উপন্যাস পর্ব ৭
বাবা আছে, বাবা নেই
বাকিউলের ডাকাডাকিতেই ঘুম ভাঙল। বেলা কত হলো, ঠিক বোঝার উপায় নেই। একতলা বাড়ির জানালায় মোটা তিলসিটে পর্দা। চোখ কচলে দেখলাম, সে স্নান সেরে তৈরি হচ্ছে। অফিস যাবে।
রাবেয়া, উঠো।
এপাশ-ওপাশ করে উঠলাম।
শার্ট-প্যান্টে বাকিউলকে সাহেব সাহেব লাগছে। কিন্তু বেচারার ভূরিটা শার্টেও বোতাম আর বেল্টের ফুটো ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে।
যাও। হাত-মুখ ধুয়ে নাও। আমি নাশতা নিয়ে আসছি। বলল বাকিউল।
বেরোল। বাইরে ক্লিক করে তালা লাগানোর শব্দ শুনতে পেলাম।
বুঝতে পারলাম, আমি বন্দি। বাকিউল আমাকে বিশ্বাস করতে পারছে না। যেসব কাণ্ড ঘটিয়েছি, তাতে আমার প্রতি বাকিউলের বিশ্বাস না থাকারই কথা।
ভয়ে ভয়ে বাথরুমে এলাম। ঝাঁকে ঝাঁকে তেলাপোকা। ইতস্তত হাঁটাহাঁটি করছে আর মুখের দুপাশের লম্বা লোম নাড়ছে। এই বুঝি উড়াল দিয়ে গায়ে এসে বসল। বিশ্রী দুর্গন্ধ নাকে ঝাপটা দিল। নিরুপায় হয়ে ঢুকলাম। ওখানে কল নেই। বাথরুম থেকেই মগ কেটে বদনা পুরাতে হয়।
তাই করলাম। কালো মাজনের একটা শিশি দেখতে পেলাম বাথরুমের চৌকাঠের ওপর। তা দিয়েই আঙুল দিয়ে দাঁতে বাম-ডান করলাম।
বাইরে ছলাৎ করে তালা খোলার শব্দ কানে এলো। মুখে জল ঝাঁপটা দিয়ে ওড়নায় মুখ মুছতে মুছতে ফিরে এলাম।
বাকিউল ফিরেছে। হাতে একটা ছোট আকারের পলিথিন ঝুলছে। টেবিলের ওপরই রাখল। তারপর ভেতর দিকে গেল। একটা প্লেট আর বাটি নিয়ে ফিরে এলো।
পলিথিন থেকে কয়েকটা পরোটা বের করে প্লেটে রাখল। আর বাটিতে ঢালল ডাল-ভাজি।
বিবাহ পাঠের শুরু থেকে বাকিউলের সঙ্গে আমি পারতপক্ষে কোনো কথা বলছি না। দু-একটা যা বলছি, তা নিরুপায় হয়ে তাকে সম্বোধন করে তো নয়ই।
খাও। বলল বাকিউল।
পরে খাব।
পরে কেন? গরম গরম খেয়ে নাও।
কিছুই বললাম না। বাকিউল হাতঘড়ি দেখল। তারপর নিজেই খাওয়া শুরু করল। আমি বাকিউলের খাওয়া দেখছি। তাও বিশ্রী। কেমন যেন ভেংচি কেটে খায়। খাওয়ার সময় ছোপ ছোপ শব্দ করে।
খেয়ে-দেয়ে বেরিয়ে গেল বাকিউল। বাইরে তালা দিয়ে গেল। প্রচণ্ড ক্ষিধে পেয়েছে। ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠছে।
পরোটা হাতে নিয়ে মুখে পুরতেই মায়ের কথা মনে পড়ল।
প্রতি ভোরেই মা রুটি বেলত আর আমি উনুনে সেকতাম। শিমু পাশে বসে খাওয়ার জন্য উদগ্রীব থাকত। শিমুর সঙ্গেই আমার যত ঝগড়া। আমরা কষ্ট করে বানাব আর ও কি না আয়েশ করে খাবে। মা বলত, তোদের নিয়ে আর পারা গেল না। শিমু তো ছোট। ওর আবদারটা দেখবি না।
মা সত্যি বলত, শিমুর অনেক আবদারই আমি পূরণ করতে পারিনি। ওর দস্যিপনা যে আমার কী ভালো লাগত, তা বলে বোঝানো যাবে না।
আমাকে ছেড়ে মৌলানা শরাফত খান দিব্যি ভালো আছে। চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পারছি, আমাকে বিদায় করতে পেরে তিনি যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। দাড়িতে হাওয়া লাগিয়ে বেড়াচ্ছেন। চুরি করে জোরপূর্বক মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। তাতে মৌলানা সাহেবের ধর্মের ক্ষতি হয় না। জাত যায় না। জাত যায় সত্যি কথা বললে, খুনিকে খুনি বললে। অপবিত্রতার কারণে বিয়ে পড়ানো শুদ্ধ হবে না। জেনেও জোর করে বিয়ে দিতে তাদের বাঁধে না।
মা, শিমু কি ভালো আছে?
