সক্রাতেসের বিদায় ও মতিন বৈরাগীর দায়
‘ধর্মগুরু, রাজনীতিবিদ, আর কবি একালের এই তিন বিস্ময়।’
—মতিন বৈরাগী
মহাত্মা মতিন বৈরাগী কবিতা লিখিতেছেন—বলা ভালো প্রকাশ করিতেছেন—কম করিয়া বলিলেও আজ চল্লিশ বছর। তাঁহার প্রথম বই—‘বিষণ্ণ প্রহরে দ্বিধাহীন’ (১৯৭৭)—যখন প্রকাশিত হয় তখনও আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। আমরা তখন তাঁহাকে ‘বামপন্থী’ বলিয়াই জানিতাম। এখনও দেখিতেছি তিনি সেই পথ ছাড়েন নাই। ২০০৮ সালে তাঁহার ‘কবিতা সমগ্র’ ছাপা হয়। তিনি এই বহির একটা খণ্ড আমাকে স্বাক্ষরসহ দান করিয়াছিলেন। সেই ঋণ শোধ করা আমার পক্ষে আজও সম্ভব হয় নাই। এ বছর—এই নবেম্বরে—তিনি সত্তর বছর পূর্ণ করিবেন। সুখের মধ্যে গত ফেব্রুয়ারি মাসে তাঁহার ‘নির্বাচিত কবিতা’ বর্ধিত কলেবরে বাহির হইয়াছে। এই বহিটিরও একটি খণ্ড আমি আদায় করিতে সক্ষম হইয়াছি।
মতিন বৈরাগীর কবিতার অধিক গভীরে প্রকাশ করিব এমন হিকমত পরম করুণাময় আমাকে দান করেন নাই। তারপরেও জানিতাম তাঁহার ঋণটা স্বীকার করিবার একটা না একটা উপায় তিনি বাতলাইয়া দিবেন। এই আশায় গত প্রায় এক মাস ধরিয়া তাঁহার ‘নির্বাচিত কবিতা’ (২০১৬) বইটা নাড়াচাড়া করিতেছিলাম। ভাবিতেছিলাম এমন বড় কবির কবিতা লইয়া অতি ছোট কোন নিবন্ধ লেখা কি শোভন হইবে? আল্লাহতায়ালা একটা পথ শেষ পর্যন্ত বাতলাইয়াছেন। তাই সাহস করিয়া কলম ধরিয়াছি। এখানে বলিয়া রাখি, ছোটবেলার মতো আমি এখনও কালিওয়ালা কলমেই লিখি—আর লিখি নিজের হাতেই।
মতিন বৈরাগীর ‘নির্বাচিত কবিতা’ হইতে আমি—নিজের দায়িত্বে—একটি কবিতা নির্বাচন করিয়াছি। কবিতার নাম ‘সক্রেতিস-ক্রিতো সংলাপ’। খোঁজখবর লইয়া দেখিলাম কবিতাটি কবির ‘খরায় পীড়িত স্বদেশ’ নামক গ্রন্থেই (১৯৮৬) প্রথম ছাপা হয়। তখন দেশের বাহিরে ছিলাম বলিয়া কবিতাটি আগে আমার পড়া হয় নাই। কবির ‘কবিতা সমগ্র’ নামক সংগ্রহে ‘খরায় পীড়িত স্বদেশ’ কাব্যটি অন্তর্ভুক্ত হইয়াছে। তাই কবিতার আদি পাঠটিও আমি এক্ষণে পড়িবার সৌভাগ্য অর্জন করিয়াছি। দেখিলাম দুই পাঠের মধ্যে কিছু কিছু পরিবর্তনও তিনি করিয়াছেন। আমার এই আলোচনায় তাঁহার সর্বশেষ পাঠটাই অনুসরণ করিতেছি।
এখানে প্রসঙ্গক্রমে বলিয়া রাখিতে চাই, তিনি ইংরেজি রীতি অনুসারে তাঁহার কুশীলবের নাম ‘সক্রেতিস’ ও ‘ক্রিতো’ লিখিয়াছেন। আমি খোদ গ্রিক উচ্চারণের আভাস দিবার অভিলাষে ইঁহাদের নাম লিখিলাম যথাক্রমে ‘সক্রাতেস’ ও ‘ক্রিতোন’।
১
