উপন্যাস পর্ব ৪
বাবা আছে, বাবা নেই
একা পুকুরঘাটে দাওয়ায় বসে ভাবি। আমার মতো অপয়ার জন্য মাকে এত কষ্ট পেতে হচ্ছে। কখনো ভাবি, আমি পৃথিবী থেকে চলে গেলেই তো সব শেষ হয়ে যায়। কে যেন এই ভাবনাটা বারবার উসকে দিচ্ছে। বাকিউলের মতো একজন লম্পটকে বিয়ে করার চেয়ে জীবন নিয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়াই ভালো। নাকি কোথাও পালিয়ে যাব? পালিয়ে আর কোথায় যাব। হাজারো বাকিউল সমাজে ওত পেতে আছে। ওদের জিহ্বা লকলক করছে। লালা যেন বারো মাস ঝরে। নাগালে পেলে চেটে চেটে খায়। পত্রিকার পাতা ওল্টালেই ও রকম খবর নিত্য দেখা যায়, হিংস্র জন্তু-জানোয়ারের থাবায় নিজেকে সঁপে দেওয়ার চেয়ে শেষ করে দেওয়াই শ্রেয়। এ ভাবনাটাই আমার মাথায় ঘুরেফিরে আসছে।
পুকুরঘাটেই বসেছিলাম। ভাবছি আর ভাবছি। বৃষ্টিভেজা গাছের পাতাগুলো বেশ সুন্দর দেখাচ্ছে। কিন্তু সে সৌন্দর্যটাও আমার কাছে কেমন রসহীন, গন্ধহীন, প্রাণহীন মনে হচ্ছে। প্রকৃতি কি থেমে গেছে। তাই তো মনে হচ্ছে। হঠাৎ আমার নগ্ন পা যুগলের দিকে চোখ গেল। ডান পায়ের পাতার কার্নিশে একটি জোঁক কুঁচকে আছে। রক্ত চুষে জ্যাবজ্যাবে হয়েছে। বাঁ হাতে জোঁকটিকে টেনে মাটিতে আঁছড়ে ফেললাম। জোঁকটা কুঁচকে আছে। পায়ের পাতার কার্নিশে যেখানটায় কামড়ে ধরেছিল, সেখান থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। বুঝতে পারলাম, প্রকৃতি তার নিজস্ব গতিতেই চলছে। না হলে জোঁক রক্ত চুষতে পারত না।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। মা ডাকছে। শিমু পুকুরঘাটে এসেছে হাত-মুখ ধুতে।
অ্যাই আপু, তোকে মা ডাকছে। বলল শিমু।
যাচ্ছি।
কিছুটা উঠে দাঁড়িয়েছি। যাব। এ সময় শিমু বলল, হাত-মুখ ধুয়ে যা।
ও। হ্যাঁ।
আচ্ছা আপু, তোকে একটা কথা বলি।
বল।
তুই বাবার সঙ্গে কথা বলিস না কেন?
শিমু। হাত-মুখ ধুয়ে পড়তে বস গে। যা।
বল না আপু।
তোকে এ কথা কে শিখিয়ে দিয়েছে?
কেউ শেখায়নি। বাবাও না।
সারাক্ষণ বাবা বাবা করিস না তো। চুপ কর।
বল না, কী হয়েছে।
তোর বাবা আমাকে বাড়ি থেকে তাড়াতে চাইছে। কথাটা বলেই হনহন করে হাঁটা দিই। প্রচণ্ড বিরক্তিতে মাথাটা ঝিম ধরে যায়।
বারান্দায় হারিকেন জ্বলছে। মৌলানা শরাফত খান মসজিদে গেছেন। তিনি একেবারে এশার নামাজ শেষ করে মহল্লাবাসীর সঙ্গে শলাপরামর্শ সেরে তার পর বাড়ি ফিরবেন। মা রান্নাঘরে। হাঁড়ি-পাতিলের সঙ্গে নিয়মিত যুদ্ধ শুরু করেছেন। আমিও মার কাজে হাত লাগাই।
গামছায় হাত-মুখ মুছতে মুছতে শিমু আসে।
মা, কী খেতে দেবে দাও। শিমু বলল।
যা। পড়তে বস গে। তোর আপু নিয়ে আসবে। আচ্ছা মা, বাবা নাকি আপুকে এ বাড়ি থেকে তাড়াতে চাইছে। শিমু বলল।
তোকে কে বলল?
আমি বলেছি। বললাম আমি।
যা তো শিমু, যা। বারান্দার হারিকেনটা নিয়ে নিস। আর শোন, দরজাটা ভিঝিয়ে দিস। ছিটকানি লাগাস না।
আচ্ছা মা। শিমু কয়েক পা গিয়ে আবার ফিরে আসে।
মা। শিমু বলল।
আবার কী বলবি।
বাবা এলে কিন্তু আমি জিজ্ঞেস করব। আপুকে কেন তাড়াতে চাইছে।
তোর অত কিছু জিজ্ঞেস করতে হবে না। চালে পাথর বাছতে বাছতে বললাম আমি। আর কাউকে আমাকে তাড়াতে হবে না। আমি নিজেই চলে যাব।
বাজে কথা বলিস না তো। বলল মা। যা তো শিমু। আর শোন, তোর বাবাকে কিছু জিজ্ঞেস করিস না। যা।
শিমু চলে গেল। মা পেঁয়াজ-মরিচ দিয়ে মুড়ি ভাজছে।
মা।
বল।
পৃথিবীটা এত নিষ্ঠুর কেন মা?