নিশ্চয় ভালো নেই।
মা হয়তো কাঁদতে কাঁদতে চোখ ফোলাচ্ছে। নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। শিমু বারবার আমার কথা জিজ্ঞেস করছে।
আমার বিয়ে হয়েছে। এ কথা শিমুও জানতে পারে। কিন্তু কোথায় কীভাবে কেন বিয়ে হলো, এ কথা জানতে পারেনি। হয়তো কোনো একদিন জানতে পারবে। তখন মৌলানা শরাফত খানকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলবে শিমু। ও জেদি মেয়ে।
পরোটা দিয়ে ডাল-ভাজি চিবুচ্ছি। দেরি হওয়ায় পরোটা শক্ত হয়ে গেছে। তারপরও চিবিয়ে পেট ভরছি। এরপর কয়েক গ্লাস জল চালান করে দিলেই সেরে যাবে।
রমাদের কথা খুব মনে পড়ছে। ওরা কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে স্কুলে যাচ্ছে। নিলা, তমা, মুনাদের সঙ্গে খেলছে। গল্প করছে। খুনসুটি করছে। কামাল স্যার বেত হাতে এলেই সবাই চুপ করে যাচ্ছে।
সবাই যখন হৈ-হল্লা করছে, তখন আমি আর রমা ক্লাসের এক কোনায় গিয়ে গণিত শিখছি। সুনীল স্যারের ট্রান্সলেশন লিখছি।
আর এখন বাতাসে চুপসে যাওয়া পরোটা চিবুচ্ছি। একেই কি বলে নিয়তি? নিয়তির কী দোষ। বেজন্মার নিয়তি এর চেয়ে ভালো হবে, তা আশা করা যায় না। ভবিষ্যতে হয়তো আরো নিষ্ঠুর নিয়তি অপেক্ষা করছে। নিয়তি যাই থাকুক, একজন রাজাকারের কাছে আমি হারব না। এ আমার মায়ের দিব্যি।
হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছি। দুপুর গড়িয়ে বিকেল। কাল রাতে আমার এই শরীরটার ওপর বেশ দখল গেছে। ভোররাতের দিকে প্রায় অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলাম।
বাকিউল আমাকে কখন কীভাবে হাসপাতালে এনেছে, তা জানি না। বুঝতেও পারিনি। যখন জ্ঞান ফিরল তখন বুঝলাম, আমি হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছি। বেশ রক্তক্ষরণ হয়েছে। জামা ভেজা দেখে বুঝতে পেরেছি।
বাঁ হাতের কব্জির কিছুটা ওপরে স্যালাইনের ইনজেকশন আঁটা। স্ট্যান্ডে ঝোলানো এক ব্যাগ স্যালাইন। ফোঁটা ফোঁটা পড়ছে আর আমার শিরা-উপশিরায় প্রবাহিত হচ্ছে। পায়ের কাছে ছোট্ট বেঞ্চিতে বসে আছে বাকিউল। তাকিয়ে আছে ফ্যালফ্যাল চাহনি।