সকলেই জানেন এথেন্সের জগদ্বিখ্যাত মনীষী সক্রাতেসকে যখন মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় তখন তাহা সঙ্গে সঙ্গেই কার্যকর করা হয় নাই। ঐ দেশের প্রচলিত কোন এক প্রথার সম্মানে মাঝখানের কয়েকটা দিন—প্রায় একমাস—তাঁহাকে কারাগারে কাটাইতে হইয়াছিল। মৃত্যুদণ্ডটা যেদিন কার্যকর করা হইবে তাহার মাত্র একদিন আগে এই মনীষীর অকৃত্রিম বন্ধু ও অবস্থাসম্পন্ন গ্রিক নাগরিক ক্রিতোন (ইংরেজিতে ‘ক্রিটো’) তাঁহার সম্মুখে উপস্থিত হইয়া প্রস্তাব করিলেন তিনি যদি রাজি থাকেন তো বন্ধুরা তাঁহাকে চোরাইপথে পাশের দেশ থেসালি লইয়া যাইবেন। ক্রিতোনের এই প্রস্তাবে—যাহাকে ইংরেজি ভাষায় বলা হয় ‘গ্যাওল-ব্রেকিং’—সক্রাতেস মোটেও রাজি হন নাই। সক্রাতেসের যুক্তি ছিল এইরকম : যদিও তাঁহাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়াটা সিদ্ধান্তস্বরূপ বিলকুল অন্যায় হইয়াছে তথাপি তিনি এই সিদ্ধান্ত মানিয়া লইয়াছেন। কারণ খোদ সিদ্ধান্তটা গ্রহণ করা হইয়াছিল আইনসম্মত পদ্ধতিতেই। এই অবস্থায় তাঁহার পক্ষে পলাইয়া প্রাণ বাঁচানোর কোন অর্থ থাকিতে পারে না। আপন প্রাণ বাঁচাইবার জন্য তিনি স্বয়ং রাষ্ট্রের আইন অর্থাৎ আইনের শাসন প্রত্যাখ্যান করিতে পারেন না।
বন্ধু ক্রিতোন তখন তাঁহাকে অনেক বুঝাইবার চেষ্টা করিলেন। বুঝাইলেন, কেন তখনও তাঁহার বাঁচিয়া থাকার দরকার আছে। কারণ অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রামটা তো শেষ হয় নাই। সক্রাতেস কিছুতেই সেই বুদ্ধিটা আমলে লইলেন না। সেদিন ভোরবেলা—বলা হয় সুবেহ সাদেকের প্রহরে কারা প্রকোষ্ঠে—দুই বন্ধুর মধ্যে যে কথাবার্তা হইতেছিল তাহার একটা ভাষ্য অন্যান্যের মধ্যে সক্রাতেসের তরুণ অনুসারী প্লাতোন (ইংরেজিতে যাহাকে বলে ‘প্লেটো’) লিখিয়া রাখিয়াছিলেন। সেই ভাষ্য হইতে সারাংশ চয়ন করিয়া মতিন বৈরাগী একটি নতুন ভাষ্য লিখিয়াছেন। লিখিয়া আমাদের ঋণী করিয়াছেন। এই ঋণ অনাদায়ে আমাদেরও অন্যত্র দণ্ড হইতে পারে—এই ভয়ে এই কয় ছত্র লিখিয়া রাখিলাম।
বৈরাগীর কবিতা ‘সক্রেতিস-ক্রিতো সংলাপ’ শুরু হইয়াছে সক্রাতেসের ধনাঢ্য বন্ধু ক্রিতোনের বাক্য দিয়া। তাঁহার প্রস্তাব—এথেন্সের পাশের দেশ থেসালি সক্রাতেসকে খোশ আমদেদ জানাইবার জন্য গ্রীবা উঁচু করিয়া বসিয়া রহিয়াছে। মতিন বৈরাগী তাই ক্রিতোনের জবানে লিখিতেছেন, ভিনদেশেও সক্রাতেসের সম্মান সমানেই অক্ষুণ্ণ থাকিবে। কারণ রাজা স্বদেশে মাত্র আর বিদ্বান পূজিত হন সর্বত্র। বৈরাগীর ক্রিতোন বিসমিল্লা হয় বলিতেছেন :
প্রিয় বন্ধু, অমত করো না ভাই।
ভাবছ এথেন্স ছেড়ে চলে গেলে কে দেবে সম্মান!
