করোনায় সফল আওয়ামী লীগ, পাপিয়া-সাহেদকে নিয়ে অস্বস্তি
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী পালনসহ গুরুত্বপূর্ণ বছর ছিল টানা তৃতীয়বার ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের জন্য। কিন্তু করোনাভাইরাসে ছোবলে বছর জুড়েই স্থবির ছিল রাজনৈতিক সব কর্মকাণ্ড। তবে নিরুত্তাপ এ রাজনৈতিক মাঠ অনলাইন মাধ্যমে অনেকটাই সচল রাখতে চেষ্টা করেছে আওয়ামী লীগ। করোনাকালে স্থানীয় সরকারসহ কয়েকটি উপনির্বাচনে জয়ে কিছুটা উত্তাপ ছড়ালেও পুরো বছরই প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে পায়নি রাজনীতি। আওয়ামী লীগের সর্বশেষ ২১তম সম্মেলন হয় গত বছরের শেষ দিকে, ২০ ও ২১ ডিসেম্বর। কেন্দ্রীয় সম্মেলনের পর দলের তৃণমূলকে সাজাতে জেলা-উপজেলার সম্মেলন নিয়ে বছরের শুরুতে তোড়জোড় চলে।
বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী পালন উপলক্ষে ২০২০ সাল ঘিরে জমকালো আয়োজনের প্রস্তুতি ছিল আওয়ামী লীগের। এ জন্য ঘোষণা করা হয় কর্মসূচিও। ১০ জানুয়ারি মুজিববর্ষ উদযাপনের জন্য ক্ষণগণনার কর্মসূচি শুরু করা হয়। কিন্তু করোনার আঘাতে কর্মসূচি সীমিত করা হয়। তবে দীর্ঘদিন জেলা-উপজেলায় নতুন কমিটি গঠন না হওয়ায় অসন্তোষও রয়েছে তৃণমূলের নেতাকর্মীদের মধ্যে।
ঢাকার দুই সিটি নির্বাচন
বছরের শুরুতে জানুয়ারি থেকে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ভোট নিয়ে সাংগঠনিক ব্যস্ততায় বছর শুরু করে দলটি। সার্বিকভাবে সফলতাও পায় দলটি। দুই সিটিতে বিপুল ভোটে জয়ী হন দলটির প্রার্থীরা।
সাংগঠনিক কার্যক্রম
আওয়ামী লীগের ২১তম জাতীয় সম্মেলনের পর প্রথম যৌথসভা অনুষ্ঠিত হয় চলতি বছরের ৩ জানুয়ারি। ওই দিন সভা মুলতবি রাখা হয়। পর দিন গণভবনে আবার সভা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর দুই সিটির ভোটে বিজয়ী হয়ে জেলা-উপজেলা সম্মেলনে জোর দেয় আওয়ামী লীগ। করা হয় তিনটি জেলা ও কয়েকটি উপজেলা সম্মেলন। ৮ মার্চ দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত প্রথম রোগী শনাক্ত হয়। স্থগিত করা হয় সব সাংগঠনিক কর্মসূচি। তবে এপ্রিল থেকে জুলাই পর্যন্ত চার মাস দৃশ্যত আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কোনো কর্মসূচি না থাকলেও দুস্থদের মধ্যে খাবার বিতরণ ও স্বাস্থ্যসুরক্ষা সামগ্রী বিতরণ করেছে দলটি। এ সময় কৃষকের ধান কাটায় সহায়তা করে দেশবাসীর নজর কাড়ে ছাত্রলীগ। ধান কাটেন আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতারাও।
গত ৩ অক্টোবর গণভবনে দলের কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠক ডাকা হয়। বৈঠকে সাংগঠনিক গতি আনতে আট বিভাগের জন্য আটটি সমন্বয় টিম গঠন করা হয়। নভেম্বরে ফের শুরু হয় জেলা-উপজেলা সম্মেলন। এর মধ্যেই পৌর নির্বাচনের মাধ্যমে আটঘাট বেঁধে মাঠে নামেন নেতারা। বছরের শুরুতেই ভোট ও সম্মেলন, শেষ দিকে পৌর নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী বাছাই, জেলা-উপজেলা সম্মেলনে দল গোছানোর মধ্যে সক্রিয় কেন্দ্রীয় নেতারা। পাঁচটি উপনির্বাচনেও অংশগ্রহণ করতে হয়েছে চলতি বছর।
প্রতি বছর জাঁকজমকপূর্ণভাবে দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করলেও এবার করোনার কারণে তা হয়নি। ভার্চুয়ালি আলোচনা সভা হয়। এ ছাড়াও বছর শেষের দিকে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগসহ বেশ কিছু সাংগঠনিক জেলায় পূর্ণাঙ্গ কমিটি দিয়েছে দলটি। এর মধ্যে সহযোগী সংগঠনগুলোও পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করেছে। বিদায়ী বছরে ১০টি সংসদীয় উপনির্বাচনে দলীয়ভাবে অংশ নিয়ে বিজয়ী হয়েছেন ক্ষমতাসীনরা।
