দুই দফা বন্যায় নাকাল সুনামগঞ্জে ফের অতিবৃষ্টির আশঙ্কা
এক সপ্তাহ আগে শুরু হওয়া দ্বিতীয় দফা বন্যার ধকল এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি সুনামগঞ্জের মানুষ। এখনো অনেকে পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে। অনেক স্থানে রাস্তাঘাটও ডুবে আছে।
এর মধ্যেই আজ বৃহস্পতিবার আবার সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, আগামী ২০ জুলাই থেকে আবারো বৃষ্টিপাতের আশঙ্কা রয়েছে। যদি অতিমাত্রায় বৃষ্টিপাত হয়, তাহলে আবারো বন্যার আশঙ্কা থেকেই যায়।
এর আগে গত ১৫ জুন প্রথম দফায় বন্যার কবলে পড়ে সুনামগঞ্জের মানুষ।
সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সবিবুর রহমান এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘আগামী ১৯ জুলাই (রোববার) পর্যন্ত খুব একটা বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা নেই। তবে আবহাওয়া অফিস বলছে, ২০ জুলাই (সোমবার) থেকে আবারো বৃষ্টিপাত হতে পারে। যদি অতিমাত্রায় বৃষ্টি হয়, তাহলে আবারো পানি বৃদ্ধি পাবে।’
মো. সবিবুর রহমান জানান, দ্বিতীয় দফার বন্যায় হাওরাঞ্চলে এখনো অনেক জায়গায় পানি রয়ে গেছে। নদ-নদীর পানি কমে গেলেও হাওরের পানি খুব ধীরগতিতে নামছে। মানুষের বাড়ির আশপাশে পানি থাকায় দুর্ভোগ এখনো রয়ে গেছে।
এদিকে দ্বিতীয় দফার বন্যায় জেলার দক্ষিণ সুনামগঞ্জ, দিরাই, শাল্লা ও জগন্নাথপুরে বন্যা দেখা দেয়। নদ-নদীর পানি নেমে গেলেও হাওরে বেশি পানি থাকায় হাওর এলাকার বেশিরভাগ গ্রামে এখনো পানি রয়ে গেছে। দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে এখনো ৮০০ পরিবার রয়েছেন। এই উপজেলার এক হাজার থেকে দেড় হাজার মানুষ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বলে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। যদিও এর থেকে আরো অনেক বেশি মানুষ এই উপজেলায় বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বলে জানা গেছে।
দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার পাগলা শরিয়তপুর গ্রামের মো. আহাদ মিয়া (৭০) জানান, দুই দফার বন্যায় তাঁর বাড়ি-ঘরে কোমর পানি হয়ে আছে। কোনোমতে কলার ডিঙ্গি বানিয়ে তিনি বাড়িতেই পড়ে আছেন। কেউ এসে খবরও নেয় না বলে অভিযোগ এই বৃদ্ধের। তিনি আরো বলেন, ‘আজ সকালে দুই-তিনজন ছেলে এসে কিছু চাল, ডাল দিয়ে গেছে।’
একই গ্রামের সুরতুন্নেছা (৬০) বলেন, ‘আমরা সাওরো বাসাই গেলেও কেউ আয় না, একটু দেখে না। আমরা কই যামু, কী খামু কেউ দেখে না। পানি আমরার ঘরো অখনো রইছে, আল্লায় জাননই কোনদিন এই পানি যাইব।’
সুনামগঞ্জের স্বেচ্ছাসেবী মো. আম্মার বলেন, ‘আজ আমরা আমাদের নিজেদের এবং এক বড়ভাইয়ের দেওয়া কিছু টাকা নিয়ে দক্ষিণ সুনামগঞ্জের কয়েকটি গ্রামে গিয়েছিলাম ত্রাণ দিতে। গিয়ে দেখি, গ্রামের বেশিরভাগ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এখনো অনেক মানুষের ঘরে পানি, কারো আবার বাড়ির উঠোনে পানি। মানুষ খেয়ে-না খেয়ে পানি নিয়েই ঘরে পড়ে আছেন। এই দৃশ্য দেখে খুব খারাপ লেগেছে। আমরা সবাইকে সহায়তা দিতে পারিনি। তারপরও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেখে আমরা সহায়তা দিয়েছি। যদিও সবারই সাহায্য লাগবে। আমি সবাইকে বলব, যে যার জায়গা থেকে সহায়তার হাত বাড়াতে।’
দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জেবুন নাহার শাম্মী জানান, জেলায় বন্যা হওয়ার কিছুদিন পর এই উপজেলায় আঘাত হানে। তবে বন্যা দুই দফা হলেও আমরা সামাল দিয়েছি। আমাদের কাছে পর্যাপ্ত ত্রাণ ও খাবার আছে। আমরা মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ত্রাণ ও শুকনো খাবার দিচ্ছি। এখন পর্যন্ত ৮০০ পরিবার বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছে। আমরা তাদের স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে তৈরি করা খাবার ও শুকনো খাবার দিচ্ছি।’
একইভাবে দিরাই, শাল্লা ও জগন্নাথপুর উপজেলায় বন্যা আঘাত হানে। এই তিন উপজেলাতেও বন্যার পানি থাকায় মানুষ লড়াই করে টিকে আছে। দুর্গতি পোহাচ্ছেন কয়েক লাখ মানুষ।
তবে সীমান্ত এলাকা তাহিরপুর, বিশ্বম্ভরপুর ও দোয়ারাবাজারে নদী তীরবর্তী এলাকা থেকে পানি কিছুটা নেমে গেছে। তবে হাওর এলাকায় পানি একই অবস্থায় আছে।
এদিকে, বন্যায় দুর্গতদের মধ্যে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের মাধ্যমে একযোগে ত্রাণ তৎপরতা চালাচ্ছে জেলা প্রশাসন।
সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল আহাদ বলেন, ‘এ পর্যন্ত সুনামগঞ্জে মোট ৩৫২টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। প্রত্যেক আশ্রয়কেন্দ্রে সরকার থেকে প্রাপ্ত জিআর চাল, নগদ অর্থ ও করোনা সচেতনতায় মাস্ক, পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট জেলা প্রশাসন এবং উপজেলা প্রশাসনের মাধ্যমে বিতরণ করা হচ্ছে।’
জেলা প্রশাসক জানান, গত মঙ্গলবার দিনব্যাপী বিভিন্ন উপজেলায় গিয়ে ত্রাণ সহায়তা করা হয়েছে। এই তৎপরতা অব্যাহত থাকবে। এ ছাড়া সুনামগঞ্জের জন্য আরো বরাদ্দ চেয়ে মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়, বন্যায় জেলায় প্রায় এক লাখ সাত হাজার পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এখন পর্যন্ত ৮৬৫ মেট্রিক টন চাল, ৪৭ লাখ ৭০ হাজার টাকা, এক হাজার ৯০০ প্যাকেট খাবার, দুই লাখ টাকার শিশুখাদ্য ও দুই লাখ টাকার গো-খাদ্য বিতরণ করা হয়েছে। বন্যা যতদিন থাকবে, ততদিন মানুষকে প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া সহায়তা পৌঁছে দেওয়া হবে বলে জানায় জেলা প্রশাসন।
এদিকে, গত ১৯ দিন ধরে বন্যার পানি সড়কের উপরে থাকায় জেলা সদর, তাহিরপুর, বিশ্বম্ভরপুর, দোয়ারাবাজার, জামালগঞ্জ ও ছাতক উপজেলার সড়ক যোগাযোগ এখনো বিছিন্ন রয়েছে।