করোনাকালের ভয়াবহ স্মৃতির ঐতিহাসিক দলিল ‘করোনাপঞ্জি’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর সি মজুমদার মিলনায়তনে স্বপ্ন ’৭১ প্রকাশনের আয়োজনে শনিবার (১৮ নভেম্বর) বিকেলে ‘করোনাপঞ্জি’র ওপর আলোচনা হয়। লেখার পরতে পরতে ছড়িয়ে থাকা বার্তা, ধরন, গুণগত মান তুলে ধরে লেখিকার সৃজনশীলতার ভূয়সী প্রশংসা করেন আলোচকরা।
সারা বিশ্ব যখন করোনার ভয়াল থাবায় ঘরবন্দি তখন লেখক ফারাহ জাবিন শাম্মী কিছুটা সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকেই করোনা সময়ের ঘটনাগুলো রোজনামচার আকারে লিপিবদ্ধ করা শুরু করেন। শুধু প্রতিদিনের তথ্যই নয়, একইসাথে ব্যক্তিগত আবেগ, অনুভূতি, সামাজিক পরিস্থিতি, অর্থনৈতিক বিপর্যয়, গুজব, বিশ্ব নেতাদের করোনা নিয়ে রাজনীতি, উদ্ভট তথ্য সকলকিছুই স্থান পেয়েছে ৫৬০ পৃষ্ঠার বইয়ের মলাটে।
ফারাহ জাবিন শাম্মী তার এই বইটি লেখার অভিজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, ‘করোনাকালীন সময়ে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল তা আমরা আগে থেকে কেউই কল্পনা করতে পারিনি। ধারণার বাইরে থাকা উদ্ভট এক পরিস্থিতি আমাদের প্রতিটা দিন নতুন অভিজ্ঞতায় অভিজ্ঞ করে তুলছিল। সে মুহূর্তে হঠাৎ করেই আমাদের বদলে যাওয়া জীবন নিয়ে ব্যক্তিগত উপলব্ধির একপর্যায়ে মনে হলো—আমি কেন লিখছি না? আমি জানি না, আজ বেঁচে আছি, কাল মারা যাব কি না! জানি না কতজনকে হারাতে হবে! হয়তো আমি থাকব না বা আরও অনেকেই হয়তো থাকবে না। সেই চিন্তা থেকেই আসলে ব্যক্তিগত দিনলিপি হিসেবে ডায়েরিতে মাথায় যা আসত বা যে ঘটনাগুলো চোখে পড়ত, তা লিখে রাখতাম। তখন ভাবিনি, আমার এই লেখাগুলো পাঠক পড়বে। ভাবিনি, এটি বইয়ে রূপান্তরিত হবে।’
লেখিকা আরও বলেন, ‘করোনাকালীন সমাজে এবং সারা বিশ্বে নানা ধরনের ইস্যু তৈরি হয়েছে এবং বিভিন্ন ধরনের ঘটনা ঘটেছে, যা আমি খুব সাধারণ একজন মানুষ হিসেবে ডায়েরিতে লিপিবদ্ধ করেছিলাম। আমি টানা এক বছর ৯ মাস ১০ দিন লিখে গেছি এই ডায়েরিতে। এখন সেটা প্রকাশ হয়েছে। বইটিতে ছোট ছোট কবিতা, গল্প, স্মৃতি ও নানা ধরনের ঘটনা ফুটে উঠেছে। বিষয়টা আমার কাছে অবশ্যই ভাল লাগার, আনন্দের ও দারুণ অভিজ্ঞতারও। আমার লেখা এই বই নিয়ে অনেকেই ইতিবাচক মন্তব্য করেছেন, যা আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে, করছে।’
বইটি নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে সাবেক প্রধান তথ্য কমিশনার ও আজকের পত্রিকার সম্পাদক অধ্যাপক ড. মো. গোলাম রহমান বলেন, ‘করোনাভাইরাস মহামারির ভয়ানক স্মৃতিতে ফারাহ জাবিন শাম্মী রোজনামচার আকারে উপস্থাপন করেছেন, একই সঙ্গে সেই সময়ের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও মানবিক বিষয়গুলোকে মনের গভীর থেকে উপলব্ধির চেষ্টা করেছেন। প্রতিদিনের এসব বিবরণ শুধু তথ্যবহুলই নয়, বরং যেকোনো পাঠকের অনুভূতিকে ছুঁয়ে যাবে অতলে। এই বইয়ের কোনো কোনো ঘটনা আমাকে কাঁদিয়েছে। অনেক বড় একটি বই হলেও এর প্রতিটা পৃষ্ঠা অন্য একটি পৃষ্ঠা পড়ার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করে।’
ব্র্যাকের এসোসিয়েট ডিরেক্টর শরিফুল হাসান বলেন, ‘করোনাপঞ্জি বইটি একটা বড় রকমের ডকুমেন্ট হয়ে গেল। বইটি গবেষকদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে এ ধরনের বই যত বেশি লেখা হবে ততই আমাদের জন্য সময়ের একটি দলিল হিসেবে তৈরি হবে। এই বইয়ের সবচাইতে বড় যে বিষয়টি আমাকে বিস্মিত করেছে সেটি হলো, লেখক একদিনের জন্যও এই ডায়েরি লেখা বন্ধ করেননি। বাবার মৃত্যু, নিজের করোনাআক্রান্ত হওয়া সে সব সময়েও তিনি লেখা থামিয়ে রাখেননি।’
আলোচনা অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন এডুকেশনাল সাইকোলজি অ্যান্ড কাউন্সেলিং বিভাগের প্রধান ও সহযোগী অধ্যাপক ড. আজহারুল ইসলাম, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সাইফুল আলম চৌধুরী, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের গবেষণা সহযোগী হোমায়রা আহমেদ প্রমুখ।
তথ্যবহুল, গবেষণামূলক এই বইটি সংগ্রহ করার জন্য পাঠকদের আহ্বান জানিয়ে স্বপ্ন ’৭১ প্রকাশনের প্রকাশক আবু সাঈদ অনুষ্ঠান শেষ করেন। স্বপ্ন ’৭১ প্রকাশনের এই আয়োজনের সঙ্গে সহ-আয়োজক হিসেবে ছিল মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সংগঠক ‘মুক্ত আসর’ ও বইবিষয়ক ম্যাগাজিন ‘বইচারিতা’।