করোনা পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক হওয়ার পর আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনের কমিটি, দলের বিভিন্ন উপকমিটি অনুমোদন দেওয়া হয়।
করোনায় প্রশংসনীয় কর্মকাণ্ড
দেশে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরুর পর প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা দলের নেতাকর্মীদের মানুষের পাশে দাঁড়ানোর নির্দেশ দেন। দলীয় প্রধানের নির্দেশনা মেনে সারা দেশে স্বাস্থ্যবিধি মানতে মানুষকে সচেতন করার পাশপাশি সুরক্ষা সামগ্রী বিতরণ করেন নেতাকর্মীরা। টানা লকডাউনে নিম্নবিত্ত ও সম্বলহীন মানুষের দিকে বাড়িয়ে দেন সাহায্যের হাত। সরকারি ত্রাণের পাশাপাশি দলের পক্ষ থেকে ত্রাণ নিয়ে নেতাকর্মীরা ছুটে যান মানুষের দুয়ারে দুয়ারে। দলের সহযোগী সংগঠন মহিলা আওয়ামী লীগ, কৃষক লীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা করোনার মধ্যে মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে জনগণের প্রশংসা কুড়িয়েছেন।
করোনার কারণে আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবন থেকে বের না হলেও কেন্দ্রীয়, জেলা ও বিভাগীয় নেতাদের সঙ্গে সব সময় যোগাযোগ রাখছেন। ভার্চুয়াল মিটিংয়ে দিচ্ছেন প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা। মাঠের কর্মসূচি না থাকলেও বিষয়ভিত্তিক ভার্চুয়াল সভা করছে আওয়ামী লীগ।
সাংগঠনিক শৃঙ্খলায় নজর
স্থানীয় নির্বাচনগুলোয় বিদ্রোহী প্রার্থী গত কয়েক বছর ধরে আওয়ামী লীগের মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাই অভ্যন্তরীণ কোন্দল থেকে দলে শৃঙ্খলা ফেরাতে জোর দিয়েছে দলটি। এজন্য নির্বাচনে দলের বিদ্রোহী প্রার্থীদের বিষয়ে কঠিন সিদ্ধান্ত নেয় আওয়ামী লীগ। স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন নির্বাচনে অতীতে যারা বিদ্রোহী প্রার্থী ছিলেন, তাদের অনেককে মনোনয়ন দিয়ে আবার ফিরিয়ে নেওয়া হয়। এ ছাড়াও ২৮ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ডের সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় বিদ্রোহী প্রার্থীদের আর কখনো নৌকা প্রতীক না দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।
এ ছাড়াও দলীয় কোন্দলের অভিযোগে কয়েকটি জেলা কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে অব্যাহতি দিয়ে নতুনদের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
পাপিয়া-সাহেদকে নিয়ে অস্বস্তি
নরসিংদী যুব মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক শামিমা নূর পাপিয়া। তার স্বামী মফিজুর রহমান ছাত্রলীগের সাবেক নেতা। এই দম্পতিকে গত ২২ ফেব্রুয়ারি ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে আটক করে র্যাব। দুজন সহযোগীসহ তাঁরা বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন।
আটকের পর র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক সারওয়ার বিন কাশেম সাংবাদিকদের বলেন, শামিমা নূর পাপিয়া ছিলেন মূলত একজন মধ্যস্থতাকারী বা দালাল। নারীদের দিয়ে দেহব্যবসা করানো, মানুষের জমি ছাড়িয়ে দেওয়া, জমি দখল করে দেওয়া, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি এসবের সঙ্গে জড়িত তিনি। বড় একটি পাঁচতারা হোটেলে রুম বুক করে নারীদের বিভিন্ন অনৈতিক কাজে ব্যবহার করতেন।
