আবুল বারকাতের নতুন দুই বইয়ের মোড়ক উন্মোচন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবন অডিটরিয়ামে গতকাল শনিবার অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত রচিত ‘বাংলাদেশে কৃষি-ভূমি-জলা সংস্কারের রাজনৈতিক অর্থনীতি’ ও “Political economy of unpeopling of indigenous peoples : The case of Bangladesh” গ্রন্থদ্বয়ের মোড়ক উন্মোচন হয়। অনুষ্ঠানে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছাত্র, শিক্ষক, বিভিন্ন পেশাজীবী, শ্রমজীবী, গণমাধ্যমের প্রতিনিধি, রাজনীতিবিদ, উন্নয়নকর্মীসহ হাজারের অধিক অতিথি উপস্থিত ছিলেন।
আমন্ত্রিত অংশগ্রহণকারী ও সম্মানিত অতিথিদের আসন গ্রহণের পর পরই সমবেত কণ্ঠে জাতীয় সংঙ্গীত পরিবেশন এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদ, ’৭৫-এর ১৫ আগস্টে নৃশংস হত্যার শিকার জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবার-পরিজন এবং ‘জাতীয় চার নেতা, যাঁরা এই নভেম্বর মাসেই জেলখানায় নির্মম হত্যার শিকার হন তাঁদের স্মরণে সমবেত সবাই এক মিনিট দাঁড়িয়ে নীরবতা পালন করেন।
প্রকাশনা অনুষ্ঠান সমন্বয় কমিটির আহ্বায়ক ড. জামালউদ্দিন আহমেদ তাঁর স্বাগত বক্তব্যে বলেন, ‘গণমানুষের অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবুল বারকাত বরাবরই প্রথাগত অর্থনীতিচর্চার যে গণ্ডি তার বাইরে বেরিয়ে রাজনৈতিক-অর্থনীতির অউন্মোচিত দিকসমূহ নির্মোহ গবেষণার মাধ্যমে জাতির সামনে তুলে ধরেছেন। তিনি তাঁর এই বইয়ের মাধ্যমে ভূমির সমবণ্টনের একটি সহজতর ব্যাখ্যা তুলে ধরেছেন যাকে আমলে নেওয়া এখন দেশ, দশ ও সময়ের দাবি। এরই ধারাবাহিকতায় আবুল বারকাত দীর্ঘ ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে নির্মোহ গবেষণা করে আজকের এ গ্রন্থ দুটি আমাদের সবার সামনে তুলে ধরেছেন। তাঁর গবেষণালব্ধ ‘বাংলাদেশে কৃষি-ভূমি-জলা সংস্কারের রাজনৈতিক অর্থনীতি’ এবং “POLITICAL ECONOMY OF UNPEOPLING OF INDIGENOUS PEOPLES : The case of Bangladesh” বই দুটি আপনাদের সামনে নিয়ে আসতে পেরে আমরা আনন্দিত ও গর্বিত।’
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন, এমপি গ্রন্থ দুটির মোড়ক উন্মোচন করেন। প্রধান অতিথি বলেন, ‘১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে একটি বৈষম্যহীন অর্থনীতি ও অসাম্প্রদায়িক আলোকিত মানুষের বাংলাদেশ বিনির্মাণের দৃঢ় সংকল্প ছিল আমাদের। আর সে লক্ষ্যে চার স্তম্ভ বিশিষ্ট ১৯৭২-এর সংবিধানে অন্যতম স্তম্ভ হিসেবে সমাজতান্ত্রিক আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা বিনির্মাণের কথা বলা হয়েছিল। সে প্রক্রিয়ার অন্যতম করণীয় হিসেবে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিতে গৃহীত হয়েছিল কৃষি-বিপ্লবের সিদ্ধান্ত।
বাংলাদেশে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও মানব উন্নয়ন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করতে জনকল্যাণকামী কৃষি-ভূমি-জলা সংস্কারের কোনো বিকল্প নেই। আবুল বারকাত দেখিয়েছেন এটা “Class” (শ্রেণি সমস্যা) : এত দিন আমরা খুব ভাবিনি যে এ দেশের আদিবাসীদের ভূমি সমস্যাকে সামগ্রিক জাতীয় কৃষি-ভূমি সমস্যার নিরিখে দেখতে হবে।’
পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ামরান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা) বলেন, ‘বাংলাদেশের সমাজ জীবনের যে বাস্তবতা, সেই বাস্তবতার আলোকে জনগণের মৌলিক অধিকারের বৈষম্য আলোচনা এই বইয়ের মূল প্রেক্ষাপট।’
