আকাশ ছুঁতে চায় স্বপ্নচূড়া ক্লাবের কিশোরী ফুবলাররা
লিজা রানী তালুকদার। বাড়ি সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার তাড়ইল ইউনিয়নের ভাঙ্গাডর গ্রামে। ১০ নম্বর জার্সি পরে স্টাইকারে খেলে। এরই মধ্যে সিলেটের বিভাগীয় পর্যায়ে খেলে এসেছে। কিন্তু করোনা মহামারি আসার পর মাঠের খেলা বন্ধ থাকায় আর খেলা হচ্ছে না। তাই প্রতিদিন ভোরে মাঠে কঠোর অনুশীলনে ব্যস্ত সময় কাটায়। তবে দিরাই উপজেলা থেকে তার বাড়ি প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে। নৌকায় আসতে এক ঘণ্টারও বেশি সময় লেগে যায়। তারপরও এতটুকু আশা ছাড়েনি। ঝড়-বৃষ্টি উপেক্ষা করে মাঠে অনুশীলনে আসে লিজা।
লিজা বলে, ‘একজন ভালো খেলোয়ার হবো, তাই আলসেমি করি না। আমরা সবাই অনেক পরিশ্রম করি। সমাজের মানুষের নানা কটু কথার পরও পরিবার অনেক আশা নিয়ে আমাকে খেলতে দিয়েছে। তাই রাকিব স্যার যেভাবে শেখায়, আমরা চেষ্টা করি তেমন করে শিখতে।’
শুধু লিজা নয়, এমন করে অর্ধশতাধিক কিশোরী প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। একইভাবে জাতীয় লিগে অংশ নেওয়া একা দাস প্রতিদিন নয় কিলোমিটার দূর থেকে নৌকায় ও গাড়ি করে অনুশীলনে মাঠে আসে।
বলছিলাম সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার স্বপ্নচূড়া স্পোটিং ক্লাবের কিশোরী ফুটবলারদের কথা।
বর্ষায় হাওর এলাকার মাঠঘাট-রাস্তাসহ সব কিছুই পানিতে ডুবে থাকে। তখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ পাশের বাড়িতে যাওয়াও দুষ্কর হয়ে পড়ে। এমনিতেই সুনামগঞ্জের প্রত্যন্ত অঞ্চলের কিশোরী মেয়েদের ঘরের বাইরে বের হতে দেয় না। সেখানে মেয়েদের খেলাধুলা করার কথা তো কল্পনাই করা যায় না। আর এসব এলাকার মেয়েদের ফুটবল অথবা ক্রিকেট খেলার কথা হলে তো আর প্রশ্নই উঠে না।
এদিকে, যখন সমাজের নানা বিধি নিষেধ কিশোরীদের বাধ্য করে ঘরের ভেতরেই আটকে রাখতে, ঠিক সেই সময়ে সুমাগঞ্জের দিরাইয়ের হাওরের প্রত্যন্ত এলাকার প্রায় অর্ধশতাধিক কিশোরী মাঠে ফুটবল খেলার কঠোর অনুশীলনে ব্যস্ত। তাদের সবার স্বপ্ন ফুটবলার হয়ে আকাশ ছোঁয়ার। একইসঙ্গে ভালো ফুটবল খেলে জাতীয় টিমে সুযোগ পেয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়েও দেশের হয়ে অবদান রাখাতে চায় তারা।
এরই মধ্যে ওই ক্লাবের ছয় কিশোরী অংশ নিয়েছে জাতীয় ফুটবল লিগেও। আর এই কিশোরীদের স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দিতে দিনরাত কাজ করে যাচ্ছেন স্বপ্নবাজ যুবক রাকিব আহমদ। তিনি এই অর্ধশত কিশোরীকে নানা বাধা বিপত্তি পার করে তাদের স্বপ্নের জায়গায় নিয়ে যেতে চান। শুধু সবার সহযোগিতা চান তিনি।
২০১৯ সালে দিরাই উপজেলায় প্রায় অর্ধশাধিক কিশোরী নিয়ে স্বপ্নচূড়া স্পোটিং ক্লাবটি গড়ে উঠে। তবে শুরুতে নানা বাধা বিপত্তি থাকলেও এখন সব বাধা পেরিয়ে বর্তমানে ক্লাবের সদস্য সংখ্যা প্রায় ৬০ থেকে ৭০ জন। রক্ষণশীলতার কারণে প্রথম প্রথম অভিভাবকরা তাদের মেয়েদের ফুটবল খেলায় দিতে চাইতেন না। এখন অনেক অভিভাবক উৎসাহিত হচ্ছেন। আর সামনে এগিয়ে যাওবার স্বপ্ন নিয়ে কিশোরীররা প্রতিদিন ভোরে উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম থেকে মাঠে অনুশীলনের জন্য জড়ো হয়। মাত্র এক বছরের ব্যবধানে এরই মধ্যে স্বপ্নচূড়া ক্লাবের আয়েশা, পূর্ণিমা, পলি, একা, মৌ ও জুবলী বেগম সিলেট বিভাগের হয়ে খেলেছে জাতীয় পর্যায়ের লিগে।
সর্বশেষ বাংলাদেশ মহিলা ফুটবল প্রিমিয়ার লিগে অংশ নেওয়ার জন্য সপ্তম দল হিসেবেও তালিকাভুক্ত হয়েছিল। এ ছাড়া ক্লাবের কিশোরীরা দেশের বিভিন্ন জেলায় খেলেছে কয়েকবার।