কে বলবে সক্রেতিস মহাজ্ঞানী এথেন্সের শ্রেষ্ঠ সন্তান!
থেসালিতে আমাদের বন্ধুস্বজন
অধীর আগ্রহে তোমার অপেক্ষায়
তোমাকে পেলে জীবন ধন্য মনে করে
তোমার সম্মানে তারা বোধ করে সম্মান।
ইহার জওয়াবে সক্রাতেস নিরুত্তরই থাকেন। তাই ক্রিতোন সঙ্গে আরও কিছু নতুন যুক্তি যোগ করেন। ভূমিকাস্বরূপ তিনি বলিলেন, একদিন পর তাঁহার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার কথা স্থির হইয়াছে। কেননা দেলোস হইতে জাহাজ ফিরিয়া আসিয়াছে। ঘাটে সিঁড়ি নামিতে বিশেষ দেরি নাই। এখনই কিছু একটা করার শেষ সময়। ক্রিতোন এক্ষণে আত্মসম্মান বাঁচাইতে একটু বেশি ব্যস্ত—যাহাকে বলে ব্যতিব্যস্ত—হইয়া উঠিলেন। বলিলেন :
... আমরা তোমার বন্ধু, বিজ্ঞ বলে জানে দেশবাসী
একদিন ধিক্কার দেবে, বলবে বাঁচালে বাঁচাতে পারতো ওরা
এমন তো কিছু নয়, দিয়ে দিতে পারতো কিছু অর্থদণ্ড,
বলবে অর্থকেই ভালোবাসে ওরা, সক্রেতিস কেউ কিছু নয়,
মিথ্যের মানুষ আমরা, তোমাকে ঘিরে লুটেছি সুযোগ যশ আর সুনামের।
এই যুক্তিতেও যখন কাজ হয় নাই তখন ক্রিতোন তাঁহার তূণ হইতে শেষ তীরটি বাহির করিলেন। এই তীর বা যুক্তির নাম অন্য কিছু—খ্যাতি নয়, প্রতিপত্তি নয়, অর্থবিত্ত নয়, ভয় কিংবা করুণাও নয়। এই তীরেরই আরেক নাম সত্য বা বিপন্ন বিস্ময়। ক্রিতোন বলিলেন, এই সত্যের খাতিরে হইলেও তোমাকে পলাইতে হইবে। তাই তিনি সক্রাতেসকে স্মরণ করাইয়া দিলেন :
তুমিই তো বলেছিলে মেলিতাস মিথ্যুক, আমাকে নয়
তারা ভবিষ্যৎ যোগ্য উত্তরাধিকারহীন করতে চায় রাষ্ট্র
আর সত্যকে চায় নির্বাসন দিতে
কারণ প্রতিটি সত্য থেকে নতুন সত্যের জন্ম হয়
আমার সত্য তাই তরুণেরা গ্রহণ করে নিঃসংকোচে
আর আমি তাদের সেই সত্য শেখাই
যাতে তারা মিথ্যুক, ভণ্ড রাজনীতিবিদ, আর অকারণ ধর্মগুরু থেকে দূরে থাকে।
সক্রাতেসের উদ্দেশে একপ্রকার চ্যালেঞ্জই ছুঁড়িয়া দিলেন ক্রিতোন। রাষ্ট্রের এই ক্রান্তিকালে তাঁহার বাঁচিয়া থাকার দরকার আছে। এ সত্য কি তিনি অস্বীকার করিতে পারেন?
