‘ছাত্রলীগ নেতাদের বিচার চেয়ে’ কৃষক লীগ থেকে বহিষ্কার
কৃষক লীগ থেকে বহিষ্কৃত হলেন রাঙামাটি সদর উপজেলা পরিষদের মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান নাসরিন ইসলাম। চার ছাত্রলীগ নেতার বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগ এনে বিচার দাবি করে সংবাদ সম্মেলন করার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বহিষ্কৃত হন তিনি।
গত ২৪ আগস্ট নিজ বাসায় ছাত্রলীগের চার নেতার হাতে লাঞ্ছিত হওয়া ও শ্লীলতাহানির অভিযোগ এনে ২৯ আগস্ট সংবাদ সম্মেলন করেন সদর উপজেলা কৃষক লীগের মহিলা সম্পাদিকা নাসরিন।
সংবাদ সম্মেলনে এই জনপ্রতিনিধি বিভিন্ন অভিযোগ তুলে ধরে লিখিত বক্তব্যে বলেন, ‘২৪ আগস্ট রাত ৯টার দিকে উপজেলা পরিষদের টিউবওয়েল বসানো নিয়ে আমার বাসায় এক সভা চলার সময় রাঙামাটি জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি আবদুল জব্বার সুজনের ছত্রছায়ায় তাঁরই লালিত ছাত্রলীগের চার নেতা বাসায় হামলা করে। এ সময় বাসার ভেতরে ভাঙচুরসহ আমাকে শ্লীলতাহানিরও চেষ্টা চালায়। রাঙামাটি জেলা ছাত্রলীগের সহসভাপতি হাবিবুর রহমান বাপ্পী, জেলা ছাত্রলীগের সহসম্পাদক আনোয়ার হোসেন কায়সার, জেলা ছাত্রলীগের সদস্য ইমরুল উদ্দিন, রাঙামাটি কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মেজবাহউদ্দিনসহ ১০-১৫ জন মিলে আমাকে দরজার ভেতরে থেকে ছিটকিনি দিয়ে আটকে ছুরি, রড দিয়ে আঘাত করে। এমনকি আমার নাবালিকা মেয়েকে নির্যাতন করে গায়ের কাপড় ছিঁড়ে ফেলে। এদের মধ্যে মেজবাহ উদ্দিন আমার বিল্ডিংয়ে ভাড়া থাকে। দীর্ঘদিন ধরে সে ভাড়া দেয় না। ভাড়া চাইলে আরো ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে।’
নাসরিন ইসলাম আরো বলেন, ‘এসব বিষয়ে কোতোয়ালি থানায় অভিযোগ দায়ের করলেও এখনো মামলা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়নি অভিযোগটি। আমি নিজেই আওয়ামী লীগের রাজনীতি করি, আওয়ামী লীগের সমর্থনে ভাইস চেয়ারম্যানও নির্বাচিত হয়েছি। ছাত্রলীগের এসব কতিপয় সন্ত্রাসীর কারণে দলের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। এসব কর্মকাণ্ডে সরকারের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।’ বর্তমানে তিনি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন বলেও জানান সংবাদ সম্মেলনে।
সংবাদ সম্মেলনের পরদিনই ৩০ আগস্ট রাতে রাঙামাটি জেলা কৃষক লীগের সভাপতি জাহিদ আকতার ও সাধারণ সম্পাদক উদয় শংকর চাকমা যৌথ স্বাক্ষরে দেওয়া এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলেন, ‘সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনৈতিক কর্মকাণ্ড প্রকাশের মাধ্যমে দলীয় ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করায় বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া সংগঠনের সুনাম অক্ষুণ্ণ রাখার স্বার্থে বাংলাদেশ কৃষক লীগ সদর উপজেলা কমিটির মহিলা সম্পাদিকা পদে দায়িত্ব পালন করা নাসরিক ইসলামকে অদ্য (৩০-০৮-২০২০) তারিখে সংগঠন থেকে সাময়িক বহিষ্কার করা হলো।’
একই দিন পৃথক এক বিবৃতিতে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের রাঙামাটি সদর উপজেলা কমিটির সভাপতি দীপক চাকমা ও সাধারণ সম্পাদক সুখময় চাকমা যৌথ বিবৃতিতে বলেছেন, ‘নাসরিন ইসলাম বর্তমানে আমাদের কোনো কমিটিতে নাই, সদস্য পদেও নাই। তাই তাঁর কোনো কাজের দায়ভার সদর উপজেলা আওয়ামী লীগ বহন করবে না।’
বিচার চেয়ে উল্টো বহিষ্কার হওয়ার ঘটনায় বিস্মিত নাসরিন ইসলাম বলেন, ‘২৪ আগস্ট রাতে ঘটনার পর আমি দলের সব নেতার কাছে বিচার দিয়েছি, সবাইকে জানিয়েছি। কেউ কোনো উদ্যোগ নেয় নাই। এমনকি আমি থানায় যে অভিযোগ করেছি, তারাও চাপের কথা বলে মামলা নেয়নি, সাধারণ ডায়েরি (জিডি) নিয়েছে। নিজের দলের নেতা, স্থানীয় প্রশাসন, সবার কাছে জানানোর পরও কোনো প্রতিকার না পেয়ে ২৯ আগস্ট আমি বিচার দাবি করে সংবাদ সম্মেলন করেছি। অথচ বিচার না করে উল্টো দলীয় ভাবমূর্তি নষ্ট করার অভিযোগ এনে আমাকেই বহিষ্কার করা হলো! বিচার আর কার কাছে পাব? অথচ কদিন আগে কাপ্তাই উপজেলা যুবলীগের সভাপতি গাছ চুরির মামলায় দণ্ডিত হয়ে উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যানের পদ থেকে বরখাস্ত হলেও তাঁকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়নি। জেলা ছাত্রলীগের এক নেতা একজনকে মারধরের ঘটনায় দণ্ডিত হলে তাঁকেও বহিষ্কার করা হয়নি। অথচ আমি নারী বলে এবং অন্যায়ের শিকার হওয়া সত্ত্বেও আমাকেই উল্টো বহিষ্কৃত হতে হলো।’
‘অভিযুক্ত চারজনের মধ্যে দুজন জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জমিরউদ্দিনের ছেলে এবং ঘটনার সঙ্গে জড়িতরা সবাই জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি সুজনের অনুসারী। তাই আমি ন্যায়বিচার না পেয়ে উল্টো বহিষ্কৃত হলাম।’
নাসরিন বলেন, ‘আমাকে বহিষ্কার করা হয়েছে, আমিই জানি না। ঘটনার সঙ্গে জড়িতরাই ফেসবুকে আওয়ামী লীগ ও কৃষক লীগের চিঠি প্রচার করে বেড়াচ্ছে।’
এ প্রসঙ্গে রাঙামাটি সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি দীপক চাকমা বলেন, ‘সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রস্তাবিত কমিটিতে নাসরিন ইসলাম সাংস্কৃতিক সম্পাদক হলেও যেহেতু ওই কমিটি এখনো অনুমোদন পায়নি, তাই তিনি আমাদের কেউ নন।’
তাহলে কীভাবে নাসরিনকে ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে দলীয় সমর্থন দেওয়া হয়েছে, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘কোনো প্রার্থী ছিল না, তাই বিশেষ পরিপ্রেক্ষিতে তাঁকে মনোনয়ন দিয়েছি।’
‘ফেসবুকে বিভিন্নজনের পোস্ট দেখেই নাসরিনকে বহিষ্কার করা হয়েছে’ স্বীকার করে দীপক চাকমা বলেন, ‘তিনি দোষী নাকি নির্দোষ, সেটা আমি জানি না। তদন্ত করে যে বা যারা দোষী, তাদের খুঁজে বের করুক প্রশাসন।’