কিশোরী ফুটবলারা জানায়, বাধা সব সময়ই ছিল। প্রথমে যেমন ছিল এখনো আছে। মাঠে অনুশীলনে আসার সময় প্রায়ই মানুষ কটু কথা বলে থাকে। মেয়ে হয়ে কেন মাঠে যাই, মেয়েদের খেলাধুলা করা ঠিক না। কিন্তু আমরা আমাদের পরিবারের সবার সম্মতি পেয়ে মাঠে এসেছি। ফুটবল খেলাকে ভালোবেসে তাই মানুষ কী বলে তাতে আমাদের কিছু যায় আসে না। ক্লাবের সবাই চায় ভালো ফুটবল খেলে জাতীয় পর্যায়ে খেলার। ভালো খেলে নিজের পরিবারের পাশাপাশি এলাকার জন্য সম্মান নিয়ে আসা।
তেমনই একজন ইমা। দিরাই সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ১০ শ্রেণির ছাত্রী। সে জানায়, বাড়ির পাশে মাঠ হওয়ায় ছোট থাকতেই ফুটবল খেলা ভালো লাগে তার। নিজের বাবা ভাইকে মাঠে খেলতে দেখে সেও স্বপ্ন দেখত একদিন ফুটবলার হওয়ার। প্রথম দিকে বাবা ও ভাইরা মানা করেছে। তবে তার নানা তাকে খেলতে উৎসাহ দিয়েছেন। তাই এখন সে খেলে। মাঠে পজিশন তার লেফট আউট।
ইমা আরো বলে, ‘আমরা সবাই জিদ করে নিয়েছি। আমাদের সবাই অনেক কথা বলে তারপরও আমরা মাঠে খেলি। আমরা শুধু খেলতে চাই। আর ভালো খেলে সবাইকে সঠিক জবাব দেব। আর ভালো খেলে আমার পরিবারের পাশাপাশি আমরা এলাকার মুখ উজ্জ্বল করতে চাই।’
এইচএসসি পরীক্ষার্থী ধূপতি নন্দী বলেন, ‘ছোট থেকেই আমি ফুটবল খেলতাম। স্কুলে থাকতেও ফুটবল খেলেছি। কিন্তু পরে খেলা বন্ধ হয়ে যায়। কারণ এরপর কোথাও খেলার সুযোগ ছিল না। তাই স্বপ্নচূড়া ক্লাব হওয়ার পর আবার খেলার সুযোগ হয়েছে। তবে বড় হয়ে যাওয়ার পর আর পরিবারও দিতে চাইছিল না। কারণ মানুষজন খারাপ বলত, তাই পরিবারও নিষেধ করেছে। কিন্তু আমার মা আর বোনেরা খুব সাপোর্ট দেওয়ায় আমি আবার মাঠে আসি। তবে এইবার সবাই সাপোর্ট দিচ্ছে। আমি আরো ভালো খেলতে চাই, ভালো করতে চাই। জাতীয় পর্যায়ে খেলে আন্তর্জাতিক পর্যায়েও যেতে চাই।’
মেয়েদের এমন সাফল্যে অভিভাবকরাও খুশি। ইমার বাবা মো. মফিশুর বলেন, ‘মেয়ে বলে আমি ঘরে বসিয়ে রাখিনি। আমার ছেলেরাও ফুটবল খেলে। এখন আমার মেয়েও খেলে। মেয়ে ভালো করছে। সবার মুখে মেয়ের প্রশংসা শুনে খুব গর্ব হয়। যদিও প্রথমে মানুষজন নানা কথা বলছিল। তবে তাদের দল ভালো করায় এখন আবার সবার দৃষ্টিভঙ্গি বদলাচ্ছে। তবে মানুষ যাই বলুক আমি মেয়েকে সব সুবিধা দিতে চাই। মেয়ে নিজের যোগ্যতায় যত দূর যেতে পারে।’
আর যাকে ঘিরে দিরাইয়ের অর্ধশত কিশোরী এত স্বপ্ন দেখছে তিনি হলেন দিরাই উপজেলার ভাড়িপাড়া এলাকার স্বপ্নবাজ তরুণ রাকিব আহমেদ।
রাকিব আহমেদ জানান, ভালো ফুটবল খেলে জাতীয় পর্যায়ে খেলার ইচ্ছে ছিল কিন্তু ইনজুরিসহ নানা সমস্যার কারণে আর ফুটবল খেলা হয়নি। তাই নিজ এলাকায় ব্যতিক্রমী কিছু করার প্রত্যয় থেকে কিশোরীদের নিয়ে স্বপ্নচূড়া ফুটবল ক্লাব গড়ে তোলেন দিরাইয়ের ভাটিপাড়ার যুবক রাকিব আহমেদ।
রাকিব বলেন, ‘প্রতিদিন কঠোর পরিশ্রম করছে তারা। তবে প্রথম প্রথম অভিভাবকরা মেয়েকে দিতে চাননি। কিন্তু ধীরে ধীরে তাঁদের বিশ্বাস হয়। এখন তাঁরা তাঁদের মেয়েদের দেন। এখন ক্লাবে ৬০ থেকে ৭০ জন কিশোরী প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। আর আমাদের ক্লাব এরই মধ্যে সিলেট চট্টগ্রামসহ কয়েকটি জেলায় খেলে এসেছে। আমাদের ক্লাবের বিষয়ে প্রশাসন খুব আন্তরিক। তবে আর্থিক তেমন কোনো সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে না। দু-একজন প্রবাসী কিছু সহযোগিতা করেন। তাঁদের এই সহযোগিতা দিয়ে কোনোমতে চলছে।
রাকিব আরো বলেন, ‘যে যেভাবেই আমাদের দেখুক। আমি এই কিশোরীদের স্বপ্নকে আরো সামনের দিকে এগিয়ে নিতে সহযোগিতা করব।’