে একবার সালাম করতে চাই।
সৈয়দ হক হেসে বললেন- আসতে হবে না। ওটা আমি নিয়ে নিলাম।
সেই নাটক রচনার কৃৎকৌশলও তিনি জানিয়েছিলেন আমাকে এরকমই এক চায়ের দোকানের বেঞ্চিতে বসে। হালকা চালে বলেছিলেন- দুই কপি ‘ছিন্নপত্র’ কিনলাম। সেইসাথে ছোট একটা কাঁচি আর মোটা একটা খাতা। ছিন্নপত্র থেকে দরকারি লাইনগুলো কাটছিলাম আর পরপর পেস্ট করছিলাম খাতায়। এরপর ধরো গগন হরকরা আর প্রজাদের মুখের সংলাপ বসালাম, তাঁর আমলাদের কথা বসালাম, গান বসালাম। শেষদৃশ্যে গগন হরকরার ‘আমি কোথায় পাব তারে আমার মনের মানুষ যে রে’ গানের সঙ্গে ফিউশন করে দিলাম ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি।’
এরকম আরেকটি অনুষ্ঠান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আসা আড্ডায় জিগ্যেস করেছিলাম ‘রক্তগোলাপ’ লেখার কথা। ১৯৬২ সালে লিখেছেন তিনি ‘রক্তগোলাপ’। তখন ম্যাজিক রিয়ালিজমের নামই শোনেনি কেউ এই উপমহাদেশে। তিনি কি ম্যাজিক রিয়ালিজম করেছিলেন?
সৈয়দ হকের উত্তর ছিল- না। তিনিও তখন ওসব নাম জানতেন না। তিনি সেখানে করোটির ভেতর একটি সংকেত পেয়েছিলেন। গল্পটি বুকে হেঁটে হেঁটে এগোচ্ছিল। করোটি সংকেত দিল টেক-অফের। তখন গল্পটি পেয়ে গেল ভিন্ন এক মাত্রা।
যাত্রাপালা নিয়ে উচ্ছ্বসিত ছিলেন। মানুষের সাথে যাত্রাপালা কেমনভাবে সংযোগ স্থাপন করতে পারে, তার উদাহরণ হিসেবে বলেছিলেন মানিকগঞ্জের এক অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতার কথা। যাত্রাপালায় দেখানো হচ্ছে অসুস্থ এক সন্তানের শয্যাপাশে বসে আছেন অসহায় মাতা। গরিবের গরিব, তস্য গরিব। সন্তান বলছে, মা আমি বাঁচতে চাই, আমাকে বাঁচাও! আমার চিকিৎসা করাও। টাকা জোগাড় করো যেভাবে পার। দোহাই মা আমাকে বাঁচাও!
মৃত্যুশয্যায় শায়িত সন্তানের আকূলতা উদ্বেল করে তুলেছে দর্শকদের। সন্তানের বারংবার অনুরোধে আঁচল পেতে ভিক্ষা করতে বেরুলেন মাতা। আঁচল পেতে ‘ভিক্ষা দাও গো পুরবাসী’ গানের সাথে মঞ্চে একপাক ঘুরলেন মাতা। দেখা গেল তার আঁচল পরিপূর্ণ হয়ে গেছে দুই টাকা, পাঁচ টাকা, দশ টাকা, ৫০ টাকার নোটে। দর্শকরা যাত্রাপালার সাথে একাত্ম হয়ে সত্যিসত্যিই টাকা তুলে দিয়েছেন অসহায় মাতার আঁচলে।
আজও কি এমন একটা কথোপকথন হবে না সৈয়দ হকের সাথে?
