‘জ্ঞানের পরিধি বাড়াতে নন-ফিকশন বই পড়তে হবে’
উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্য হলো পুরোনো জ্ঞানের বিচার-বিশ্লেষণ, নতুন জ্ঞান সৃজন ও বিতরণ। ইতিহাস, দর্শন, সমাজবিজ্ঞান, রাজনীতি, অর্থনীতি প্রভৃতি বিষয়ে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে নন-ফিকশন গ্রন্থ সহায়ক ভূমিকা পালন করে। তাই শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের জ্ঞানের পরিধি বাড়াতে নন-ফিকশন বই পড়তে হবে। গতকাল বুধবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদ মিলনায়তনে ‘উচ্চশিক্ষায় নন-ফিকশন বই’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় বক্তরা এসব কথা বলেন।
বণিক বার্তা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত নন-ফিকশন বইমেলা উপলক্ষে সভাটির আয়োজন করা হয়। এ আয়োজনে নলেজ পার্টনার ছিল ভয়েস অব বিজনেস, বাংলাদেশ স্টাডি ফোরাম ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যারিয়ার ক্লাব।
আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। আলোচক হিসেবে আরো উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট সাংবাদিক ও কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগের অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক, সাহিত্য প্রকাশের প্রকাশক মফিদুল হক, সময় প্রকাশনের প্রকাশক ফরিদ আহমেদ, ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্লেষক মামুন রশীদ, ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেডের (ইউপিএল) মার্কেটিং অ্যান্ড বিজনেস ডেভেলপমেন্ট বিভাগের পরিচালক মাহরুখ মহিউদ্দিন প্রমুখ।
অনুষ্ঠানে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় শুধু পড়ার জায়গা নয়, জ্ঞান সৃষ্টির জায়গাও। আর সে জন্য বই পড়া প্রয়োজন, বিশেষ করে নন-ফিকশন বই। শিক্ষার্থীদের বই চেনাজানার সুযোগ করে দিতে হবে। সে ক্ষেত্রে বণিক বার্তা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের যৌথ প্রয়াসে আয়োজিত নন-ফিকশন বইমেলার আয়োজন সত্যিই প্রশংসনীয়। বিশ্ববিদ্যলয়ে নন-ফিকশন বইয়ের প্রচারে এ ধরনের মেলার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।’
আনিসুজ্জামান আরো বলেন, ‘ই-বুক আসার পর অনেকেই বলেছিল, প্রকাশিত বইয়ের চাহিদা কমবে। এ ক্ষেত্রে আমার মত হচ্ছে বইয়ের প্রিন্টেড কপির একটি বিশেষত্ব রয়েছে। প্রিন্টেড বই হাতে নিয়ে পড়ার মাঝে যে আনন্দ রয়েছে, তা ই-বুকে নেই।’
সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, ‘উচ্চশিক্ষার মূল উদ্দেশ্যই হলো পুরোনো জ্ঞানের বিচার-বিশ্লেষণ ও নতুন জ্ঞান সৃষ্টি। তত্ত্বীয় বিজ্ঞান ছাড়া ইতিহাস, দর্শন, সমাজবিজ্ঞান, রাজনীতি, অর্থনীতি প্রভৃতি উচ্চশিক্ষার বিষয়ে মননশীল নন-ফিকশন গ্রন্থই সহায়ক। এমনকি কবিতা, কথাসাহিত্য প্রভৃতির বিচার-বিশ্লেষণমূলক যেসব গ্রন্থ তাও নন-ফিকশন। কোন ভাষা কতটা উন্নত ও সমৃদ্ধ এবং জ্ঞানচর্চার জন্য কতটা উপযুক্ত, তা তার নন-ফিকশন সাহিত্য কতটা সমৃদ্ধ তা দেখেই বিচার্য। বাংলা ভাষার গত দেড়শ বছরের নন-ফিকশন সাহিত্য খুবই উন্নত।’
অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক বলেন, ‘বখতিয়ার খিলজি থেকে শুরু করে মীরজাফর পর্যন্ত সময়কালের ইতিহাস বিধৃত হয়েছে বঙ্কিমের উপন্যাসে যেটা আদতে ছিল ফিকশন, কিন্তু তা একদিক থেকে নন-ফিকশনের চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম হয়েছে। একটু খেয়াল করলে দেখা যায়, ঔপনিবেশিক যুগে মুক্তি আন্দোলনের যে সূচনা সেখানেও অনেক ফিকশনের ভূমিকা ছিল। তবে সে সময়টাতে নন-ফিকশন তথা জ্ঞানবিজ্ঞানের যে চর্চা ছিল, সেটা সময়ের আবর্তে কমে এসেছে বলেই আমরা সত্যেন বোস, জগদীশ চন্দ্র বসু, এমনকি কুদরাত-এ-খুদার মতো বিজ্ঞানী যেমন পাইনি, তেমনি কমে গেছে ওই ধরনের গ্রন্থাদির প্রকাশনা।’ এ ক্ষেত্রে তিনি সৃজনশীল ও মননশীল নামে প্রকাশনার যে শ্রেণীকরণ, তার বিরোধিতা করেন। তাঁর হিসেবে প্রকাশনা একই সঙ্গে সৃজনশীল ও মননশীল হয়ে উঠতে পারে।
প্রকাশক মফিদুল হক বলেন, ‘পৃথিবীতে নন-ফিকশন বইয়ের পরিমাণই সবচেয়ে বেশি। তবে বাংলা ভাষায় নন-ফিকশন লেখক কম। নন-ফিকশন বইয়ের পাঠক ও লেখক বৃদ্ধির ক্ষেত্রে এর সঙ্গে শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও গবেষকদের সংযোগ ঘটাতে হবে। সে ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পাঠ্যক্রমে গুরুত্বসহকারে নন-ফিকশন বই সংযুক্ত করা প্রয়োজন।’
প্রকাশক ফরিদ আহমেদ বলেন, ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বইমেলার আয়োজন খুবই দরকার। কেননা, শিক্ষার্থীরা বই না কিনলেও তাদের বইয়ের স্পর্শ দিতে হবে, বইয়ের গন্ধ নেওয়ার সুযোগ করে দিতে হবে। আশার বিষয় এই যে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই নিজস্ব উদ্যোগে বইমেলা আয়োজন করতে আগ্রহী।’ তিনি আরো বলেন, ‘বাংলাদেশের অন্যতম নন-ফিকশন লেখক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। তিনি বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি দিয়ে শিক্ষার্থীদের বইয়ের সংস্পর্শে আনতে পেরেছেন। এটি এক ধরনের বিপ্লব।’
মামুন রশীদ বলেন, ‘অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে গবেষণা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এ ক্ষেত্রে অর্থনীতি বিষয়ে জ্ঞানচর্চার প্রয়োজন রয়েছে। অর্থনীতি বিষয়ে বিদেশি ভাষায় অনেক নামকরা বই থাকলেও বাংলা ভাষায় তা অনেক কম। অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে সামনে এগোতে আমাদের নিজেদের ভাষায় অর্থনীতি বিষয়ে জ্ঞানচর্চা নিয়ে ভেবে দেখতে হবে।’
মাহরুখ মহিউদ্দিন বলেন, ‘অনেকে বলে থাকেন, নন-ফিকশন বই অজনপ্রিয়। কিন্তু পরার্থপরতার অর্থনীতি নামক নন-ফিকশন গ্রন্থটি বাংলা ভাষার অন্যতম জনপ্রিয় বই। বর্তমানে পাঠকের আচরণের পরিবর্তন হয়েছে। এখন পাঠক কোনো বিষয়ের ডেপথে (গভীরে) যেতে চান না। তাঁরা কম পড়েই বিষয়টি জানতে চান। এ ক্ষেত্রে লেখকদের উচিত নন-ফিকশন বইগুলো সহজবোধ্য ও আকর্ষণীয় ভাষায় লেখা।’
এদিকে, বণিক বার্তা ও ঢাবি ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদ আয়োজিত তিন দিনব্যাপী বইমেলা শেষ হচ্ছে আজ। গতকালের মতো আজও সকাল ১০টায় বইমেলা শুরু হবে। এরপর রাত ৮টা পর্যন্ত সবার জন্য উন্মুক্ত থাকবে মেলা প্রাঙ্গণ। দ্বিতীয়বারের মতো আয়োজিত এ মেলায় অংশ নিচ্ছে দেশের খ্যাতনামা ২৪টি প্রকাশনা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান।
বিকেল ৫টায় বইমেলার সমাপনী ও পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে পাঠকদের উদ্দেশে বক্তব্য রাখবেন বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আবদুল মান্নান। সমাপনী অনুষ্ঠানটি ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত হবে। এতে বিশেষ অতিথি থাকবেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান।