অপরাধ : বছরের আলোচিত ১০ ঘটনা
নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলায় ৩৭ বছর বয়সী এক নারীকে ধর্ষণচেষ্টার পর বিবস্ত্র করে মারধর করা হয়েছিল। শুধু বিবস্ত্রই নয়, নির্যাতনের সেই দৃশ্যের ভিডিও ধারণ করেছিল দেলোয়ার বাহিনীর সদস্যরা। সেই সময় নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচতে ওই নারী নির্যাতনকারীদের ‘বাবা’ বলে সম্বোধন করেও নিস্তার পাননি। ঘটনা গত ২ সেপ্টেম্বরের।
পরে ওই নারীকে হামলাকারীরা কুপ্রস্তাব দেন। কিন্তু সেই প্রস্তাবে তিনি রাজি না হওয়ায় তারা ৪ অক্টোবর ধারণ করা ওই ভিডিওচিত্র সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আপলোড করলে তা ভাইরাল হয়। ঘটনাটি জানাজানি হলে সারা দেশে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। পরে জেলা শহরের মাইজদী হাউজিং এলাকার একটি বাসা থেকে ওই নারীকে উদ্ধার করে পুলিশ।
উদ্ধারের পর রাতেই ভুক্তভোগী নারী বাদী হয়ে দেলোয়ার বাহিনীর প্রধান দেলোয়ার, সহযোগী নুর হোসেন ওরফে বাদলসহ নয়জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতনামা আরো সাত থেকে আটজনকে আসামি করে থানায় পৃথক দুটি মামলা করেন। দুই মামলায় পুলিশ, র্যাব ও পিবিআই এ পর্যন্ত ১১ আসামিকে গ্রেপ্তার করেছে। এর মধ্যে এ পর্যন্ত ৯ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে নারী নির্যাতন মামলার চার আসামি আবদুর রহিম ও ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন, আনোয়ার হোসেন ওরফে সোহাগ (২১) ও নুর হোসেন ওরফে রাসেল (৩০) পৃথক আদালতে ১৬৪ ধারায় দোষ স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছেন।
অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা হত্যা মামলা
শুধু নারীকে বিবস্ত্র করে মারধর ও তা ভিডিও করার ঘটনাই নয়, করোনাকালের এই বছর এক ঘটনাবহুল বছর। ঈদুল আজহার আগের দিন রাতে, অর্থাৎ গত ৩১ জুলাই কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর চেকপোস্টে পুলিশ কর্মকর্তা লিয়াকত আলীর গুলিতে নিহত হন অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খান।
তবে সিনহাকে পরিকল্পিতভাবে গুলি করে হত্যা করেছিল টেকনাফ থানা পুলিশ। মামলাটির দীর্ঘ তদন্ত শেষে তদন্ত সংস্থা র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) এ দাবি করেছে। তদন্ত শেষে গত ১৩ ডিসেম্বর আলোচিত এ মামলার অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করে র্যাব।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশিক বিল্লাহ সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী অঞ্চলজুড়ে টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার যে ‘অবৈধ মাদক বাণিজ্য ও ভয়ভীতি-নির্যাতনের’ পরিবেশ গড়ে তুলেছিলেন, সেটি অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খান জেনে ফেলেছিলেন বলেই তাঁকে পরিকল্পিতভাবে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। এ ঘটনায় করা মামলায় ১৫ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ১৪ জন গ্রেপ্তার হয়েছেন আর একজন পলাতক আছেন।’
রিজেন্টের সাহেদ ও জেকেজির সাবরীনা
করোনাভাইরাস একের পর এক প্রাণ কেড়ে চলেছে। ভয় আর আতঙ্কে সবাই যখন দিশেহারা, ঠিক তখনই সামনে আসে করোনার নমুনা পরীক্ষা না করে রিপোর্ট দেওয়ার মতো ন্যক্কারজনক প্রতারণা। সেই খবর দেশ-বিদেশে আলোড়ন তুলেছিল। এই অভিযোগে রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান মো. সাহেদকে গত ১৫ জুলাই সাতক্ষীরার সীমান্ত এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। সিলগালা করে দেওয়া হয় হাসপাতালটির দুটি শাখা।