সৈয়দ হক নিথর শুয়ে আছেন কফিনের ভেতরে। আনুষ্ঠানিকতা চলছে তো চলছেই। রাষ্ট্রপতি এসে শুরু করে দিয়ে গেছেন আনুষ্ঠানিকতা। তারপর একের পর মন্ত্রী-মেয়র-নেতা। বেশিক্ষণ একটানা দাঁড়িয়ে থাকলে আমার মাথা ঘোরে। শরীর ঘামতে থাকে একটানা। তাই বসে আছি শহীদ মিনারের বেদীর পেছনে ভেজা দেয়ালের ওপর। দেখছি অসংখ্য মানুষের আসা। ফুল হাতে, মালা হাতে, শ্রদ্ধাঞ্জলির ব্যানার হাতে। কোনো ব্যানারে শ্রদ্ধাঞ্জলি লেখা হয়েছে ‘শ্রদ্ধাঞ্জলী’ বানানে। সরকারি দলের সব অঙ্গসংগঠন আর সহযোগী সংগঠন আসছে। তারা হয়তো জানেও না সৈয়দ শামসুল হক কে। নিশ্চিতভাবেই বলা চলে যে সিংহভাগই কোনোদিন পাঠ করেনি সৈয়দ হকের কোনো রচনা। কিন্তু তারা আসছে। আমার মন বিদ্রূপ করে। যেহেতু স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী তাঁর জন্মদিনের অনুষ্ঠান বাতিল করেছেন সৈয়দ হকের মৃত্যুর কারণে। কাজেই তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে না এলে প্রধানমন্ত্রীর কাছে নম্বর কমে যেতে পারে। সেই ভয়েই তাদের জমকালো আগমন। আবার নিজেকে ভর্ৎসনাও করি। হয়তো সত্যিসত্যিই তারা কবিকে ভালোবেসে এসেছে শহীদ মিনারে।
অসংখ্য লেখক-কবি-নাট্যকার এসেছেন। কবির কফিনে ফুল দিয়ে এসে আলাদা আলাদা গুচ্ছ করে আড্ডা দিচ্ছেন। সিগারেট-চা চলছে। টেলিভিশনের ক্যামেরা নিয়ে দৌঁড়াচ্ছে রিপোর্টাররা। বিখ্যাত মনে হলে তার সামনে দাঁড়াচ্ছে শোক-প্রতিক্রিয়া শোনার জন্য। মুহূর্তে মুখের হাসি নিভিয়ে তাঁরা শোকভেজা কণ্ঠে টিভি ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে বলে চলেছেন, বাংলাসাহিত্যের কতটা ক্ষতি হয়ে গেল সৈয়দ হকের চির বিদায়ে।
সেলফি তোলা হচ্ছে এককভাবে, দলগতভাবে। বেশ একটা মিলনমেলাও বটে। সৈয়দ হকের মৃত্যু এই মিলনমেলার সুযোগ করে দিয়েছে। কেউ কেউ ক্ষোভ প্রকাশ করছেন, কেন এখানে সৈয়দ শামসুল হকের কবিতাপাঠ চলছে না? যার দখলে লাউডস্পিকার, তিনি কেবল সেসব বিখ্যাত মানুষের নাম ঘোষণা করে চলেছেন, যারা ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে এসেছেন।
একবার ভাবলাম, হক ভাই তো শুয়ে আছেন। আমি যে ঠিক কোন জায়গাতে বসে আছি, তা তিনি দেখতে পাচ্ছেন না। যাই, বরং আনোয়ারা আপাকে বলে আসি যে আমি ওই জায়গাতে বসে আছি। ফাঁক পেলেই তিনি এবং হক ভাই যেন আমাকে ডেকে নেন।
আমি ভিড় ঠেলে কফিনের উল্টোপাশে যাই। একটানা দাঁড়িয়ে আছেন পরিবারের কয়েক সদস্যকে সঙ্গে নিয়ে আনোয়ারা আপা। নাহ! আজ আর সেই খণ্ড বিচ্ছিন্ন আড্ডা হবে বলে মনে হচ্ছে না। আমি আপার কানের কাছে মুখ নিয়ে জিগ্যেস করি- একটু পরে তো কুড়িগ্রামে যাবেন। আপনি ফিরবেন কবে?
আপা বলেন- আজকেই। তোমার ভাইকে শেষ বিশ্রামে রেখে সাড়ে ৪টাতেই ফিরে আসব। একই হেলিকপ্টারে।
বলি- আমি তাহলে এখন চলে যাই?
যাও।
আমি ঘরে ফিরতে উদ্যোগী হই। ঘরে অন্তত হক ভাইয়ের সাথে একাকী কথা বলতে পারব!