বাংলাদেশের জমি-জলা-বন সাধারণ মানুষের সম্বন্ধে জানতে চাইলে- এই বই দুটির বিকল্প নেই। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে যে, সংস্কার কে করবে- সেই দিক নির্দেশনারও প্রয়োজন আছে। আমাদের নীতিনির্ধারণে যারা আছেন তাঁরা বর্তমান বাস্তবতার সাথে সমভাবাপন্ন নন। মানুষের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় যে লড়াই-সংগ্রাম শাসন-শোষণ, শাসিত-শোষিতের ব্যবধান দূরীকরণে দরকার কার্যকর নেতৃত্ব।
বিচারপতি কাজী এবাদুল হক বলেন, ‘একজন আইনজ্ঞের দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখলে ভূমি নিয়ে এই সমস্যার সৃষ্টি করল ব্রিটিশরা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে। তিনি তাঁর কর্মজীবনের অভিজ্ঞতায় দেখেছেন যে ভূমিহীনদের দেওয়ার জন্য নির্দিষ্ট জমি (চরের জমি) চেয়ারম্যানের হাতে চলে গেছে, জমি তারা পায়নি যদিও বা কখনো পেয়ে থাকে তা হামলায় এবং মামলায় খোয়া গেছে। আবুল বারকাতের গবেষণালব্ধ গ্রন্থদ্বয় মাঠ-ঘাটের মানুষ যারা নিপীড়িত-অত্যাচারিত তাদের কাছ থেকে নেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে রচিত।’
রাজীতিবিদ পঙ্কজ ভট্টাচার্য বলেন, ‘মুক্ত সমাজের স্বপ্ন দেখতে যারা অভ্যস্থ তার আবুল বারকাতের গ্রন্থ পাঠ এবং গ্রহণ করেছেন যেমন আমি করছি। বইটিতে তিনি শ্রেণি সংগ্রামের পথ সুনির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। আদিবাসীরা সমাজ কর্তৃক, রাষ্ট্র কর্তৃক পরিত্যক্ত কিছু মানুষ। ব্যতিক্রমী গবেষক ক্রমাগত শ্রেণি বিন্যাসের বিপক্ষে কাজ করে যাচ্ছেন এবং সাধারণ মানুষের পথ প্রদর্শক হিসেবে সামনে দাঁড়িয়ে সব অবজ্ঞা নিজের ওপর নিয়ে নির্মোহ সামগ্রিক ইতিহাস রচনার দিকে এগিয়ে চলেছেন। বর্তমান সময়ে আদিবাসীদের ওপর যে অত্যাচার হয়েছে তা, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আচরণের সমতুল্য- এই আঙ্গিকে গ্রন্থদ্বয় অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।’
অধ্যাপক অজয় রায় বলেন, ‘আদিবাসী শব্দটি সংবিধানে নেই। তবে এখন যুক্ত হয়েছে, কি না জানি না। আমরা কোনো জনগোষ্ঠীকে unpeopleing –এর মাধ্যমে এদের সত্ত্বাটিকে বিলুপ্ত করে ফেলি। আবুল বারকাত একজন চমৎকার এবং বিস্তৃত লেখক।’ তিনি বলেন, সংখ্যালঘুদের প্রতি দরদী মানুষ এখনো বাংলাদেশে অন্তত একজন আছে।
প্রধান তথ্য কমিশনার অধ্যাপক গোলাম রহমান বলেন, ‘অধ্যাপক আবুল বারকাত গুণী একজন মানুষ যাঁর গ্রন্থের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে এসে বসার জায়গা পাওয়া যায় না। এর কারণ বিষয়ের গুরুত্ব।’ তিনি আরো বলেন, সবাইকে নিয়ে সুমধুর সম্পর্কের যে অবস্থান সেখান থেকে সরে গিয়ে আমরা কেন সংকটে ঢুকে আছি- তার কারণ আমাদের জানা।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের প্রাক্তন চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিজানুর রহমান বলেন, ‘আবুল বারকাতের চিন্তা, চেতনা সারা জীবনের দর্শন- এই দুই বইতে সেই দর্শনের বিস্তৃতি প্রবলভাবে বিদ্যমান। রাষ্ট্র আদীবাসী জনগণকে ভুলে গেছে, শ্রেণি বিভাজন প্রথা বন্ধ না হলে সামনে এগোনো অসম্ভব। কেন মানুষ মানুষকে শ্রেণি বিভাজনে বিভাজিত করে নিজেকে উন্নত মনে করে, অন্যকে ক্ষুদ্র প্রমাণিত করে-তার অন্তর্নিহিত মূল কারণ কী, তা আবুল বারকাতের বই দুটি পড়লে স্পষ্ট হয়।’ তিনি আরো বলেন, আদিবাসীদের জন্য ‘আদিবাসী জনগণ সুরক্ষা কমিশন’ গঠন করা উচিত।