অন্যদিকে নাসরিনকে বহিষ্কার করা জেলা কৃষক লীগের সাধারণ সম্পাদক উদয় শংকর চাকমা বলেন, ‘তাঁর (নাসরিন ইসলাম) কারণে ছাত্রলীগের ভাবমূর্তি নষ্ট হওয়ার অভিযোগ উঠেছে এবং তাই তাঁকে সাময়িক বরখাস্ত করেছি। তিনি নিজেকে যদি নির্দোষ প্রমাণ করতে পারেন, তবে তখন সেটা দেখা যাবে।’
অভিযোগ প্রমাণ ছাড়াই তবে কেন শাস্তি দেওয়া হলো এমন প্রশ্নের জবাবে উদয় শংকর বলেন, ‘এটা তো সাময়িক বহিষ্কার।’ ঘটনায় জড়িত ছাত্রলীগ নেতাদেরও বহিষ্কার করা উচিত কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা আমাদের নীতি-আদর্শ মেনে বহিষ্কার করেছি, তারা কী করবে, সেটা তাদেরই ভাবা উচিত।’
রাঙামাটি সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শহীদুজ্জামান রোমান বলেছেন, ‘বিষয়টি স্পর্শকাতর এবং দলীয় সিদ্ধান্তের বিষয়। দল যে সিদ্ধান্ত নেবে, সেটার প্রতি আমার পূর্ণ সমর্থন থাকবে। তাই এই বিষয়ে আমি কোনো কথা বলতে চাই না।’
গত ২৪ আগস্ট রাত ৯টার পর থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি সুজনের অনুসারী নেতাকর্মীরা একটি ভিডিও আপলোড করে। যাতে দেখা যায়, রাঙামাটি শহরের আলম ডকইয়ার্ড এলাকায় ভাইস চেয়ারম্যানের বাসায় একদল ছাত্রলীগ কর্মী, পুলিশ এবং ভাইস চেয়ারম্যান নাসরিন বাদানুবাদ করছেন। এ সময় ঘটনাস্থলে সুজনের প্রতিদ্বন্দ্বী রাঙামাটি কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি বাপ্পীর অনুসারী বহিষ্কৃত ছাত্রলীগ নেতা নূরে আলমকেও দেখা গেছে।
নাসরিনের অভিযোগ, ছাত্রলীগ নেতা নূরে আলমের সঙ্গে বাসায় বসে টিউবওয়েল নিয়ে কথা বলার সময় তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী পক্ষের ছাত্রলীগ নেতারা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সামাজিকভাবে হেয় করার জন্যই নিজেরা বাসার দরজায় তালা দেয়। এরপর লোকজন ডেকে এনে হৈচৈ করে অস্বস্তিকর পরিবেশ তৈরি করেছে।
অন্যদিকে সুজন অনুসারীদের অভিযোগ, ভাইস চেয়ারম্যান নাসরিন ‘অসামাজিক কাজ’-এ লিপ্ত ছিলেন।
তবে সেই সময় ঘটনাস্থলে যাওয়া পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) ওসমান বলেছেন, ‘আমরা খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে যাই এবং সেখানে গিয়ে দেখি ভাইস চেয়ারম্যানের বাসার সামনে কিছু ছেলে দাঁড়িয়ে আছে এবং ওনার বাসা বাইরে থেকে হুক লাগানো। আমরা দরজা খুলে দেখি ভাইস চেয়ারম্যান প্রকল্পের কিছু কাগজপত্র দেখছেন। বাইরে থেকে যে দরজা বন্ধ, সেটি তখনো তিনি জানেন বলে মনে হয়নি। আমাদের কাছে অস্বাভাবিক কোনো কিছুই চোখে পড়েনি। তবে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করার বিষয়টির কারণে উনি প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হন এবং বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেগুলোও হৈচৈ করছিল। পরে আমরা তাদের সরিয়ে দিই সেখান থেকে। এরপর ভাইস চেয়ারম্যান এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে একটি অভিযোগ দায়ের করেছেন, সেটির তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে আমি বিষয়টি তদন্ত করছি।’