সারাজীবন সত্যের সন্ধান করে মৃত্যুকে নিশ্চিত জেনে নোয়াওনি মাথা
মাননি অন্যায় বিধান, তবে কেন আজ নিরুদ্বিগ্ন রয়েছ?
২
মহাত্মা সক্রাতেসের মতে যাহারা সেদিন তাঁহার এই মৃত্যুদণ্ডের রায় মঞ্জুর দিয়াছিলেন তাহারা ‘সমাজদ্রোহী’ এবং ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ বিশেষ। অথচ রাষ্ট্রটা আজ তাহাদেরই হাতে। তিনি ইহাও মনে করেন যে তাঁহার বর্তমান বিচারকরা ‘আদালতের ক্রীড়নক’ ও ‘ভণ্ড বিচারক’ মাত্র। তাহারাই রাষ্ট্র নহেন। তারপরও যে যুক্তিতে তাহাদের কাছে সেদিন আদালতে জীবন ভিক্ষা চাহেন নাই সেই এক যুক্তিতেই আজও অনড় তিনি। আর পলায়ন করিবেন না তিনি। করিলে যে আইনের তিনি অনুগত সেই আইনেরই অবমাননা হয়। তিনি যদি তাঁহাকে দেওয়া বর্তমান দণ্ডের কারণে ক্ষমাপ্রার্থনা করিয়া কিংবা পলাইয়া যাওয়ার মাধ্যমে প্রাণ বাঁচাইতে চেষ্টা করেন তবে এতদিন তিনি যে সত্য প্রচার করিয়া আসিতেছিলেন—অর্থাৎ অন্যায় অপেক্ষা ন্যায় ভালো—নৈরাজ্য অপেক্ষা রাষ্ট্র ভালো- সেই সত্যের অবমাননা হয়। এখানে সক্রাতেসের শিক্ষাটা হইল যদি কোন আইন স্বয়ং অন্যায়জনক আইন হইয়া থাকে তবে তাহা অমান্য করা চলিবে। কিন্তু খোদ আইনটা যদি সঠিক হইয়া থাকে তো তাহা মানিতেই হইবে। সঠিক আইনের অপপ্রয়োগ হইতেও পারে। এহেন অবস্থায়ও কিন্তু আইন অমান্য করা চলিবে না।
আমাদের মহাত্মার ধারণা, ‘ধর্মগুরু, রাজনীতিবিদ, আর কবি একালের এই তিন বিস্ময়’। অথচ তিনি জানেন সেদিনের এথেন্সে এই তিন পদাধিকারীদের কেহই ‘প্রকৃত জ্ঞানী’ ছিলেন না। তাঁহার ভাষায়, এ যুগের কোন রাজনীতিবিদ আর জ্ঞানার্জনের ক্লেশ স্বীকার করেন না। ‘কারণে অকারণে জ্ঞানের বড়াই ছাড়া’ তাঁহাদের কেহই ‘এক কাচ্চা মিঠেল কথন’ কহিতে শেখেন নাই। এই রাজনীতিবিদেরা শুদ্ধ ক্ষমতার লোভে ‘সারাটি জীবন মিথ্যে আস্ফালন’ করিতেছেন আর দিনাতিপাত করিতেছেন ‘যুবাদের গঠিত শক্তির’ অপচয় চিন্তায়। এই যুবকরা যদি আজ আত্মঘাতী হইয়া নিজেরাই নিজেদের বিনাশ না করে তো একদিন তাহারা স্বার্থের দরজা ভাঙ্গিয়া ঢুকিয়া পড়িবে। সেই আতংকেই তাঁহারা সক্রাতেসের প্রাণ লইতেছেন।
