যাপিত জীবনের গল্প ‘ঝলমলিয়া’
বাংলাদেশ শর্ট ফিল্ম ফোরাম আয়োজিত ১৪তম আন্তর্জাতিক স্বল্পদৈর্ঘ্য ও মুক্ত চলচ্চিত্র উৎসব শেষ হলো কদিন আগে। এ উৎসবে ইন্টারন্যাশনাল কম্পিটিশনের ডকুমেন্টারি বিভাগে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হিসেবে নির্বাচিত হয় বাংলাদেশি চলচ্চিত্রকার সাইফুল ওয়াদুদ হেলাল পরিচালিত প্রামাণ্য চলচ্চিত্র ‘ঝলমলিয়া : দ্য স্যেকরেড ওয়াটার’।
ঝলমলিয়ার যাত্রা নিয়ে কথা হলো নির্মাতার সঙ্গে। এই প্রামাণ্য চলচ্চিত্রের যাত্রা মূলত শুরু হয়েছিল ২০০৯ সালের দিকে। ১৯৮৮ সালে বিদেশ চলে যাওয়া হেলাল দেশে ফিরে কিছু করতে চেয়েছিলেন, দেশে থেকে চলচ্চিত্র নির্মাণে প্রয়াসী তিনি। সে জন্য ফিরে এসেছিলেন ২০০৮ সালে। পরের বছর চারুকলার বন্ধুরা সবাই মিলে আর্ট ক্যাম্প আর ভিন্ন ধরনের এক মেলা করতে যান প্রয়াত বন্ধু সনাতন বিশ্বাসের গ্রামে। সনাতন বিশ্বাস ছিলেন শিল্পী, তাঁর স্মৃতির উদ্দেশেই নিয়মিত এ আয়োজন। সেই গ্রাম, বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূল অঞ্চলের হুড়কা গ্রাম। সেখানেই সন্ধ্যার পর চায়ের দোকানের আড্ডা থেকেই ঝলমলিয়া দীঘির ইতিহাস শোনেন হেলাল।
সমুদ্রের কাছাকাছি হওয়ায় সমগ্র অঞ্চলজুড়ে সুপেয় পানির অভাব। দীঘিটি হয়ে আছে সেই অঞ্চলের মানুষের পানীয় জলের একমাত্র উৎস। ২০০৯ সালে সাইক্লোন আইলায় সমগ্র অঞ্চল প্লবিত হলেও দীঘিটি রক্ষা পায়। সে জন্যই এ দীঘিকে ঘিরে এ অঞ্চলের মানুষের জীবনযাপন, লৌকিক-অলৌকিক গল্প আর কল্পকথা। এসব গল্প তাঁকে আচ্ছন্ন করে রাখে।
পরিচালক বলেন, ‘শীতকাল ছিল তখন, শাপলা ফোটা সেই দীঘিতেই কাটিয়ে দিতাম সারাক্ষণ। ফিরে এসে ৯-১০ মিনিটের একটা ভিডিও আর্ট তৈরি করি। পরে বারবার ছুটে যাই গত ছয় বছরের বিভিন্ন সময়।’
এই নির্মাতার জীবনদর্শন, স্থান, ভাবনা-চিন্তাই তাঁর প্রামাণ্য চলচ্চিত্র নির্মাণের মূল পুঁজি। সাইফুল ওয়াদুদ হেলালের বাড়ি ছিল সন্দ্বীপে, নদীতে তলিয়ে যায় সে ঘরবাড়ি। ‘দেশের বাড়ি’ না যেতে পারার দুঃখ নিয়ে বড় হয়ে ওঠা ছেলেটি ঝলমলিয়ার ধারে নিজের আবাস দেখতে পান। একসময় দেখেন, তাঁকে রাতের খাবার বেড়ে দেওয়া গৃহস্থের ঘরও তলিয়ে গেছে নদীতে সেই হুড়কা গ্রামে। এভাবেই এগিয়ে চলতে থাকে ‘ঝলমলিয়া’ প্রামাণ্য চলচ্চিত্রের কাজ।
বর্তমান বাংলাদেশে প্রামাণ্য চলচ্চিত্রের অবস্থা নিয়েও আড্ডা জমে ওঠে তাঁর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘ইদানীং ছেলেমেয়েরা ফান্ড ও গ্যাজেট নিয়ে বড্ড বেশি ব্যস্ত হয়ে ওঠে। বিষয়বস্তু নিয়ে, চারপাশ নিয়ে ভাবে না। আমার সব সময় মনে হয়, বানানো গল্পের চেয়ে জীবনের গল্প উত্তম। সেই জীবনের গল্প ধারণ করতে টু কে, ফোর কে রেজুলেশনের ক্যামেরা না হলেও চলে। আজ তো আক্ষরিক অর্থেই কলমের মতোন ক্যামেরাও হাতে হাতে আছে। তাই প্রামাণ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করা কোনো কঠিন কাজ নয়। কিন্তু বাংলাদেশে সেই আন্ডারস্ট্যান্ডিং গড়ে ওঠেনি এখনো।’