কেমন লাগছে রাবেয়া? কবার জানতে চাইল বাকিউল। আমার মুখ ফুটে কোনো উত্তর বেরোয়নি। বাকিউলের দিকে তাকাতেও ইচ্ছে হয় না। তারপরও চোখাচোখি হয়ে যায়। কারণ, হাসপাতালে বাকিউল ছাড়া আমাকে দেখার কেউ নেই।
হাসপাতালের বিশাল ওয়ার্ড। শ খানেক রোগী। বেডে ও মেঝেতে শুয়ে আছে। রোগীরা সবাই মহিলা। এটা নিশ্চয় মহিলা ওয়ার্ড। একবার মায়ের কঠিন রোগ হলো। রোগটা কী, তা জানতে পারিনি। থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১২ দিন ছিল। আমিও মায়ের সঙ্গে লেগে ছিলাম। সেটাও মহিলাদের ওয়ার্ড ছিল। মাকে খুব মনে পড়ছে। মা জানতে পারলে আমার পাশ থেকে নড়তই না।
হাসপাতাল থেকে নাশতা দিয়েছে। ঠান্ডা তন্দুল রুটি আর এঁটো মতন ভাজি। কাছে আনতেই বমি আসতে চাইছে। ফিরিয়ে দিলাম।
বাকিউল নিচ থেকে কলা-পাউরুটি নিয়ে এলো, সঙ্গে এক বোতল জল। বেডের পাশে ছোট্ট বক্সের ওপর রাখল।
খেয়ে নাও। বলল বাকিউল।
কোনো উত্তর না দিয়ে স্যালাইনের দিকে তাকিয়ে রইলাম।
খেয়ে নাও। যাই। আমিও খেয়ে আসি।
এ কথা বলে বাকিউল চলে গেল।
পাশের বেডে এক মহিলা তার মেয়েকে নিয়ে আছে। মহিলাটি বারবার আমাকে দেখছে।
বাকিউল চলে যাওয়ার পর মহিলাটি আমার কাছে এলো।
বসল সিটে।
ওটা কি তোমার স্বামী। বলল মহিলা।
কথা এড়িয়ে আমি জানতে চাইলাম, খালাম্মা ও কি আপনার মেয়ে?
হ্যাঁ, মা।
কী হয়েছে?
সিজার হয়েছে মা। বাচ্চাটা বাঁচাতে পারেনি। বলেই মহিলাটি হাউমাউ করে কান্না শুরু করল। মেয়েটি বেডে শুয়ে মার দিকে তাকিয়ে আছে।
কী বলে মহিলাকে সান্ত্বনা দেব, বুঝতে পারছি না। তারপরও মহিলার হাত ধরে কাছে টেনে নিলাম।
পাশে বসালাম।
ওর স্বামী কোথায়?
স্বামীর কথা আর বলো না মা। মেয়ের স্বামী থাকে সৌদিতে।
বিয়ের এক মাস পর সৌদি চলে গেছে। মাঝেমধ্যে ফোন করে। টাকা পাঠায়।
ফোন করে টাকা পাঠালেই জামাইর দায়িত্ব শেষ?
বিশ্বাস করো মা, মেয়েকে প্রবাসী স্বামী দিয়ে কী যে ভুল করেছি। ও, তুমি তো বললে না ওই লোকটাই কি তোমার স্বামী?
বলছি খালাম্মা।
মেয়েটি হাতের ইশারায় তার মাকে ডাকল। খালাম্মা উঠে গেল। বাকিউল ফিরে এসেছে। হাতে একটা প্যাকেট ঝোলানো। পাশের বক্সের ওপর রাখল।
এখানে আপেল আর ডালিম আছে। ক্ষিদে পেলে খেয়ো। থামল বাকিউল।
ডাক্তার এসেছিল?