ওদিকে ধর্মগুরুরা ‘কিছু কিছু মন্ত্র আর দেবতাদের নামধাম ঠিকানা-নিবাস’ মুখস্ত করিয়াছেন বটে কিন্তু তাঁহাদেরও কোন গূঢ়জ্ঞান নাই। তাঁহারাও জানেন না ‘জীবনের গভীরতম মানে’ কি। আর কবিদের কথা আরো শোচনীয়—বলিবার মতন নহে।
আশ্চর্য মানুষ ওরা
কিছুটা বিচ্ছিন্ন, কল্পনাপ্রবণ, ভাববিলাসী, চলনে বলনে বিভ্রম
কবিরা যা বলেন তার সাথে নেই তার মিল।
এত কথার পরেও তো এ কথা সত্য যে তিনি এতদিন ইহাদের সহিতই একই রাষ্ট্রে বসবাস করিয়া আসিতেছেন। এ সত্য জানা সত্ত্বেও তো তিনি ইঁহাদের বিচার, ইঁহাদের রায়, ইঁহাদের দেওয়া দণ্ড—মোটা ভাত আর মোটা কাপড়ের মতন—মাথা পাতিয়া লইয়াছেন। তাঁহার পক্ষে পলায়ন অসম্ভব, কেননা পলায়নে পরাজয়। তিনি বরং ধ্বংস হইবেন, পরাজয় বরণ করিবেন না। ক্রিতোনের সব যুক্তি তিনি শেষমেষ নাকচ করিলেন এই এক যুক্তিতেই।
তো সক্রাতেসের অন্ধের যষ্ঠি সেই শেষ যুক্তিটি কি? তিনি পলাইবেন কি পলাইবেন না তাহার সিদ্ধান্তও তিনি পাইয়াছেন জনৈক দৈবের সুবাদে। সেই দৈবে তাঁহার বিশ্বাস অটল। দৈব তাঁহাকে পলাইতে না করিয়াছেন। তাই তিনি পলাইবেন না। তাঁহার শেষ যুক্তি এই দৈববাণীর—তাহার অন্তর্যামী দেবতার—নির্দেশ। তিনি জানাইতেছেন :
কিছু আগে এ বিষয়ে আমি স্বপ্নে দেখেছি
আমি জানি জ্ঞানের গভীরের ধ্বনি হবে না বিফল
আরও একদিন আমি আছি এথেন্সের মাটির উপর।
শুদ্ধ ভোগ আর জীবনের লোভে তিনি আর ভিনদেশে যাইবেন না। যাইতে পারেন না। প্রাণ বাঁচাইবার এই শেষ পথটিও তিনি গ্রহণ করিবেন না। এইভাবে দেশ ছাড়িয়া যাওয়া—মহামতি সক্রাতেসের মতে—‘জীবনের অপচয়’। তিনি মনে করেন জীবনের অপচয়ের চেয়ে মৃত্যুই শ্রেয়।
৩
আমি অনেকক্ষণ অবাক হইয়া ভাবিয়াছি আমাদের মহাত্মা মতিন বৈরাগী কি ভাবিয়া—কোন দুঃখের ভারাক্রান্ত হইয়া—সক্রাতেসের এহেন বিদায়বাক্য এমন আপনার করিয়া লইয়াছেন। কোন অপত্যস্নেহে কিংবা কোন দেবতার নির্দেশে? তিনি কি কখনো জানিতে চাহিয়াছিলেন, সক্রাতেসকে মৃত্যুদণ্ড বরাদ্দ দিয়াছিলেন যাঁহারা তাঁহারাই বা কাঁহারা? তাঁহারা কি একান্তই বিপথের লোক? না তাঁহাদের মধ্যেও খোদ সক্রাতেসের মতনই দায়িত্ববান নাগরিক কেহ কেহ ছিলেন?