মো. সাহেদের মতো একই ধরনের অভিযোগে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের চিকিৎসক ও জেকেজির চেয়ারম্যান ডা. সাবরীনা আরিফ চৌধুরীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পুলিশের দাবি, ‘জোবেদা খাতুন স্বাস্থ্যসেবা (জেকেজি) প্রজেক্ট’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে কোভিড-১৯-এর নমুনা সংগ্রহ করে তা পরীক্ষা না করেই রিপোর্ট দিত।
রায়হান হত্যা মামলা
সিলেট নগরীর আখালিয়া নিহারিপাড়ার বাসিন্দা রায়হানকে ১০ অক্টোবর রাতে সিলেটের বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে তুলে নিয়ে নির্যাতন করা হয়। নির্যাতনের নির্দেশদাতা ছিলেন বন্দরবাজার ফাঁড়ির দায়িত্বরত উপপরিদর্শক (এসআই) আকবর। পরের দিন ১১ অক্টোবর মৃত্যু হয় রায়হানের। এ ঘটনায় হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনে তাঁর স্ত্রী তাহমিনা আক্তার বাদী হয়ে কোতোয়ালি থানায় মামলা করেন। মামলার পর মহানগর পুলিশের একটি অনুসন্ধান কমিটি তদন্ত করে নির্যাতনের সত্যতা পায়। পরে ১২ অক্টোবর ফাঁড়ির ইনচার্জের দায়িত্বে থাকা এসআই আকবর হোসেন ভূঁঞাসহ চারজনকে সাময়িক বরখাস্ত ও তিনজনকে প্রত্যাহার করা হয়। এরপর ১৩ অক্টোবর আকবর পুলিশি নজরদারি থেকে পালিয়ে গা-ঢাকা দেন।
পুলিশ সদর দপ্তরের নির্দেশনায় মামলাটির তদন্ত পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) ওপর ন্যস্ত হলে ১৯ অক্টোবর ফাঁড়ির সেন্ট্রি পোস্টে কর্তব্যরত তিনজন কনস্টেবল আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়ে রায়হানকে নির্যাতনের বর্ণনা ও নির্যাতনকারীদের নাম বলেন। সেখানে উঠে আসে, রায়হানকে নির্যাতনের মূল হোতা ছিলেন এসআই আকবর। পরে ৯ নভেম্বর দুপুরে কানাইঘাটের সীমান্তবর্তী ডোনা এলাকা থেকে ভারতে পালানোর সময় আকবরকে জেলা পুলিশের একটি দল গ্রেপ্তার করে।
ইউএনও ওয়াহিদার ওপর হামলা
চলতি বছরের আরেক আলোচিত ঘটনা কুড়িগ্রামের ঘোড়াঘাটের ইউএনও ওয়াহিদা খানমের ওপর হামলা, যে হামলায় মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে আসেন ওয়াহিদা। র্যাবের দাবি, বাড়িতে চুরি করতে এসে হামলা করা হয় ইউএনও ও তাঁর বাবার ওপর। একদল দুর্বৃত্ত গত ৩ সেপ্টেম্বর রাত আড়াইটার দিকে মই বেয়ে ইউএনও ওয়াহিদা খানমের সরকারি বাসভবনে ঢুকে পড়ে। তারা বাসভবনের ভেন্টিলেটর ভেঙে বাসায় ঢুকে ওয়াহিদা খানমকে হাতুড়ি দিয়ে পেটাতে শুরু করে। এ সময় ইউএনওর চিৎকার শুনে পাশের কক্ষে থাকা তাঁর বাবা ছুটে এসে মেয়েকে বাঁচানোর চেষ্টা করলে দুর্বৃত্তরা তাঁকেও জখম করে। পরে কোয়ার্টারের অন্য বাসিন্দারা তাঁদের চিৎকার শুনে পুলিশকে খবর দেয়। এরপর গুরুতর আহত অবস্থায় তাঁদের রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে অবস্থার অবনতি হলে তাঁদের ঢাকায় এনে চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করে তোলা হয়।
নৌবাহিনীর কর্মকর্তাকে মারধর
নৌবাহিনীর কর্মকর্তা ওয়াসিফ আহমেদ খানকে মারধরের অভিযোগে সাংসদ হাজী মোহাম্মদ সেলিমের ছোট ছেলে ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৩০ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মোহাম্মদ ইরফান সেলিমকে এক বছরের কারাদণ্ডাদেশ দিয়েছেন র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত।
গত ২৬ অক্টোবর হাজী সেলিমের পুরান ঢাকার দেবীদাস ঘাটের বাড়িতে চালানো অভিযান শেষে র্যাবের সাবেক নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলম দুটি আলাদা অভিযোগে ইরফান ও হাজি সেলিমের দেহরক্ষী মোহাম্মদ জাহিদকে ছয় মাস করে এক বছরের কারাদণ্ড দেন। ওই বাসায় অভিযানের সময় দুই ফ্লোর থেকে দুটি অবৈধ বিদেশি পিস্তল, গুলি, একটি এয়ারগান, ৩৭টি ওয়াকিটকি, একটি হাতকড়া এবং বিদেশি মদ ও বিয়ার পাওয়া যায়।