মাথা ঝাঁকিয়ে বললাম, না।
ডাক্তার এলে তোমার কেমন বোধ হচ্ছে সব খুলে বলো।
হু।
আমি অফিসে সাইনটা করে আসি। দুপুরের খাবার নিয়ে আসব। টেনশন করো না। বলল বকিউল।
মনে মনে বললাম, হারামজাদা, বাকিউল তুইই তো আমার বড় টেনশন।
বাকিউল চলে গেল।
খালাম্মা তার মেয়েকে বাটি করে স্যুপ খাওয়াচ্ছে। বাটি হাতেই আমার কাছে এলো।
তুমি স্যুপ খাবে মা? বলল খালাম্মা।
জি না।
খাও না। আছে তো।
জি না খালাম্মা। খেতে ইচ্ছে করছে না।
ইচ্ছা করলে বলো। আমার হটপটে আছে।
জি খালাম্মা। বলব।
প্রতি বেডে রোগীরা শুয়ে-বসে আছে। হাসপাতালে নানা বেশের রোগীদের অবস্থা দেখলে মনটা বিষিয়ে ওঠে। কেউ পেটের ব্যথায় কাতরাচ্ছে, কারো মাথায় চিনচিন, কারো ডেলিভারি ডেট পেরিয়ে গেছে। তীব্র যন্ত্রণা। আর কারো শ্বাসকষ্ট। আরো কত কী। রোগের কি আর শেষ আছে।
মেয়েকে স্যুপ খাইয়ে খালাম্মা আমার পাশে এলো। বাকিউলের আনা পোঁটলা খুলে খালাম্মাকে একটা আপেল দিলাম। নিতে চাইল না। অনেকটা জোর করেই গছালাম।
আসল কথাটাই পেড়ে বসল খালাম্মা।
কালো মতন মোটা ওই লোকটাই কি তোমার স্বামী?
কিছুক্ষণ চুপ করে রইলাম।
বলতে কোনো সমস্যা আছে? বলল খালাম্মা। কিছুটা সময় নিয়ে পুনরায় বলল, সমস্যা থাকলে বলার দরকার নেই।
না খালাম্মা, সমস্যা নেই। কিন্তু কথাগুলো শোনার পর আপনি আমাকে কীভাবে নেবেন, সেটাই ভাবছি।
তুমি কি তোমার কোনো বিপদের কথা বলছ?
ঠিক তা না।
তাহলে।
আমি একটা জালে আটকা পড়েছি। সে জাল থেকে মুক্তি চাই। চিরতরে মুক্তি।
খালাম্মা।
হু।
দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। কথার ফাঁকে নিজের মেয়ের দিকে তাকাচ্ছে। মেয়েটি বাঁ পাশে কাত হয়ে ঘুমোচ্ছে।
খালাম্মা কথা দাও, তুমি আমাকে মুক্ত হতে সাহায্য করবে? আমি মুক্তবিহঙ্গের মতো উড়ে বেড়াব দেশ-দেশান্তরে। ভেঙে দেব সেসব ভণ্ড প্রতারকের বিষদাঁত। রাজাকারের রক্তাক্ত কালো হাত।
খালাম্মা অবাক নয়নে আমার দিকে চেয়ে থাকল। আবেগাপ্লুত আমার কথাগুলো ঠিক বুঝে উঠতে পারল না। তারপরও আমি জোর দিয়ে বললাম, কথা দাও খালাম্মা। কথা দাও।
আমার হাতে হাত রাখল। নিচু করল মাথা। বলল, কথা দিলাম।
আর আমি বিশ্বস্ত হৃদয়ে খালাম্মাকে জড়িয়ে ধরলাম। কিছুটা সময় পেরোল। কথায় কথায় আপন ভেবে কখন যে পাশের বেডের এই মহিলাকে খালাম্মা ডেকে আপনি থেকে তুমিতে নেমে এসেছি, তা বুঝতেই পারিনি।
সম্বিত ফিরে পেলাম খালাম্মার কথায়। বলল, এবার বলো।
শুরু করলাম আমার আত্মজীবনীর শৈশব-কৈশোরের সেই দিনগুলো। বিজয়বাবুর থেকে মৌলানা শরাফত খান। আজরাইল সোবহান থেকে মেজর নাসের। খালাম্মা তটস্থ হয়ে শুনল আর জিভে কামড় খেল। একজন রাজাকারের কন্যার কথা শুনে খালাম্মার চোখে জল এলো। অজান্তে অনায়াসে জড়িয়ে ধরল আমাকে। আর বলল, মা, আমি তোমার সঙ্গে আছি।
(চলবে)