এই প্রশ্ন করিবার অবকাশ যদি নাও বা থাকে, আরও কিছু প্রশ্ন তো প্রাণ হইতে প্রাণান্তরে জাগিতেই পারে। সক্রাতেসের এই অন্যায় মৃত্যুদণ্ডের প্রতিবাদে সেদিন কি সেদেশে সত্যি সত্যি কোন বড় ধরনের প্রতিবাদ, বিদ্রোহ বা বিপ্লব ঘটিয়াছিল? সেদিন না হউক অনেকদিন পরও কি? যদি না ঘটিয়া থাকে, কেন ঘটে নাই? সেদিন এথেন্স কিংবা অন্য দশ গ্রিক রাষ্ট্রে কি—লোকে আজিকালি যেমন বলিয়া থাকে তেমন ধাঁচার—গণতান্ত্রিক সমাজ বিরাজমান ছিল? জাতীয় সমাজ যেখানে গণতান্ত্রিক নহে, সেখানে রাষ্ট্র কিভাবে গণতান্ত্রিক হইতে পারে? কবিও কি এ সকল কথা ভাবিতে পারেন না?
ভারতবর্ষের প্রসিদ্ধ ইতিহাসবিদ মহারাষ্ট্রীয় পণ্ডিত দামোদর ধর্মানন্দ কোসাম্বি একদা সক্রাতেসের বিচার প্রসঙ্গে নাতিদীর্ঘ একটা নিবন্ধ লিখিয়াছিলেন। সেই নিবন্ধযোগে তিনি জিজ্ঞাসা করিতেছিলেন, সক্রাতেস যে দেবতা বা দৈববাক্যের দোহাই দিয়া আপনকার সকল সিদ্ধান্তের পক্ষে সর্বদা সাফাই গাহিতেন সেই দেবতা বা দুর্দৈব কি তাঁহাকে কোনদিন একথা বলিয়াছিলেন ঐ দেশের সিংহভাগ মানুষ কি কারণে, কোন দোষে দাসজীবন যাপনে বাধ্য? যে স্বাধীনতার স্পৃহা থাকায় গ্রিসের স্বাধীন নাগরিক সমাজ মহাপ্রতাপশালী পারস্য সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে জয়ী সেই স্পৃহা হইতে তাহাদের দাসানুদাসরা কেন বঞ্চিত হইল? এ কথা কি তিনি কোনদিন ভাবিয়াছিলেন? তিনি কি আরো ভাবিয়াছিলেন সারা পৃথিবীতেই চিরদিন একশ্রেণীর লোক থাকিবে যাঁহারা তাঁহারই নাম ভাঙ্গাইয়া সাধারণের স্বার্থহানি করিবে?
বিচারের প্রথম রায়টা প্রকাশের পর মহাত্মা সক্রাতেসকে সসম্মানে বলা হইয়াছিল, ‘আপনি হয়তো চুপচাপ থাকিবেন, নচেৎ আপনার প্রাণ যাইবে।’ প্রাণটাই দিতে তিনি রাজি হইলেন। কেননা তাঁহার পক্ষে নিরব থাকাটা মোটেও সম্ভব ছিল না। অথচ কে না জানে এই প্রশ্নে সক্রাতেসের তরুণ অনুসারীরাও সেদিন নিরব থাকিতেই প্রস্তুত হইয়াছিলেন। আর এথেন্সের অভিজাত শ্রেণীও সক্রাতেসের মৃত্যুদণ্ডটা সরবে মানিয়া লইয়াছিল—একথা কি ঐতিহাসিক সত্য নয়? মহাত্মা মতিন বৈরাগীর বয়সও আজ সক্রাতেসের সমান ভারে আক্রান্ত। আর তাঁহার কবিতার শেষেও সক্রাতেসের বিদায় ভাষণের সেই দায়ই আজ সমান শূন্যতায় খা খা করিতেছে।
