ইউরোপে পাঠানোর কথা বলে ভারতে নিয়ে নির্যাতন
রাজধানীর মিরপুর থেকে সংঘবদ্ধ মানবপাচার চক্রের ‘মূলহোতা’সহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। চক্রটির বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা বিদেশ গমনেচ্ছুদের টার্গেট করে অস্ট্রেলিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পাঠানোর প্রলোভন দেখাতেন।
চক্রটির প্রলোভনে যারা রাজি হতেন, তাদের কাছ থেকে ১২ থেকে ১৫ লাখ বা তারও বেশি টাকা নেওয়া হতো। এরপর ভারতে নিয়ে টর্চার সেলে নির্যাতন করা হতো। করা হতো পাচার। চক্রটি একই প্রক্রিয়ায় শতাধিক ব্যক্তিকে ভারতে পাচার করেছে।
গতকাল সোমবার দিবাগত রাতে রাজধানীর পল্লবী ও উত্তরায় অভিযান চালিয়ে গ্রেপ্তার করা হয় চক্রের ‘মূলহোতা’ মল্লিক রেজাউল হক ওরফে সেলিম (৬২) এবং তাঁর দুই সহযোগী মো. বুলবুল আহমেদ মল্লিক (৫৫) ও নিরঞ্জন পালকে (৫১)।
আজ মঙ্গলবার দুপুরে কারওয়ান বাজারের র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ কথা জানান র্যাব-৪ এর অধিনায়ক (সিও) অতিরিক্ত ডিআইজি মোজাম্মেল হক।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ওই চক্রটি বিদেশ গমনেচ্ছুদের ‘বাংলাদেশ থেকে ভিসা পাওয়া জটিল’ বুঝিয়ে ভারতে নিয়ে যেত। সেখানে যাওয়ার পর তাদের টর্চার সেলে আটকে রেখে আরও টাকা দাবি করতো। চক্রটি শতাধিক ব্যক্তিকে ভারতে পাচার করেছে। তারা কিন্তু এখন পর্যন্ত একজনকেও ইউরোপ বা অস্ট্রেলিয়ায় নিয়ে যায়নি। অর্থাৎ, তাদের সঙ্গে যারা যোগাযোগ করেছেন, সবার সঙ্গেই প্রতারণা করেছে চক্রটি।
মোজাম্মেল হক বলেন, ‘ভারতে নিয়ে ভিকটিমদের প্রথমে সেফ হাউজে নেওয়া হতো। সাধারণত যাদের পাচার করা হয়, তাদের সেখানে রাখা হয়। এই হাউজে নিয়ে পাচার হওয়া ব্যক্তিদের নির্যাতন করা হতো। চলতো অমানবিক নির্যাতন। এসব নির্যাতনের ভিডিও ধারণ করে বাংলাদেশ থাকা ভিকটিমদের পরিবারকে পাঠাতো চক্রটি। পরিবারকে তারা এসব ভিডিও দেখিয়ে বলতো, ১২-১৫ লাখ টাকা মুক্তিপণ না দিলে ভিকটিমকে মেরে ফেলবে। কখনো তারও বেশি বেশি দাবি করা হতো। পরে ভিকটিমদের পরিবারগুলো প্রিয়জনকে বাঁচাতে সর্বস্ব বিক্রি করে চক্রটির সদস্যদের হাতে টাকা তুলে দিতো।’
অতিরিক্ত ডিআইজি মোজাম্মেল হক বলেন, গত বছরের নভেম্বর মাসে অস্ট্রেলিয়া পাঠানোর কথা বলে জাহাঙ্গীর নামে এক ব্যক্তিকে ভারতে পাচার করে চক্রটি। পাচার হয়ে যাওয়ার পর বেশ কিছুদিন কলকাতায় আটক থাকেন জাহাঙ্গীর। আটক অবস্থায় কলকাতার টর্চার শেলে তাকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয়। পরে নির্যাতনের এসব ভিডিও দেখিয়ে দেশে থাকা তার পরিবারকে চাপ প্রয়োগ করে অর্থ আদায় করে পাচারকারীরা। দেশে এসে ভিকটিম জাহাঙ্গীর চক্রটির বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দায়ের করে আমাদের কাছে। তার দেওয়া তথ্য ও অভিযোগ যাচাই করে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে এই চক্রের মূলহোতাসহ তিনজনকে গতকাল রাতে গ্রেপ্তার করা হয়।
সংবাদ সস্মেলনে বলা হয়, গ্রেপ্তারের সময় তাদের কাছ থেকে ভুয়া পাসপোর্ট, পাসপোর্টের কপি, নকল ভিসা, আবেদনপত্র, বায়োডাটা, ছবি, মোবাইল, মোবাইল সিম একং নগদ টাকাসহ মানবপাচার সংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ নথি জব্দ করা হয়।
মোজাম্মেল হক আরও বলেন, ‘এই চক্রে গ্রেপ্তারকৃতরা ছাড়াও সহযোগী হিসেবে আরও পাঁচ-সাতজন রয়েছে। এ ছাড়া ভারতেও তাদের বেশ কয়েকজন সহযোগী রয়েছে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে কলকাতার রাজিব খান, মানিক ও দিল্লির রবিন সিংয়ের নাম পাওয়া যায়। গত কয়েক বছর ধরে এই চক্রটি সক্রিয়ভাবে মানবপাচার করে আসছে।’
গ্রেপ্তারকৃতদের বরাত দিয়ে ডিআইজি মোজাম্মেল হক আরও বলেন, ভিকটিমদের ফেনী, কুমিল্লা, নবাবগঞ্জ, শরীয়তপুর, মাদারীপুর এবং ঢাকার বিভিন্ন এলাকা থেকে সংগ্রহ করে ইউরোপে উন্নত চাকরি দেওয়ার নামে বৈধ এবং অবৈধ পথে পার্শ্ববর্তী দেশে পাচার করে দিতেন তারা। এসব বিষয়ে বিস্তারিত জিজ্ঞাসবাদ করা হচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে মানবপাচার আইনে রূপনগর থানায় মামলা হয়েছে।