পৃথিবী নিষ্ঠুর নয়রে মা। পৃথিবীর মানুষরাই বেশি নিষ্ঠুর। মা, তোমার এটুকু জীবনে পৃথিবীর কাছ থেকে তুমি কী পেয়েছ বল তো! নিষ্ঠুরতা, নির্যাতন, অবহেলা ছাড়া কিছুই তো পাওনি। অন্যের দয়ায় বেঁচে আছো। অসহায় জীবনকে এভাবে টেনে নেওয়ার কী মানে?
রাবু।
মা।
তুই দেখছি অনেক বড় হয়ে গেছিস। বড়দের মতো কত সুন্দর করে কথা বলছিস।
তোদের জন্যই তো বেঁচে আছি মা। মা বলল।
না মা, আমার কাছে সবকিছুই অর্থহীন মনে হচ্ছে। কোনো কিছুই ভালো লাগছে না। কথাটা বলেই শোবার ঘরে চলে আসি। এ ঘরে কুপি-হারিকেন কিছুই নেই। বারান্দার আলো বেড়ার ফাঁক দিয়ে ঢুকছে। বিছানা দেখা যাচ্ছে।
শুয়ে পড়ি আর নয়ছয় ভাবি। হঠাৎ আমার বুকে এক ঝটকা সাহস এসে ভর করে। যা করার, আজ রাতেই করব। চলে যাব। চিরতরে। অপরক্ত নিয়ে অভিশপ্ত জীবন টেনে লাভ নেই। রাজাকারের রক্ত আমার শরীরটাকে বিষাক্ত করে তুলেছে। আর নয়। না। আর নয়।
বিছানায় শুয়ে এলোমেলো ভাবছি। আচ্ছা, আজ রাতে যদি আত্মহত্যা করি, কাল সকালে এ বাড়িতে কী হবে। মা বুক ছাপড়ে কান্না করবে। শিমুও কাঁদবে। ওই ছোট্টটি আমাকে খুব ভালোবাসে। মাঝেমধ্যে খুনসুটি চলে। মৌলানা শরাফত খানের চোখে জল থাকবে না। তিনি হয়তো গালে হাত দিয়ে বসে থাকবেন। গ্রামের হাজারো মানুষ এসে ভিড় জমাবে। তাকে নানা প্রশ্ন করবে। তিনি চুপ হয়ে থাকবেন। পুলিশ আসবে। মা আর আমার জন্মদাতাকে ধরে নিয়ে যাবে। রিমান্ডে দেবে। বাকিউল নিরুদ্দেশ হবে। রিমান্ডে মা আমার জন্মদাতা মৌলানা আর বাকিউলকে দায়ী করবে। পুলিশ বাকিউলকে খুঁজবে।
আমার নিস্তেজ দেহটাকে নিয়ে যাওয়া হবে লাশকাটা ঘরে। ডোম ব্যবচ্ছেদ করবে এই দেহ। ওরা নাকি ফুসফুস, কিডনি, মগজ, আরো কত কী নিয়ে নেয়। আমার বেলায়ও হয়তো তাই করবে। মৌলানা শরাফত খানের কোনো দুঃখ হবে না। নিজে বাঁচার জন্য পথ খুঁজবেন।
পরিবার আর সমাজের চাপে পড়ে মায়ের স্বীকারোক্তি হয়তো ভিন্ন রকম হবে। মৌলানা শরাফত খান হয়তো এবারও নির্দোষ প্রমাণিত হয়ে বেরিয়ে আসবে। পরনের আলখেল্লায় হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়াবে। জনসমক্ষে বলে বেড়াবে, আল্লাহর মাল আল্লাহ নিয়ে গেছেন। আমাদের সবাইকেই তো যেতে হবে। কেউ আগে, কেউ পরে। এ ধরনের নাতিদীর্ঘ বক্তৃতা দিতেও ছাড়বে না।
রমা আর বিজয় ডাক্তার শুনে খুব বিস্মিত হবে। আমার জন্মদাতা একজন রাজাকার—এ পরিচয় নিয়ে আমি বেঁচে থাকতে চাইনি। কথাটা বিজয় ডাক্তার বুঝতে পারবেন। বেচারার খুব অনুশোচনা হবে। তারপরও তিনি জনসমাবেশে বলতে পারবেন। বাবা রাজাকার বলেই আমি আত্মহত্যা করেছি। কারণ, হিন্দুরা এ দেশে সংখ্যালঘু। সব কথা সব সময় বলতে পারেন না। সুযোগ থাকলেও অনেক সময় বলেন না। পাছে কী না কী হয়।
এরই মধ্যে শিমু রাতের খাবারের জন্য ডেকে গেছে। মাও একবার এসেছিল। খাবো না বলে জানিয়ে দিয়েছি। তারপরও মা বরাবরের মতো জোরাজুরি করল। কিন্তু গেলাম না। আমরা খেলাম কী খেলাম না, তাতে মৌলানা শরাফত খানের কোনো মাথাব্যথা নেই।
তিনি ধর্মকর্ম নিয়ে ব্যস্ত।
শিয়রের কাছে হারিকেনের শলতেটা ছোট করে দিয়ে মা আমার পাশে শুলো।
গায়ে হাত রেখে বলল, রাবু। ঘুমিয়ে পড়েছিস?
আমি চুপচাপ শুয়ে আছি। মা কবার ডাকল। আমার কোনো রা নেই। শেষমেশ মাও ঘুমিয়ে পড়ল। মার একটা হাত আমাকে জড়ানো।
(চলবে)