শামিমা নূর পাপিয়াকে নিয়ে নানা খবর প্রকাশিত হওয়ার পর তাকে নিয়ে আওয়ামী লীগ ও যুব মহিলা লীগ বেশ বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে। বিশেষ করে পাপিয়ার সঙ্গে সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতা এবং মন্ত্রীদের ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপকভাবে শেয়ার হওয়ার পর এটি তাদের মধ্যে বিরাট অস্বস্তি তৈরি করে। গত ১২ অক্টোবর পাপিয়া ও তার স্বামীকে অস্ত্র মামলায় ২০ বছর করে কারাদণ্ডাদেশ দেন ঢাকার আদালত।
পাপিয়ার পর রিজেন্ট হাসপাতালের মালিক সাহেদ করিমের কাণ্ডে আওয়ামী লীগে হাইব্রিড-অনুপ্রবেশের বিতর্ক তুঙ্গে ওঠে। করোনাভাইরাসের নমুনা পরীক্ষা নিয়ে প্রতারণা করা সাহেদ আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক উপকমিটির সদস্য ছিলেন। সাহেদকে নিয়ে চাপের মুখে পড়ে আওয়ামী লীগ। তখন দলের ভেতর থেকেই প্রশ্ন ওঠে পাপিয়া-সাহেদরা আওয়ামী লীগে জায়গা পায় কীভাবে। এরপর ভারতে পালানোর সময় ১৫ জুলাই ভোরে সাতক্ষীরা সীমান্ত থেকে সাহেদকে অস্ত্র-গুলিসহ গ্রেপ্তার করে র্যাব। এরই মধ্যে অস্ত্র আইনের একটি মামলায় সাহেদকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ দিয়েছেন আদালত।
শুদ্ধি অভিযান
দলে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে এবং দলের নাম বিক্রি করে দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, ক্যাসিনোকাণ্ড, মাদকের সাম্রাজ্যে জড়িয়ে পড়া নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ২০১৯ সালে শুদ্ধি অভিযান শুরু করে দলটি। এ অভিযান ২০২০ সালেও চলমান রয়েছে।
যাদের হারাল দল
চলতি বছর মারা গেছেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সাবেক দুই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মো. নাসিম ও সাহারা খাতুন। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ধর্ম প্রতিমন্ত্রী শেখ মো. আব্দুল্লাহ, সিলেট সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র বদর উদ্দিন আহমেদ কামরান, নওগাঁ-৬ আসনের সংসদ সদস্য ইসরাফিল আলম, সাবেক সাংসদ হাজি মকবুল হোসেন, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী আ খ ম জাহাঙ্গীর হোসাইনসহ অনেকে।
জাতির পিতার ভাস্কর্য ইস্যু
কুষ্টিয়ায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য ভাঙচুরের প্রতিবাদে রাজপথে সক্রিয় হন আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। দেশজুড়ে বিক্ষোভ মিছিলের মতো কর্মসূচি পালন করে সহযোগী সংগঠনগুলো।
১৪ দলীয় জোটের নতুন মুখপাত্র
মোহাম্মদ নাসিমের মৃত্যুর পর আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের নতুন মুখপাত্রের দায়িত্ব দেওয়া হয় প্রবীণ রাজনীতিক আমির হোসেন আমুকে।
কেন্দ্রীয় কমিটির বিভিন্ন শূন্য পদ পূরণ
কেন্দ্রীয় কমিটিতে শূন্য কয়েকটি পদ পূরণ করেছে আওয়ামী লীগ। বছরের শেষদিকে ৭ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে নতুন দুজন সদস্য নির্বাচিত করা হয়। তাঁরা হলেন বাংলাদেশের প্রথম পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদের ছেলে আজিজুস সামাদ আজাদ ডন ও ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি সৈয়দ আবদুল আউয়াল শামীম। এর আগে ১১ সেপ্টেম্বর পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সাবেক সভাপতি সিদ্দিকুর রহমানকে দলের শিল্প ও বাণিজ্য বিষয়ক সম্পাদক এবং ২৫ নভেম্বর সিরাজুল মোস্তফাকে ধর্ম সম্পাদক করা হয়।