গভীর শ্রদ্ধায় মোস্তফা কামাল সৈয়দকে স্মরণ, এনটিভিতে দোয়া মাহফিল
বাঁ পাশে দূরাভাষ, হ্যান্ড স্যানিটাইজার, টিস্যু বক্স। ডেস্কটপের পাশেই কলমদানি, ক্যালেন্ডার। ডানে নোটবুক, ডায়েরিসহ প্রয়োজনীয় কাগজ। টেবিলে ছড়ানো পত্রিকার কাগজ। পরিচ্ছন্ন-মনোরম কক্ষটি ঠিক আগের মতোই রয়ে গেছে। শুধু মাঝের চেয়ারটা শূন্য। এখানেই বসতেন মোস্তফা কামাল সৈয়দ। দীর্ঘদিন এখানে বসে চালিয়েছেন বর্ণিল কর্মযজ্ঞ। আর তিনি এ চেয়ারটিতে বসবেন না। দেবেন না কোনো নির্দেশনা। কক্ষে প্রবেশ করতেই যেন নিদারুণ শূন্যতা ভর করল!
আজ মঙ্গলবার দুপুর ২টায় ওই কক্ষের সামনে এনটিভির অনুষ্ঠান বিভাগে মিলিত হলেন মোস্তফা কামাল সৈয়দের সহকর্মীরা। তাঁকে গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করে হলো দোয়া মাহফিল।
রাজধানীর কারওয়ান বাজারের বিএসইসি ভবনের অষ্টম তলায় এনটিভি কার্যালয়ের অনুষ্ঠান বিভাগে দোয়া মাহফিল হয়। এনটিভির সব বিভাগের প্রতিনিধিরা সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তাঁরা মোস্তফা কামাল সৈয়দের রুহের মাগফিরাত কামনা ও শোকসন্তপ্ত পরিবারের জন্য দোয়া কামনা করেন।
গণমাধ্যম, বিনোদনসহ বিভিন্ন অঙ্গনের মানুষকে কাঁদিয়ে গত রোববার (৩১ মে) বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল এনটিভির অনুষ্ঠান বিভাগের প্রধান, বহুমুখী প্রতিভায় ভাস্বর মোস্তফা কামাল সৈয়দ চলে যান না-ফেরার দেশে। ওই দিন সন্ধ্যা ৬টা ৪০ মিনিটে রাজধানীর বনানী কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়।
গত ১১ মে মোস্তফা কামাল সৈয়দ অসুস্থ হলে তাঁকে রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ভর্তির পর তাঁকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) নেওয়া হয়। ৩১ মে দুপুরে মারা যান তিনি।
বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন মোস্তফা কামাল সৈয়দ। টিভি প্রযোজক, নাট্য নির্দেশক, অভিনেতা, আবৃত্তিকার ও পরিচালক হিসেবেও পরিচিতি ছিল তাঁর। বাংলাদেশ টেলিভিশনের (বিটিভি) উপমহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি এক ছেলে ও এক মেয়ের জনক। তাঁর স্ত্রী কণ্ঠশিল্পী জিনাত রেহেনা।
১৯৪৩ সালে মোস্তফা কামাল সৈয়দ ঢাকার তেজকুনিপাড়ায় এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা সৈয়দ জিল্লুর রহমান এবং মা আমাতুল উমদা বেগম। বাবা তৎকালীন রেডিও পাকিস্তানের পদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন। ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক সম্পন্নের পর প্রযোজক হিসেবে পাকিস্তান টেলিভিশন করপোরেশনে যোগ দেন মোস্তফা কামাল সৈয়দ। সুদীর্ঘ টেলিভিশন-যাত্রায় বিভিন্ন সময় সৃষ্টি করেন অনেক কালোত্তীর্ণ অনুষ্ঠান, নাটক। অর্জন করেন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে একাধিক পুরস্কার।
পর্দার পেছনের মানুষ হলেও মিডিয়া জগতে সজ্জন ও বিনয়ী মানুষ হিসেবে পরিচিত মোস্তফা কামাল সৈয়দের কণ্ঠ বাংলাদেশের দর্শকের কাছে খুব চেনা। আশি দশকের শুরুতে বিটিভির নাটকের শুরুতে সূচনা সংগীতের পাশাপাশি ভূমিকা কিংবা পুরো নাটকের সারমর্ম সূচনাপর্বে নেপথ্য কণ্ঠে ভেসে আসত। অনেক সময় নাটকের শেষে নেপথ্যে থেকে কিছু না বলা কথা প্রচার হতো। সে সময়ের বেশির ভাগ নাটকের ভূমিকায় কিংবা উপসংহারে শোনা যেত মোস্তফা কামাল সৈয়দের কণ্ঠ।
মোস্তফা কামাল সৈয়দের প্রযোজনায় বেশ কিছু নাটক দর্শকের কাছে প্রশংসিত হয়েছে। সত্তর দশকের শেষের দিকে তাঁর প্রযোজনায় মমতাজউদদীন আহমদ লেখা ‘প্রজাপতি মন’, আশি দশকের শুরুতে আন্তন চেখবের গল্প অবলম্বনে মমতাজউদদীন আহমদের লেখা ‘স্বপ্ন বিলাস’ ছাড়াও ‘নিলয় না জানি’, ‘বন্ধু আমার’, ‘নীরবে নিঃশব্দে’, কাজী আব্দুল ওয়াদুদের লেখা ‘নদীবক্ষে’ উপন্যাসের নাট্যরূপ ‘কূল নাই কিনার নাই’ ইত্যাদি সফল নাটকের সফল প্রযোজক ছিলেন মোস্তফা কামাল সৈয়দ।
