কিশোরীকে বিয়ে করা সেই চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে মামলা, অতঃপর বরখাস্ত
পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলায় প্রেমের সালিশ বৈঠকে গিয়ে কিশোরীকে জোর করে বিয়ে ও তালাকের ঘটনায় কনকদিয়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মো. শাহিন হাওলাদারসহ ছয়জনের নামে মামলা করা হয়েছে। এ ছাড়া এ ঘটনায় ওই চেয়ারম্যানকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়।
আজ সোমবার সকালে প্রেমিক যুবক রমজান হাওলাদারের বড় ভাই হাফেজ মো. আল ইমরান বাদী হয়ে পটুয়াখালীর সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলাটি করেন।
আদালত মামলাটি গ্রহণ করে আগামী ৩০ দিনের মধ্যে জেলা পিবিআই প্রধানকে তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য নির্দেশ দিয়েছেন।
মামলার আইনজীবী অ্যাডভোকেট মো. আল আমিন জানান, অভিযুক্ত ইউপি চেয়ারম্যান তাঁর ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন। চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে মামলার পর তাঁকে বরখাস্ত করেছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়।
আইনজীবী আরও জানান, প্রথমত অভিযুক্ত চেয়ারম্যান ওই মেয়েটি নাবালিকা জেনেও জোর করে বিয়ে করেছেন এবং রমজান হাওলাদারকে হত্যার উদ্দেশে মারধর করে তাঁকে বিষপানে হত্যার চেষ্টা চালান। এ ঘটনা বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে তালাকনামা চেয়ারম্যান তৈরি করেন। এ ঘটনায় করা মামলায় চেয়ারম্যানসহ তাঁর পাঁচ সহযোগী এবং নিকাহ রেজিস্ট্রার ও কাজী মাওলানা মো. আইয়ুবকে আসামি করা হয়েছে। আদালতে কিশোরীর জন্ম সনদ এবং রমজান হাওলাদারের চিকিৎসা সংক্রান্ত কাগজপত্র উপস্থাপন করা হয়েছে।
এর আগে শাহিন হাওলারকে ইউপি চেয়ারম্যান পদ থেকে বরখাস্ত করা হয়। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. হায়দার আলীর পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার ৬ নম্বর কনকদিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. শাহিন হাওলাদার সালিশ করতে গিয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করে এক অপ্রাপ্তবয়স্ক (১৪ বছর ২ মাস ১৪ দিন) কিশোরীকে বিয়ে করায় স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) আইন ২০০৯ এর ৩৪ (৪) (ঘ) ধারার অপরাধ সংঘটিত করায় তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
কেন তাকে চূড়ান্তভাবে অপসারণ করা হবে না তা পত্র প্রাপ্তির ১০ কার্যদিবসের মধ্যে তার জবাব সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে স্থানীয় সরকার বিভাগে পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
শাহিন হাওলাদার কনকদিয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও বাউফল উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। তিনি ২১ জুন অনুষ্ঠিত ইউপি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে দ্বিতীয় মেয়াদে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, বাউফলের কনকদিয়া ইউনিয়নের নারায়ণপাশা গ্রামের এক যুবকের সঙ্গে স্কুলছাত্রী ওই কিশোরীর প্রেমের সম্পর্ক ছিল। কিন্তু এ সম্পর্ক মেনে নিতে পারেননি কিশোরীর বাবা। তিনি বিষয়টি কনকদিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শাহিন হাওলাদারকে জানান। এ নিয়ে গত শুক্রবার ইউনিয়ন পরিষদে সালিশ বৈঠক বসেন চেয়ারম্যান। ওই বৈঠকে দুই পরিবারের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। সালিস বৈঠকে কিশোরীকে দেখে পছন্দ হয়ে যাওয়ায় তাকে বিয়ের প্রস্তাব দেন চেয়ারম্যান শাহিন হাওলাদার। মেয়ের বাবা এ বিয়েতে সম্মতি জানালে ওই দিন বাদ জুমা পাঁচ লাখ টাকা কাবিনে কিশোরীকে বিয়ে করেন চেয়ারম্যান।
ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে ইউপি চেয়ারম্যান শাহিন হাওলাদার বলেন, ‘তিন বছর আগেই আমি দ্বিতীয় বিয়ে করতাম। নির্বাচনের কারণে দেরি হয়েছে।’
এ বিষয়ে সংবাদমাধ্যমে আসা প্রতিবেদন হাইকোর্টে দাখিলের পর সাবেক ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল আমাতুল করিম ও ইকরামুল হক টুটুল বিষয়টি আদালতের নজরে আনেন। গত রোববার বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি এস এম মনিরুজ্জামানের হাইকোর্ট বেঞ্চ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ঘটনাটি তদন্তের নির্দেশ দেন। পটুয়াখালীর জেলা প্রশাসক, জেলা নিবন্ধক ও পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) তদন্ত করে আলাদা তিনটি প্রতিবেদন ৩০ দিনের মধ্যে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলের কাছে দাখিল করতে বলেন। একইসঙ্গে ক্ষমতার অপব্যবহার করায় চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে রুল জারি করেছেন আদালত এবং ওই কিশোরীকে নিরাপত্তা দিতে পুলিশ সুপারকে (এসপি) নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এ সময় আদালত বলেন, পত্রিকার প্রতিবেদন দেখে যা বুঝলাম সালিশ করার জন্য ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয়ে ক্ষমতার অপ্যবহার করেছেন ওই চেয়ারম্যান।
পরে এ মামলার পরবর্তী সময়ে আদেশের জন্য আগামী ৮ আগস্ট দিন নির্ধারণ করেছেন আদালত।
আইনজীবী আমাতুল করিম ও ইকরামুল হক টুটুল বলেন, পটুয়াখালী জেলা প্রশাসক চেয়ারম্যানের ক্ষমতার অপব্যবহার তদন্ত করবেন, পিবিআই ফৌজদারি অপরাধের বিষয়ে তদন্ত করবে এবং জেলা নিবন্ধক বিয়ে নিবন্ধনের বিষয়ে তদন্ত করবেন।
এদিকে চেয়ারম্যান শাহিন হাওলাদার কিশোরীকে বিয়ে করার পর প্রেমিক যুবক বিষপানে আত্মহত্যার চেষ্টা চালান। এই বিয়ের ঘটনাটি জানাজানি হলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। বিয়ে করার পরদিন চেয়ারম্যানকে তালাক দিয়ে বাবার বাড়ি ফিরে গেছে সেই কিশোরী। শনিবার সন্ধ্যায় স্থানীয় কাজীর মাধ্যমে তালাক সম্পন্ন হয়।
কিশোরীর বাবা মেয়ের তালাকের বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, তাঁর মেয়ে এখন বাড়িতেই আছে।