প্রামাণ্য চলচ্চিত্র নির্মাণের পর মুক্তি দেওয়া নিয়েও কম ঝামেলা পোহাতে হয় না নির্মাতাদের। এ নিয়ে আলাপে উঠে আসতে থাকে নানান সম্ভাবনার কথা, “বিদেশে চ্যানেলগুলোতে পৃথক চাঙ্ক আছে প্রামাণ্য চলচ্চিত্রের জন্য। এখানেও সে রকম ব্যবস্থা রাখা প্রয়োজন, টিভি রিপোর্ট নয় কিন্তু, প্রামাণ্য চলচ্চিত্র হতে হবে। এ ছাড়া দেখুন সামনে ছোট ছোট থিয়েটার হল হবে। এবং এটা দু-তিন বছরের মধ্যেই হবে। তো, তখন বানাব সেটা ভেবে বসে থাকলে তো চলবে না, নির্মাতাদের বানিয়ে যেতে হবে। শুধু গ্রাম নয়, শহর, শহরের জীবনকে কেন্দ্র করেও দারুণ প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করা সম্ভব। বর্তমান বাংলাদেশের প্রামাণ্য চলচ্চিত্রের কথা যদি বলেন তবে আমি কামার আহমদ সায়মনের ‘শুনতে কি পাও’-এর কথা বলতে পারি। এ ছাড়া এই সেদিন ট্রেলার দেখে এত ভালো লাগছিল, আবদুল্লাহ মোহাম্মদ সাদের ‘লাইফ ফ্রম ঢাকা’ চলচ্চিত্রটির। তো, এগুলো ভাবতে ভালো লাগে।”
‘ঝলমলিয়া’ যাপিত জীবনের গল্প বলতে বলতে অনেকগুলো লেয়ারে কথা বলে যায়। সাফিয়া—গ্রামের সেই বধূ সংসারে অতিষ্ঠ হয়ে ঢাকায় গার্মেন্টে চলে আসতে চাইছিলেন চাকরির খোঁজে। আবার দুই গ্রাম্য বধূ কী অকপটে কথা বলে যান সহজ ভাষায় ধর্ম নিয়ে, দর্শনগত ভাবনা নিয়ে। এ প্রামাণ্য চলচ্চিত্রে গানের প্রয়োগ দৃশ্যের সঙ্গে মিশে যেতে থাকে। ব্যবহার করা হয়েছে লালনগীতি, এ ছাড়া স্থানীয় লোকসংগীতকে ব্যবহার করা হয়েছে প্রতীকীভাবে বর-বউ মিলে মাছ ধরার সেই ধারালো দৃশ্যে। ঝলমলিয়া দীঘির পাশে সারি বেঁধে বসে নানান বয়সের নারী যখন বলে যান কী শান্তি এখানে, তখন বোঝা যায় এই দীঘি আদতেও কম কিছু নয় তাদের জীবনে। শ্রান্ত দুপুরে কোনো মধ্যবয়সী নারীর খোলা চুলে দীঘিপাড়ে বসে থাকার দৃশ্যের মধ্যে বাস্তবতাকে আকর্ষণীয় ঢঙে তুলে আনার প্রয়াস চোখে পড়ে।
হিন্দু-মুসলিম আচারগুলো ঝলমলিয়া দীঘিতে এসে মিশে যাচ্ছিল একই বন্ধনে। রাত আর ভোরের মাঝামাঝি সময়ে দাঁড়িয়ে মেয়ে-বধূরা মিশে যাচ্ছিলেন ধ্যানে, জলের গভীরে।
পরিচালকের জীবনী
১৯৬৭ সালে বাংলাদেশের ঢাকায় জন্মগ্রহণ, সাইফুল ওয়াদুদ হেলাল কানাডায় একজন সাংবাদিক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। মন্ট্রিয়ল থেকে সিনেমা অধ্যয়ন ও টেলিভিশন উৎপাদনে ডিপ্লোমা প্রাপ্তির পর অনুষ্ঠান নির্মাতা ও সম্পাদক হিসেবে স্থানীয় টেলিভিশন চ্যানেলে কাজ শুরু তাঁর। লেখালিখি সাংবাদিকতার পাশাপাশি কানাডা এবং বিদেশে বিভিন্ন চ্যানেলের জন্য নির্মাণ করেছেন স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র, টিভি ম্যাগাজিন এবং প্রামাণ্যচিত্র।