মোস্তফা কামাল সৈয়দের ৫২ বছরের কর্মজীবনের বেশির ভাগ সময় কাটিয়েছেন টিভি চ্যানেলে। ২০০৩ সালে এনটিভির শুরু থেকে তিনি অনুষ্ঠান বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন। তাঁর কর্মদক্ষতা ও আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই এনটিভি দর্শকের কাছে দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় রুচিশীল চ্যানেলের উদাহরণ হয়েছে।
মোস্তফা কামাল সৈয়দের স্মৃতিচারণ করে এনটিভির চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলহাজ্ব মোহাম্মদ মোসাদ্দেক আলী বলেন, ‘কামাল ভাই ছিলেন একজন অভিভাবক। শুধু এনটিভির অভিভাবক নয়, কামাল ভাই ছিলেন আমার নিজেরও অভিভাবক। এনটিভি-আরটিভিসহ সকল টেলিভিশন জগতের কাজে উনার যে সাহায্য-সহযোগিতা পেয়েছি, তা ভোলার মতো নয়। উনি হৃদয় দিয়ে এনটিভিকে ভালোবাসতেন, প্রতিষ্ঠানকে ভালোবাসতেন এবং এখানকার সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীকে নিজের পরিবারের মানুষ মনে করতেন। উনি আমাদের সবার অভিভাবক ছিলেন। কামাল ভাইয়ের হাত ধরে এনটিভিতে অনেকগুলো নতুন প্রোগ্রাম এসেছে। যে প্রোগ্রামগুলো অন্যরা পরে অনুসরণ করেছে। আল্লাহ তাঁকে বেহেশত নসিব করুন। তাঁর পরিবারকে এই শোক সইবার শক্তি দিন।’
মোস্তফা কামাল সৈয়দকে স্মরণ করে অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়েন এনটিভির চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলহাজ্ব মোহাম্মদ মোসাদ্দেক আলী। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘শুধু প্রোগ্রাম বিভাগই নয়, অন্যান্য বিভাগেও নানা পরামর্শ দিয়ে সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন কামাল ভাই। আমি কোনটা বলব কামাল ভাইয়ের কথা। কামাল ভাইয়ের অবদানের কথা আলোচনা করতে গেলে সারা দিনেও শেষ হবে না। উনার যে ভালো দিক ছিল, উনার যে গুণগুলো ছিল, সেগুলো যদি আমরা মূল্যায়ন করি, আমার মনে হয় কামাল ভাইয়ের আত্মা শান্তি পাবে।’
মোস্তফা কামাল সৈয়দের মৃত্যুর খবর প্রকাশের পর বিভিন্ন অঙ্গনে শোকের ছায়া নেমে আসে। শোক নামে এনটিভি পরিবারে। তাঁর মৃত্যুতে গভীর শোক ও সমবেদনা প্রকাশ করেন বিভিন্ন অঙ্গনের মানুষ। কর্মচঞ্চল এ মানুষটির মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না কেউ।
মোস্তফা কামাল সৈয়দের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করে নাট্যনির্মাতাদের সংগঠন ডিরেক্টরস গিল্ডের অধীনে ১৫টি আন্তসংগঠন। এক শোকবার্তায় লেখা হয়, “টেলিভিশন নাটকের দর্শকরুচি তৈরিতে তাঁর অসামান্য ভূমিকা অনস্বীকার্য। বিটিভির সেই সময়ে তাঁর প্রযোজিত নাটক দারুণ সাড়া ফেলেছিল। ‘কূল নাই কিনার নাই’ তার মধ্যে অগ্রগণ্য। এনটিভির দায়িত্ব নেওয়ার পর তাদের নাটক জনপ্রিয় করার নেপথ্য নায়ক ছিলেন তিনি। গল্পভাবনা, নির্মাণ কৌশল সম্পর্কে দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা বিনিময় করে নবীন-প্রবীণ সবার সঙ্গে মেলবন্ধন তৈরি করে জনপ্রিয় সব নাটক উপহার দেন। সে কারণে এনটিভির নাটক দর্শকহৃদয়ে বিশেষ স্থান দখল করে নেয়। তাঁর নির্মোহ দূরদৃষ্টি সমাজ এবং পরিবারের প্রতি ইতিবাচক ভাবনার সার্থক প্রয়োগ ঘটান এনটিভির নাটকে।”
নাট্যনির্মাতা চয়নিকা চৌধুরী, মোস্তফা কামাল রাজ, অনিমেষ আইচ, অভিনেত্রী আশনা হাবিব ভাবনা, নুসরাত ইমরোজ তিশাসহ অনেকেই শোক প্রকাশ করে তুলে ধরেন মোস্তফা কামাল সৈয়দের বর্ণিল কর্মযজ্ঞের কথা। তাঁর মৃত্যুর শোক কাটিয়ে উঠতে পারছেন না গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন অঙ্গনের মানুষ।