আমাদের যুগের অনেক স্বাধীনতা ব্যবসায়ী (প্রচলিত ভাষায় ‘উদারনৈতিক বুদ্ধিজীবী’) মনে করেন সক্রাতেসকে যাঁহারা প্রাণদণ্ড দান করিয়াছিলেন তাঁহারা ঘোরতর অন্যায় করিয়াছিলেন। মহাত্মা মতিন বৈরাগীর কবিতা পড়িয়া আমার—এই অধম লেখকের—মনে হইতেছে সক্রাতেসের শত্রুরা তাঁহাকে অতটা মারেন নাই যতটা তিনি নিজেই নিজেকে হত্যা করিয়াছিলেন। স্বীকার করি, তাঁহার এই আত্মহত্যার কারণও ছিল। অবশ্য বিশেষ মনে রাখিতে হইবে, প্লাতোনের বিবরণ অনুসারে, সক্রাতেসের বিচারের দিন দুই দফা ভোটাভুটি হইয়াছিল। প্রথম দফায় সাব্যস্ত হইয়াছিল, যে অভিযোগে তাঁহার বিচার বসিয়াছে সে অভিযোগে তিনি দোষী কিনা। তিনি দোষী সাব্যস্ত হইয়াছিলেন। দ্বিতীয় দফা ভোটাভুটির আগে তাঁহাকে কোন শাস্তিটা তিনি বাছিয়া লইবেন—নির্বাসন না প্রাণদণ্ড—তাহা জানাইতে বলা হইয়াছিল। সকলেই জানেন এই দফায় তিনি কোন দণ্ডটা শ্রেয় মনে করিয়াছিলেন।
এই কারণেই অনেকেই মনে করেন মহাত্মা সক্রাতেসও একালের অনেকের মতো আত্মঘাতী হইয়াছিলেন। ক্রিতোর সহিত শেষ আলাপনেও তাহার প্রমাণ পরিষ্কার। মতিন বৈরাগীর বয়ানেও দেখি সক্রাতেস শেষ পর্যন্ত ইহা স্বীকার করিয়া লইয়াছিলেন।
আরো বলো
জীবন বড়ো সাধারণ, ক্ষণস্থায়ী, তাই সে এতো মহান
ক্রিতো, রাত শেষ আগামী সূর্যোদয় অবধি আমি আছি
অকারণে দুঃখ নিয়ো না, আরও আলাপন আছে
এতটুকু বাড়তি সময়ে সেগুলোও জেনে নিতে চাই পরস্পরে।
নিশ্চিন্তে ঘুমাও কিছুক্ষণ, মস্তিষ্কের বিশ্রাম সুন্দর চিন্তার কারিগর,
জানুক এথেন্স আমি সক্রেতিস ভিন্ন কিছু নই, কেবল তাদেরই সন্তান।
অন্তত মিথ্যুক রাজনীতিবিদ, ধর্মগুরু আর ভণ্ড বিচারকদের কাছে নত করিনি তাদের,
চাইনি জীবন ভিক্ষে, পালাইনি ভিন দেশে,
অন্তত দেশের মাটিকে ভালোবাসি বলে জীবনকেও বড় মানিনি-
যাব না কোথাও।
এই কারাগারে তোমাদের সাথে যে কিছুটা সময় আমি পাব
তার অধিক আর চাইনে কিছু বিশ্ব-সংসারে
বিদায় বন্ধু, হে বন্ধু মোর, বিদায়।
২৬ অক্টোবর ২০১৬
দোহাই
১. মতিন বৈরাগী, কবিতা সমগ্র (ঢাকা : প্যাপিরাস, ২০০৮)।
২. মতিন বৈরাগী, নির্বাচিত কবিতা, বর্ধিত সংস্করণ (ঢাকা : দেশ পাবলিকেশন্স, ২০১৬)।
৩. Plato, Defence of Socrates, Euthyphro, and Crito, trans. David Gallop, reprint (Oxford: Oxford University Press, 2008).
৪. D. D. Kosambi, ‘On the Trial of Sokrates (1983)’, in Meera Kosambi, ed. Unsetttling the Past: Unknown Aspects and Scholarly Assessments of D. D. Kosambi (Ranikhet Cantt.: Permanent Black, 2013), pp. 47-53.