এর আগে ২৫ অক্টোবর রাতে ধানমণ্ডি এলাকায় সংসদ সদস্যের স্টিকারযুক্ত একটি গাড়ি থেকে নেমে নৌবাহিনীর লেফটেন্যান্ট মো. ওয়াসিফ আহমেদ খানকে মারধর করা হয়। এ ঘটনায় ধানমণ্ডি থানায় দায়ের করা মামলায় ইরফান সেলিম ছাড়াও হাজী সেলিমের প্রোটোকল অফিসার এ বি সিদ্দিক দিপু, ইরফানের দেহরক্ষী মোহাম্মদ জাহিদ ও গাড়িচালক মিজানুর রহমানের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতপরিচয় আরো তিনজনকে আসামি করা হয়।
গোল্ডেন মনির
গোল্ডেন মনির নব্বইয়ের দশকে গাউছিয়া মার্কেটে একটি কাপড়ের দোকানে সেলসম্যান হিসেবে কাজ করতেন। এরপর রাজধানীর মৌচাকে ক্রোকারিজের একটি দোকানে কাজ শুরু করে পরবর্তী সময়ে তা নিজ ব্যবসায় রূপ দেন। ওই ব্যবসা করতে করতে লাগেজ ব্যবসা শুরু করেন। এরপর থেকে তাঁর ভাগ্যের চাকা ঘুরতে থাকে। ট্যাক্স ফাঁকি দিয়ে কাপড়, কসমেটিকস, ইলেকট্রনিকস পণ্য, কম্পিউটার সামগ্রী, মোবাইল, ঘড়িসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র বিদেশ থেকে দেশে আনতেন। এভাবে একপর্যায়ে তিনি স্বর্ণ চোরাকারবারের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। তারপর রাজউকের কয়েকজন কর্মকর্তার যোগসাজশে তিনি বিপুল অর্থ-সম্পদের মালিক হয়েছেন বলে দাবি করে র্যাব। ঢাকা শহরের ডিআইটি প্রজেক্ট, বাড্ডা, উত্তরা, নিকুঞ্জ ও কেরানীগঞ্জে তাঁর ২০০টির বেশি প্লট আছে বলেও র্যাব জানায়। এভাবে গোল্ডেন মনির এক হাজার ৫০ কোটি টাকার মালিক বনে যান।
চিকিৎসা নিতে গিয়ে মৃত্যু
বছরের শেষভাগে দেশবাসীকে দেখতে হয়েছে আরেক পৈশাচিক ঘটনা। আদাবরের মাইন্ড এইড হাসপাতালে মানসিক চিকিৎসা নিতে গিয়ে হাসপাতালটির কর্মচারীদের মারধরের শিকার হয়ে নিহত হন এএসপি শিপন। তিনি ৩১তম বিসিএস পুলিশে কর্মকর্তা ছিলেন। ওই ঘটনায় শিপনের বাবা ফয়েজ উদ্দিন বাদী হয়ে ১০ নভেম্বর সকালে আদাবর থানায় হত্যা মামলা করেন। তুচ্ছ একটি ঘটনার কথাকাটাকাটির জেরে এই হত্যাকাণ্ড ঘটে বলে পুলিশ জানিয়েছিল। যে হাসপাতালে শিপন গিয়েছিলেন, সেটির কোনো অনুমোদন ছিল না। মাদক নিরাময় ও মানসিক চিকিৎসার নামে নির্যাতন, প্রশাসনের নাকের ডগায় অনুমোদনহীন হাসপাতালের কার্যক্রম পরিচালনা, সরকারি হাসপাতালের কিছু চিকিৎসকের অবৈধ প্রাইভেট প্র্যাকটিস, কমিশনের বিনিময়ে বেসরকারি হাসপাতালে রোগী পাঠানো—এসব গুরুতর অনিয়মও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
লালমনিরহাটে পুড়িয়ে হত্যা
লালমনিরহাট উপজেলার বুড়িমারী ইউনিয়নের বুড়িমারী কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে কোরআন শরীফ অবমাননার গুজব ছড়িয়ে আবু ইউনুস মো. শহিদুন্নবী জুয়েল নামের এক ব্যক্তিকে পিটিয়ে হত্যার পর লাশ পুড়িয়ে ছাই করার মতো ঘটনাও ঘটেছে এই বছরের ২৯ অক্টোবর। এ ঘটনায় তিনটি মামলা করা হয়। এসব মামলায় ১১৪ এজাহার নামীয় ও অজ্ঞাত শত শত মানুষকে আসামি করা হয়। সর্বশেষ পুলিশ ৩৩ জনকে গ্রেপ্তারের খবর জানিয়েছিল।
নবাবের নাতি
নিজেকে স্যার নবাব সলিমুল্লাহর ‘নাতি’ পরিচয় দিতেন নবাব খাজা আলী হাসান আসকারী (৪৮)। তিনি আরো বলতেন, তাঁর বাবা সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালের পরিচালক, দুবাইয়ে আছে তাঁর সোনার কারখানা। এটিও বলতেন, তাঁর বাবা ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের চেয়ারম্যান। অথচ, এসবই তাঁর ভুয়া পরিচয়। এই ভুয়া পরিচয়ে মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে করোনাভাইরাসের কারণে ৫০০ লোক নিয়োগ দেওয়ার কথা বলে প্রতারণা করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ ওঠে তাঁর বিরুদ্ধে। এর মধ্যেই মোহাম্মদপুর থানায় গত ২৪ অক্টোবর বিদেশে চাকরি দেওয়ার নামে প্রতারণার অভিযোগে একটি মামলা হয় আসকারীর বিরুদ্ধে। প্রতারণার শিকার ও মামলার বাদী ফেনীর স্কুলশিক্ষক আবদুল আহাদ সালমান। গত ২৮ অক্টোবর আলী হাসান আসকারীকে ওই মামলায় গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর পুলিশের ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম বিভাগ (সিটিটিসি)।